ঢাকা, শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

ব্রিটিশ গণতন্ত্রের সৌন্দর্য, মহত্ত্ব ও আভিজাত্য

প্রকাশনার সময়: ০২ নভেম্বর ২০২২, ১৫:০২

ভারতীয় বংশোদ্ভূত ঋষি সুনাক মাত্র ৪২ বছর বয়সে ব্রিটেনের নতুন প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়ে এক বিরল রেকর্ডের অধিকারী হয়ে সারা বিশ্বে হৈচৈ ফেলে দিয়েছেন। তিনিই প্রথম কোনো অশ্বেতাঙ্গ এবং অভিবাসী পরিবারের সন্তান যিনি ব্রিটেনের একটি প্রধান রাজনৈতিক দল কনজারভেটিভ পার্টির নেতা এবং একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী হলেন। তিনি গত দুইশ’ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম বয়সি প্রধানমন্ত্রীও। এর আগে তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ব্রিটেনের ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টির নেতা নির্বাচিত হওয়ার পর প্রথা অনুযায়ী ব্রিটেনের বাকিংহ্যাম প্রাসাদের রাজা তৃতীয় চার্লস তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেন। এর আগে তার পূর্ববর্তী প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাস মাত্র ৪৫ দিনের মাথায় ব্যাপক বিতর্ক ও সমালোচনার মুখে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। তারও আগে তেরেসা মে এবং বরিস জনসনও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাদের মেয়াদপূর্তির আগেই ব্যাপক বিতর্কের পর পদত্যাগ করেন বা করতে বাধ্য হন। মোটকথা ২০১৯ সালের পর থেকে ঋষি সুনাক পর্যন্ত মাত্র চার বছরের মধ্যে চারজন প্রধানমন্ত্রী দায়িত্ব পালন করেছেন, অথচ তারা জনগণের ম্যান্ডেডকে শ্রদ্ধা করে যেভাবে স্বেচ্ছায় ক্ষমতা ছেড়ে দিয়েছেন অর্থাৎ গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা ও মূল্যবোধ সমুন্নত করার জন্য যখনই প্রয়োজন হয়েছে তখনই তারা পদত্যাগ করেছেন। তারা কেউই ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার ইচ্ছে পোষণ করেননি। যদিও ব্রিটেনের বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থা বেশ চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি এবং ঋষি সুনাককে সেই কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলা করেই সামনে অগ্রসর হতে হবে।

আসলে গণতন্ত্র হলো এমন একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা, বা কোনো প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা বা একটি দেশের মধ্যে সিদ্ধান্ত গ্রহণের এমন ব্যবস্থা, যেখানে সমস্ত সদস্যই ক্ষমতার সমান অংশীদার। আধুনিক গণতন্ত্রকে দুটি বৈশিষ্ট্য দ্বারা চিহ্নিত করা হয় যা তাদের প্রাচীনকালের সরকারগুলো থেকে পৃথক করে, তাদের নিজস্ব সমাজে হস্তক্ষেপ করার ক্ষমতা ও একইভাবে সার্বভৌম রাষ্ট্রগুলোর দ্বারা বানানো আন্তর্জাতিক আইনত কাঠামোর দ্বারা তাদের সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি দেয়া। গণতান্ত্রিক সরকার সাধারণত বহুতান্ত্রিক ও রাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার থেকে পৃথক, যা যথাক্রমে সংখ্যালঘু এবং একক রাজার দ্বারা শাসিত হয়।

মজার বিষয় হচ্ছে ব্রিটেন একটি সংসদীয় গণতান্ত্রিক দেশ হওয়া সত্ত্বেও সেখানে আজও বংশানুক্রমিকভাবে রাজতন্ত্র টিকে আছে। এখন পর্যন্ত বিশ্বের যে সব দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেই সমস্ত দেশের রাজতন্ত্রের অবসান ঘটেছে কিন্তু কিছু নিয়ম-কানুন ও রীতিনীতির কারণে ব্রিটেনের রাজতন্ত্র আজও টিকে আছে। ব্রিটেনের রাজা-রানীর কারণে ব্রিটিশ জাতি আজও ঐক্যবদ্ধ রয়েছে। রাজা বা রানী কোন দল বা শ্রেণির প্রতিনিধি না হয়ে দলমত নির্বিশেষে তিনি সর্বসাধারণের রাজা-রানীর ভূমিকা পালন করেন। এই ভাবনার ফলে ব্রিটিশ জাতি ঐক্যবদ্ধভাবে অবস্থান করে এবং এটি রাজতন্ত্র টিকে থাকার সহায়ক।

ব্যুৎপত্তিগত অর্থে গণতন্ত্র হলো জনগণের শাসন। অর্থাৎ সরকার বা শাসনব্যবস্থা যখন সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামত নিয়ে পরিচালিত হয়, তখন তাকে গণতন্ত্র বা গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা বলা হয়। আব্রাহাম লিংকন তার গেটিসবার্গ বক্তৃতায় গণতন্ত্রের সংজ্ঞা দিয়েছিলেন এভাবে ‘Government of the people, by the people, for the people.’ যার অর্থ হলো— গণতান্ত্রিক সরকার জনগণের অংশগ্রহণ, জনগণের দ্বারা শাসিত ও জনগণের কল্যাণের জন্য। প্রথম গণতন্ত্রের সূচনা হয় গ্রিসের নগররাষ্ট্র এথেন্সে। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকে সলোন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ভিত্তি স্থাপন করেন। এ জন্য তাকে আখ্যায়িত করা হয় ‘গণতন্ত্রের জনক’। আর যুক্তরাজ্যে সংসদীয় বা আধুনিক গণতন্ত্রের যাত্রা শুরু হয় ১৫ জুন ১২১৫ ম্যাগনাকার্টা (Magna Carta) নামক এ ঐতিহাসিক চুক্তির মাধ্যমে। এর প্রথম নাম ছিল ‘চার্টার অব রানিমেড’ কিন্তু পরে এটি ম্যাগনাকার্টা চার্টার নামে পরিচিতি লাভ করে। এ চুক্তির মাধ্যমে চালু হওয়া যুক্তরাজ্যের গণতন্ত্র আজ অনেক দেশেই প্রচলিত ও অনুসৃত।

আধুনিককালে গণতন্ত্রের ব্যাপক প্রসার ও চর্চা পরিলক্ষিত হয়। অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয় ভাগে সমগ্র ইউরোপে এর প্রভাব বিস্তৃত হয়। গ্রেট ব্রিটেন, জেনিভা, অস্ট্রিয়া, নেদারল্যান্ডস ও মার্কিন উপনিবেশসমূহে এর ক্রমশ শিকড় বিস্তার লাভ করতে থাকে এবং ফরাসি বিপ্লবের মধ্য দিয়ে এর চরম সাফল্য সূচিত হয়। অষ্টাদশ শতকের গণতান্ত্রিক ভাবধারার উৎস স্থল হিসেবে প্রধানত ইংল্যান্ডকে চিহ্নিত করা যায়। রাজার স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে সেখানে তখন পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব কায়েমের জন্য আন্দোলন করা হয়। এক হিসেবে তারাই ছিলেন গণতন্ত্রের অগ্রদূত। ইংল্যান্ডের বিশিষ্ট চিন্তানায়করাও এ ব্যাপারে পশ্চাৎপদ ছিলেন না। গণতন্ত্রের সমর্থনে তারাও অনেক গ্রন্থ রচনা করেন। এদের মধ্যে জন লকের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, কেননা তিনিই ছিলেন আধুনিক গণতন্ত্রের জনক। তিনি তার ‘অ্যান এসে কনসার্নিং দ্য ট্রু অরিজিনাল, একটেন্ট অ্যান্ড এন্ড অব সিভিল গভর্মেন্ট’ (An Essay Concerning the True Original, Extent and End of Civil Government) গ্রন্থে তিনি গণতন্ত্রের ভিত্তি সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে বলেন যে, সরকার ও শাসিতের সম্পর্ক সমাজচুক্তি বুনিয়াদের ওপর প্রতিষ্ঠিত। এই চুক্তি অনুযায়ী জনগণ সরকারকে শাসনাধিকার দিয়েছে এবং যদি সরকার চুক্তিবিরোধী কাজ করে তবে জনগণ বিপ্লবের সাহায্যে সরকার পরিবর্তনের অধিকার রাখে। জন লকের মতবাদ আমেরিকার স্বাধীনতাকামী জনগণকে বিপুলভাবে প্রভাবিত করেছিল। বস্তুত জেফারসনের ‘স্বাধীনতা ঘোষণা’র মূলে লকের ভাবধারার প্রভাব বিদ্যমান।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, বিংশ শতাব্দীর শুরুতে বিশ্বের এক-চতুর্থাংশ এলাকা ও জনগণ কোনো না কোনোভাবে ব্রিটিশদের নিয়ন্ত্রণে ছিল; ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ছিল বিশ্বের ইতিহাসের বৃহত্তম সাম্রাজ্য। এ কারণে বলা হয় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে কখনও সূর্য অস্ত যেত না। কিছু কিছু দেশে যথেষ্টসংখ্যক ব্রিটিশ অধিবাসী অভিবাসিত হন এবং ব্রিটেনের অপত্য রাষ্ট্রের জন্ম দেন। এদের মধ্যে আছে কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড। বহু বছর ধরে ভারতীয় উপমহাদেশ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপনিবেশ ছিল। এক দীর্ঘ সাম্রাজ্যবিরোধী লড়াইয়ের পর ভারতবর্ষ স্বাধীন হয় এবং এটি বর্তমানে বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। দক্ষিণ, পশ্চিম ও পূর্ব আফ্রিকার উল্লেখযোগ্য পরিমাণ এলাকাও ব্রিটেনের নিয়ন্ত্রণে ছিল। এছাড়া এশিয়ার কিছু গুরুত্বপূর্ণ এলাকা যেমন হংকং, আমেরিকাতে কিছু ক্ষুদ্র উপনিবেশ এবং প্রশান্ত মহাসাগরে বহু দ্বীপ ব্রিটেন নিয়ন্ত্রণ করত। বর্তমানে এদের বেশিরভাগই স্বাধীন রাষ্ট্র হলেও এদের অনেকগুলোই ব্রিটিশ আইন, প্রতিষ্ঠান এবং রীতিনীতি ধরে রেখেছে। এমনকি বিশ্বের যেসব এলাকা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অংশ ছিল না, সেখানেও অনেক দেশে ব্রিটিশ সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা তথা ওয়েস্টমিনস্টার মডেল গ্রহণ করা হয়েছে। এই মডেলটি আদিতে রাজকীয় শাসকের ক্ষমতার বাহন হলেও ধীরে ধীরে বিবর্তিত হয়ে একটি প্রতিনিধিত্বমূলক সরকারে পরিণত হয় এবং শেষ পর্যন্ত গণতন্ত্র চর্চার উপযুক্ত হয়ে ওঠে। বর্তমানে ব্রিটেনে আইন প্রণয়নের ক্ষমতা সংসদের নিম্ন কক্ষের দায়িত্ব, যে কক্ষের নাম হাউস অব কমন্স। হাউস অব কমন্সের প্রতিনিধিরা উন্মুক্ত নির্বাচনে নির্বাচিত হয়ে আসেন এবং দেশের প্রধান নির্বাহী প্রধানমন্ত্রীকে তারা নির্বাচিত করেন। প্রধানমন্ত্রী আবার হাউস অব কমন্সের মধ্য থেকে তার মন্ত্রিসভার জন্য সদস্য বাছাই করেন।

গণতন্ত্র হলো সেই মন্ত্র যেখানে চিন্তার স্বাধীনতা, কথা বলার স্বাধীনতা, কাজের স্বাধীনতা আর উপাসনার স্বাধীনতা থাকে। এটাই গণতন্ত্রের মতাদর্শ। সবার সঙ্গে সমতা ও সহমর্মিতা গণতন্ত্রের মুখ্য উদ্দেশ্য। তাই ব্যক্তির মূল্য আর মর্যাদা দানই গণতন্ত্রের প্রথম কথা। গণতন্ত্র শব্দটির অর্থই জনগণের ক্ষমতা। গণতন্ত্রের নির্যাস হলো ভিন্নমত পোষণ করা, ভিন্ন বিশ্বাসের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া এবং সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের প্রতি প্রাধান্য দিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা। ব্রিটিশ সংসদীয় গণতন্ত্রে এসব বিষয় বেশ লক্ষ্যণীয় এবং ব্রিটিশ গণতন্ত্রের সৌন্দর্য ও মহত্ত্ব এখানেই। এজন্যই গণতান্ত্রিক দেশগুলো ব্রিটিশ গণতন্ত্র অনুসরণ ও অনুকরণ করার সর্বাত্মক চেষ্টা করে।

ব্রিটিশরা মূলত তাদের জীবনে গণতন্ত্র, আইনের শাসন, ব্যক্তি স্বাধীনতা, সম্মান, শ্রদ্ধাবোধ এবং সহনশীলতাকে মৌলিক মূল্যবোধ হিসেবে বিবেচনা করে। এসব মূল্যবোধগুলো শুধু ব্রিটিশ হওয়ার জন্য একচেটিয়া বা খুব গুরুত্বপূর্ণ তা নয়, বরং অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশগুলোও একটি সুশৃঙ্খল সমাজ তৈরির উপায় হিসেবে বিবেচনা করে, যেখানে স্বতন্ত্র সদস্যরা নিরাপদ, মূল্যবোধ ধারণ করতে পারে এবং নিজের ও অন্যদের ভালোর জন্য অবদান রাখতে পারে। যদিও প্রাচীন গ্রিসকে গণতন্ত্রের জন্ম স্থান বলা হয়, তবে ব্রিটেনকে বলা হয় আধুনিক গণতন্ত্রের সূতিকাগার। কারণ অষ্টাদশ শতাব্দী থেকেই ব্রিটেনের মাধ্যমে সারা বিশ্বে গণতান্ত্রিক ধারা ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। আসলে তারা যেভাবে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে ধারণ, চর্চা ও লালন করে, তা সত্যিই প্রশংসার দাবিদার এবং অন্যদের জন্য অনুকরণীয় দৃষ্টান্তও বটে। আসলে ব্রিটেনের গণতন্ত্রের সৌন্দর্য ও আভিজাত্য এখানেই এবং বিভিন্ন দেশে যারা বছরের পর বছর ক্ষমতা কুক্ষিগত রাখে বা রাখতে চায়, তারা ব্রিটেনের গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা থেকে অনেক কিছু শিখতে ও চর্চা করতে পারে।

লেখক: ব্যাংকার ও কলামিস্ট

নয়াশতাব্দী/এমএস

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ