নিত্যপণ্যের বাজারে অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি এবং কৃত্রিম সংকটের মাধ্যমে অস্থিরতা তৈরির অভিযোগে প্রাণ, স্কয়ার, এসিআই, আকিজ, সিটি গ্রুপ, মেঘনা, ইউনিলিভার, বসুন্ধরা ও এস. আলম গ্রুপসহ ১১ ব্যক্তি ও ৩৬ কোম্পানি এবং ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে ৪৪টি মামলা করেছে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন (বিসিসি)। ২২ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার কমিশন সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে, যা বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছে। চাল, আটা, ময়দা, ডিম, মুরগি টয়লেট্রিজ পণ্য বিক্রির ক্ষেত্রে অতি মুনাফার প্রমাণ পায় বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন। অভিযোগ নির্দিষ্ট করে এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে গত ২২ সেপ্টেম্বর। মামলা দায়ের করলেও অভিযুক্তদের সম্পূর্ণ নামের তালিকাটি ২৬ সেপ্টেম্বর প্রকাশ করেছে কমিশন। কমিশনের তথ্যমতে, অভিযুক্তরা বাজারে চাল, আটা, ময়দা, ডিম, ব্রয়লার মুরগি, টয়লেট্রিজ ইত্যাদি নিত্যপণ্যের কৃত্রিম সংকট তৈরির মাধ্যমে বাজারে অস্থিরতা তৈরি করেছে। যার ফলে পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে। যেসব কোম্পানি এবং ব্যক্তি নিত্যপণ্যের বাজারে সংকট ও অস্থিরতা তৈরি করে হাজার হাজার কোটি টাকা ভোক্তাদের পকেট কাটিং-মারিং করে নিজেদের পকেট ভরেছে, এদের বিরুদ্ধে সরকার ব্যবস্থা নিচ্ছেন না কেন? এদের হাত কি সরকারের চেয়েও লম্বা। নাকি, এরা সারাজীবন গরিবের পকেট মেরে যাবে। বাজার অস্থিতিশীলকারী এই সব রাঘব-বোয়ালরা বিচারের আওতায় না এলে মানুষ নির্ভর করবে কার ওপর?
লক্ষ্য করার বিষয় এটাই যে, বাই বর্ন পলিটিশিয়ানরা ক্রমশ রাজনীতি থেকে দূরে গেলে ব্যবসায়ীরা রাজনীতিতে আসে। কাকতালীয় ঘটনা হলেও তারপর থেকেই নিত্যপণ্যের দাম বাড়তে থাকে। ভোক্তারা কল্পনাও করতে পারেনি ব্যবসায়ী মন্ত্রীদের আমলে সাড়ে তিনশত টাকা দিয়ে এক কেজি পেঁয়াজ কিনে খেতে হবে। আসলে যা হওয়ার তাই হয়েছে। তাহলে সাধারণ মানুষ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে?
চাল, ডাল, তেল, নুন, পেঁয়াজ, মরিচ— সব জিনিসের দাম আকাশছোঁয়া। ফলে সর্বস্তরের সাধারণ মানুষ বুঝে উঠতে পারছে না এর শেষ কোথায় বা সামনে কী হবে? করোনার অভিঘাত কাটিয়ে উঠতে পারেনি মানুষ কিন্তু বাজার অস্থির। জিনিসপত্রের দাম এভাবে বাড়লে মানুষ চলবে কেমনে? এ অবস্থায় সাধারণ মানুষ চেয়ে আছে সরকারের দিকে। কিন্তু সরকার সবই পারে, শুধু বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার কোনোভাবেই সাফল্য আনতে পারছে না। তাহলে কি আমরা ধরে নেব যে বাজার নিয়ন্ত্রণ যে সিন্ডিকেট করে তাদের হাত সরকারের চেয়ে বড়? সেটা কি আসলে সম্ভব? ঝড়, বন্যা, মহামারি সবই সামাল দিয়েছে এই সরকার। জঙ্গি দমনেও সরকারের সাফল্য বিশাল। গার্মেন্টস সেক্টরে পুরোদমে উৎপাদন চলছে। হাইওয়েগুলো চার থেকে ছয় লেন হচ্ছে, মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেস, নদীর তলের ট্যানেল এমনকি অসম্ভবের পদ্মা সেতুর সুবিধা নিয়ে উন্নয়নের আলোয় জেগে উঠছে দক্ষিণ জনপদ। ‘বাজার’ নিয়ন্ত্রণ কি এর চেয়ে কঠিন? এই প্রশ্নের উত্তর কোনো যুক্তিতেই গ্রহণযোগ্য নয়। সরকার বলছে বাজারে পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে। চাল, ডাল, আদা, রসুন, পেঁয়াজ, মরিচ, তেল, নুন, কোনো কিছুর অভাব নেই। তাহলে দাম বাড়বে কেন? সরকার হুঁশিয়ারি দেয়, অভিযান চালায়। তাতে জিনিসপত্রের দাম কমে না। বরং প্রতিনিয়ত বাড়ে। দেশীয় ও বহুজাতিক কোম্পানি যে যেভাবে পারে বাজারকে অস্থির করছে। এবারে দেশের শীর্ষস্থানীয় কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে নিত্যব্যবহার্য পণ্যের বাজারে ‘অস্থিরতার’ অভিযোগে দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগোষ্ঠী ৩৬ কোম্পানি ও ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে মামলা করেছে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন।
এ প্রসঙ্গে প্রতিযোগিতা কমিশনের সচিব মো. আবদুস সবুর বলেন, বিভিন্ন অভিযোগে চাল, আটা, মুরগির মাংস, ডিমসহ বিভিন্ন পণ্যের উৎপাদন ও বাজারজাতকারী ১১ ব্যক্তি ও ৩৬ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। আইন অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
১১ ব্যক্তি ও ৩৬ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা প্রসঙ্গে ভোক্তাদের অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, ‘শুধু মামলা হলে বা শুনানিতে ডাকলেই হবে না। কী ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে, সেটাই বড় কথা। আমরা চাই যারা মানুষের পকেট থেকে বাড়তি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে, তাদের যথাযথ শাস্তি হোক। আর যেন কেউ কারসাজি করে বেশি দামে পণ্য বিক্রি করতে সাহস না পায়। ‘ভোক্তাদের স্বার্থে প্রতিযোগিতা কমিশন তো এত দিন কিছুই করেনি। এই প্রথম বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা করল। এখন দেখতে হবে, কত দ্রুততার সঙ্গে মামলাগুলোর নিষ্পত্তি হয়। আইনানুযায়ী কাদের বিরুদ্ধে কী ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয়। আমাদের দেশের সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় দেখা যায়, একেকবার এক একদল রাঘব-বোয়ালের বিরুদ্ধে সবাই সোচ্চার হয়। তারপরে কীভাবে সব শূন্যে মিলিয়ে যায়। এদেশের মানুষের আশা-প্রত্যাশা রাষ্ট্রের কাছে খুব বেশি নয়। মধ্যযুগের কবি ভারত চন্দ্র রায় গুনাকর বলেছিলেন, ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে।’ কত কম প্রত্যাশা একজন সাধারণ মানুষের। একজন সাধারণ মানুষের চাওয়া চাট্টি গরম ভাত। কিন্তু সাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস লিখলেন ‘দুধ ভাতে উৎপাত’। তার মধ্যে আমরা দেখলাম সমাজের বৈষম্য ও শ্রেণি দ্বন্দ্ব। সমাজে শোষক শ্রেণি এত তৎপর যে অধিকাংশ মানুষের অধিকার ভোগ করে কিছুসংখ্যক মানুষ। সরকার যাদের হাত থেকে বাজার মুক্ত করে মেহনতি মানুষের মুখে খাবার তুলে দিতে পারছে না। কমিশনের দেয়া তথ্যানুযায়ী, চাল, আটা, ময়দার বাজারে অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির জন্য এসব কোম্পানির বিরুদ্ধে মামলা করেছে প্রতিযোগিতা কমিশন। খোলাবাজারে চালের দোকান এসব কোম্পানির কাছে জিম্মি। কারণ চাল, আটা উৎপাদনের ক্ষেত্র এসব কোম্পানির হাতে।
বাজার ব্যবস্থা সরকারকে অস্থির করছে, এটা নতুন করে বলার কিছু নেই। এই মুহূর্তে যেসব কোম্পানির বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে তা খতিয়ে দেখে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া দরকার। দেশের সাধারণ মানুষের পকেট কেটে যারা মুনাফা লুটে নেয় তাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার বিকল্প নেই। যদি সত্যিই এদের উপযুক্ত শাস্তি হয়, তাহলে বাজারে একটা ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। অন্যরা ভয় পাবে, অযৌক্তিকভাবে ইচ্ছামতো আর পণ্যের দাম বাড়াবে না। দেশের সাধারণ জনগণ প্রতিযোগিতা কমিশনের এই মামলা করাকে ইতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখছে। যদি সত্যিই এদের উপযুক্ত শাস্তি হয়, তাহলে সাধারণ জনগণ কমিশনকে সাধুবাদ জানাবে। দেশের মানুষ স্বস্তি পাবে।
লেখক: সাংবাদিক
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ