ঢাকা, শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করুন

প্রকাশনার সময়: ১৫ নভেম্বর ২০২২, ১৭:২১

মহামারি করোনাভাইরাস, ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ ও সম্প্রতি ঘটে যাওয়া প্রাকৃতিক দুর্যোগ সিত্রাংসহ নানা কারণে বাংলাদেশসহ সারাবিশ্ব আজ এক ভয়ানক আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। এসব সমস্যা থেকে খাদ্য সংকট সৃষ্টি হওয়াকে কেন্দ্র করে মানুষের মধ্যে চলছে হাহাকার। দিন যত যাচ্ছে মানুষের মধ্যে খাদ্যাভাব তত এগিয়ে আসছে। খাদ্যপণ্যের দাম যেভাবে বাড়ছে সেভাবে বাড়েনি মানুষের আয়-রোজগার। যার কারণে মানুষ এখন দিশাহারা হয়ে পড়ছে। বিশ্বব্যাপী অভুক্ত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। একইসঙ্গে আগামী বছরগুলোতে বিশ্বের প্রায় সব দেশে দারিদ্র্যের সংখ্যাও বেড়ে যাবে। খাদ্য দুষ্পাপ্য হওয়ায় অপুষ্টিজনিত রোগব্যাধি যেমন বাড়বে, তেমনি মানুষের মধ্যে পুষ্টিহীনতাও বাড়বে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা খাদ্য নিরাপত্তার বড় ঝুঁকিতে পড়েছে।

শুধু বাংলাদেশ নয়, খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা পুরো বিশ্বেই এখন একটি সংকটপূর্ণ ইস্যু। বিশ্বজুড়েই বিভিন্ন সংকট চলছে। কোভিড, জলবায়ু পরিবর্তন ও যুদ্ধের কারণে বিশ্বের অনেক মানুষ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার মুখোমুখি হচ্ছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে এবং খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে সরকারি-বেসরকারি খাতকে সম্মিলিতভাবে দায়িত্ব নিতে হবে।

দেশীয় ও আন্তর্জাতিক গবেষণা তথ্য বলছে, নিকট-ভবিষ্যতে এ খাদ্যশস্যের অভাব আরও বেশি মানুষের জীবনকে বিঘ্নিত করতে পারে। সম্প্রতি জাতিসংঘের খাদ্যবিষয়ক সংস্থা বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডাব্লিউএফপি) নতুন করে বিশ্বব্যাপী খাদ্যসংকটের আগাম সতর্কতা জারি করেছে। আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা অক্সফামের প্রতিবেদনেও বৈশ্বিক খাদ্যসংকটের পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, দেশে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য দ্রুত প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে।

সম্প্রতি বয়ে যাওয়া ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে কৃষির। উপকূলীয় এলাকাসহ দেশের বিভিন্ন অংশে আমন ধানের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের হিসাবে ঘূর্ণিঝড়ের শিকার হয়েছে ৮০ হাজার ৭৭৭ হেক্টর জমির আমন ধান। এর বাইরে ধানের চিটা পড়ার আশঙ্কাও রয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ে তরিতরকারি-শাকসবজি ও মাছের উৎপাদনও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এমনিতেই এবার আমনের আবাদ কম হয়েছে, ফলে উৎপাদন কম হবে বলে আগে থেকেই আশঙ্কা করা হচ্ছে। আমন আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৫৯ লাখ ৫৮ হাজার হেক্টর। বাস্তবে আবাদ হয়েছে ৫৬ লাখ ৭৪ হাজার হেক্টরে। এতে উৎপাদন কমবে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অন্তত ২৫ লাখ টন। সিত্রাংয়ে উৎপাদন ক্ষতি হতে পারে আরও অন্তত ১০ লাখ টন। সব মিলে যে ক্ষতিটা দাঁড়াবে, সেটা বিশাল। এতে খাদ্যনিরাপত্তা বড় রকমের ঝুঁকিতে পড়বে। উল্লেখ করা যেতে পারে, খাদ্য মজুদের পরিমাণ আগের চেয়ে কমেছে।

গত কয়েক মৌসুমে ধান-চাল সংগ্রহ লক্ষ্য অর্জিত হয়নি। খাদ্যশস্যের উচ্চমূল্য নিয়ন্ত্রণ এবং দারিদ্র্যের সহায়তায় স্বল্পমূল্যে সরকারিভাবে যথেষ্ট পরিমাণ চাল বিক্রিও করা হয়েছে। এতে স্বাভাবিকভাবেই মজুদ কমেছে। পক্ষান্তরে আমদানির মাধ্যমে মজুদ বাড়ানোর চেষ্টাও সফল হয়নি। সম্প্রতি আমদানি শুল্ক কমিয়ে দেয়া হলেও চাল আমদানি তেমন একটা বাড়েনি। চালসহ খাদ্য ও অন্যান্য পণ্যের দাম হু হু করে বাড়ছে। মূল্যস্ফীতি গত এক যুগের মধ্যে সর্বোচ্চ প্রায় ১০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। সব কিছুর দাম যথেচ্ছ বাড়লেও মানুষের আয় বাড়েনি। ফলে খাদ্যাভাব, দারিদ্র, পুষ্টিহীনতা ও মানসিক বিপর্যয় সীমা ছাড়াতে বসেছে। উৎপাদন বৃদ্ধি ও আমদানির মাধ্যমে অবিলম্বে খাদ্যের নিরাপদ মজুদ গড়ে তুলতে না পারা, খাদ্যাভাবই বাড়বে না, দেশ দুর্ভিক্ষের মুখেও পড়তে পারে। বিশ্ব খাদ্য পরিস্থিতিও অত্যন্ত নাজুক। খরা-বন্যা ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিভিন্ন দেশে খাদ্যশস্যের উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়েছে বা কমে গেছে। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ খাদ্য পরিস্থিতিকে আরও ঝুঁকিতে নিক্ষেপ করেছে। যুদ্ধের কারণে খাদ্যের আমদানি-রফতানি বা অবাধ চলাচলে নজিরবিহীন সংকট দেখা দিয়েছে। সবমিলে যে অবস্থা, তাতে আগামী বছর বিশ্বে দুর্ভিক্ষ দেখা দিতে পারে বলে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা আশঙ্কা ব্যক্ত করেছে।

বাংলাদেশে খাদ্যোৎপাদন যে কমবে, সেটা ফাও-ও বলেছে। বলেছে, এ বছর অন্তত ০.০৩ শতাংশ উৎপাদন কমবে। খাদ্যনিরাপত্তার হুমকিতে থাকা ৪৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। উৎপাদন কমলে এ অবস্থানের যে অবনমন ঘটবে, সেটা বলাই বাহুল্য। খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে উৎপাদন বাড়ানোর আসলে বিকল্প নেই। প্রয়োজনীয় খাদ্য আমদানি করা যায়। তবে শর্ত হলো, আমদানি করার মতো অর্থ থাকতে হবে, খাদ্যও থাকতে হবে। ২০০৮ সালের দিকে বিশ্বে যখন খাদ্য সংকট দেখা দেয়, তখন বর্ধিত মূল্য দিয়েও খাদ্য কিনতে পাওয়া যায়নি। বাংলাদেশেরও এমন অভিজ্ঞতা রয়েছে। এবারের অবস্থা ভিন্ন। এবার আমদানি করার মতো অর্থও নেই। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এমন একটা পর্যায়ে এসে উপনীত হয়েছে যে, তিন মাসের আমদানি ব্যয় নির্বাহ করাও সম্ভব হবে না। বৈদেশিক মুদ্রার অভাব বা ডলার সংকটে খাদ্যসহ জরুরি আমদানি ব্যাহত হচ্ছে, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ বাড়ানোর সুযোগ-সম্ভাবনাও কমে আসছে।

ইতোমধ্যেই খবর পাওয়া গেছে, বৈদেশিক মুদ্রার সব উৎসেই ভাটার টান ধরেছে। রফতানি আয়, প্রবাসী আয় ও উন্নয়ন সহযোগীদের অর্থ ছাড় সবই কমেছে। ৮০ শতাংশের বেশি রফতানি আয় আসে গার্মেন্টপণ্য থেকে। গার্মেন্টপণ্যের প্রধান বাজার যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ। কিন্তু ওই দুই বাজারে প্রবৃদ্ধি ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে। সেপ্টেম্বরে গার্মেন্টবাজারে প্রবৃদ্ধি হ্রাস পেয়েছিল ৭ দশমিক ৫২ শতাংশ। অক্টোবরে সেটা ২০ শতাংশে দাঁড়াতে পারে। এমন আশঙ্কাই প্রকাশ করেছেন বিজিএমইএ নেতৃবৃন্দ। এই নেতিবাচক প্রবৃদ্ধির কারণ যে, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্বিপাক, অর্থনৈতিক অস্থিরতা ও মন্দা, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। যতদিন বিদ্যমান পরিস্থিতি বিশেষ করে যুদ্ধ অব্যাহত থাকবে ততদিন বিশ্বের অর্থনৈতিক অধঃগতি ও নাজুক অবস্থা থেকে উঠে আসা অসম্ভব। যুদ্ধের কারণে বিশ্বে জ্বালানি সংকট দেখা দিয়েছে। তার প্রভাব বিদ্যুৎ উৎপাদনসহ সব কিছুর উৎপাদনের ক্ষেত্রে পড়ছে। বাংলাদেশ এ প্রভাবের বাইরে নেই। জ্বালানি ক্ষেত্রে বাংলাদেশ প্রায় পুরোপুরি বিদেশনির্ভর। ফলে জ্বালানি তেল ও বিদ্যুৎ প্রকট আকার ধারণ করেছে। এর প্রতিক্রিয়া পণ্যমূল্য, উৎপাদন ও রফতানিতে পড়ছে।

বস্ত্রশিল্পের মালিকরা ক’দিন আগে বলেছেন, গ্যাস-বিদ্যুতের কারণে তাদের উৎপাদন ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তারা নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস-বিদ্যুৎ চায়। এজন্য বাড়তি মূল্য দিতেও রাজি। বস্ত্রশিল্প ও গার্মেন্টশিল্প পরস্পর নির্ভরশীল। এর কোনো একটিতে সংকট দেখা দিলে অন্যটিও সংকটে পড়ে। রফতানি আয় ধরে রাখতে বস্ত্র ও গার্মেন্ট শিল্পের সার্বক্ষণিক সচলতা নিশ্চিত করা জরুরি। প্রবাসী আয় প্রতি মাসেই কমছে। আগস্টের তুলনায় সেপ্টেম্বরে, সেপ্টেম্বরের তুলনায় অক্টোবরে অনেক কমেছে। উন্নয়ন সহযোগীদের অর্থ ছাড়ের প্রবাহও অত্যন্ত নিম্নগামী। বৈদেশিক মুদ্রার নিরাপদ মজুদ না থাকলে শুধু আমদানিই নয়, উন্নয়নকাজ চালানো, দায় পরিশোধ ইত্যাদি সব ক্ষেত্রেই বাধা ও বিভ্রাট দেখা দেয়।

বিশ্ব খাদ্য পরিস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনিও দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন। বাংলাদেশ যাতে খাদ্যাভাব বা দুর্ভিক্ষের শিকার না হয় সেজন্য তিনি খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছেন। সব খালি জায়গায় খাদ্যশস্যসহ অন্যান্য পণ্য উৎপাদনের জন্য দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তার এ আহ্বান অত্যন্ত যৌক্তিক, বাস্তবিক ও সময়ানুগ। দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে খাদ্যশস্যসহ মাছ, পোলট্রি, তরিতরকারি, শাকসবজি ও ফলফলাদির উৎপাদন বাড়াতে হবে। মনে রাখতে হবে, খাদ্যপণ্য বলতে শুধু চাল ও গমই বোঝায় না, আরও অনেক কিছুই খাদ্যপণ্যের অন্তর্গত। কাজেই, কৃষিতে উৎপাদনের একটা জোয়ার তৈরি করতে হবে।

কৃষি উৎপাদন বাড়লেও নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করা বাংলাদেশের জন্য প্রধান চ্যালেঞ্জ। খাদ্য উৎপাদনে সঠিক জ্ঞান ও অসাধুতা এবং বাজারজাতকরণ এবং বিপণনে দক্ষ ব্যবস্থাপনার অভাবে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য জোগানে অনেক পিছিয়ে।

এই সমস্যা সমাধানে কৃষির উৎপাদনে সঠিক জ্ঞান, দক্ষতা বাড়ানোর পাশাপাশি সঠিক কৃষি উপকরণে জোগান বাড়াতে হবে। কাজ করতে হবে বাজারজতকারণ ও বিপণন ব্যবস্থার উন্নতিতে। কৃষকদের কাছে তথ্য নিয়ে যেতে হবে। সব মিলিয়ে কাজ করতে হবে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন, বাজার ব্যবস্থাপনা এবং কৃষিবান্ধব নীতি ও পরিকল্পনা নিয়ে।

কৃষি, খাদ্য,বাণিজ্য ইত্যাদি মন্ত্রণালয়কে একসঙ্গে বসে একটা মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে, পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পদ্ধতি ও উপায় নির্ধারণ করতে হবে এবং কাজে নেমে পড়তে হবে। এ ব্যাপারে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে, যাতে জনগণ উদ্বুদ্ধ হয়ে উৎপাদন বিপ্লবে শরিক হতে পারে। একইসঙ্গে গণমুখী কর্মসূচি, উৎপাদনমুখী প্রকল্প, বিনিময়মূলক কার্যব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। একদিকে খাদ্যসংস্থান, অন্যদিকে কর্মের ব্যবস্থা করতে পারলে খাদ্যাভাব বা দুর্ভিক্ষ রোধ করা সহজ হবে।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

নয়া শতাব্দী/আরআর

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ