আগস্ট মাস এলেই আমরা শোকের মাস বলে মাতম করি। শোক কতটা জানি না, তবে এটা এখন নিয়মে পরিণত হয়ে গেছে। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ সরকারে আছে আর বেশ কিছু বছর থাকায় এখন এটা এমন ভাবে পালনের ধুম যাতে শোকের চাইতে শক্তি বেশি বলে ভ্রম হয়। আমরা সে যুগের মানুষ যে যুগে বঙ্গবন্ধু ছিলেন চার জাতীয় নেতা।
আমি তরুণ বয়সে বিস্ময় ও বেদনার সঙ্গে দেখেছি বঙ্গবন্ধুর শোকাবহ মৃত্যুতে ব্যথিত জাতি কতটা হতবিহ্বল আর ভীত হয়েছিল। ভালো করে একটা মিছিল পর্যন্ত হয়নি। এ কথা স্বীকার করতেই হবে সে সময় আওয়ামী লীগ বাকশাল নামে দেশ শাসনে ছিল। অথচ কোনো বাহিনী এগিয়ে আসেনি। বহু বছর পর ইতিহাসের নিয়মে আমরা জেনেছি জেনারেল জিয়াউর রহমান থেকে এরশাদ পরবর্তীকালের সব শাসকের ইন্ধন ছিল ঘটনায়। কেউ কেউ রেখেছিল সরাসরি অথবা নেপথ্য ভূমিকা।
আজ যখন তিনি আপন মহিমায় আর রাষ্ট্র মিডিয়ায় প্রচারের কারণে অনেক বেশি আবির্ভূত তখন একটা প্রশ্ন জাগে, কেন আমরা সবাই মিলে এখনো তাকে মানতে পারি না? একদল মানুষ থাকে যারা সব দেশে সব জাতিতে গাদ্দার বা মিরজাফর নামে পরিচিত। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ বা সমাজে এদের দালালি কিংবা দেশবিরোধী ভূমিকা হয় ঘৃণ্য।
মানুষ তাদের ঘৃণা করে। তাদের সমাজচ্যুত করে। আমাদের সমাজে অল্প কয়েক বছর আড়ালে থাকলেও এরা ফিরে এসেছিল। আর তাদের এই ফিরে আসার মাশুল দিয়েছে জাতি, দিয়েছে দেশ। তারা এমনভাবে বদলে দিয়েছিল সব কিছু এমন কি ইতিহাসও যাতে ধরে নেয়া হতো আর কোনো কালে আওয়ামী লীগ দেশ শাসনে নাও আসতে পারে। আর বঙ্গবন্ধুও চার নেতা থেকে যাবেন কুয়াশার আড়ালে।
মানুষ এ কুয়াশা সরিয়ে জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করেছে। শেখ হাসিনা শাসনে দ্বিতীয়বার আসার পর বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার করে সাজা দিয়েছেন। যুদ্ধাপরাধীদেরও বিচারে সাজা হয়েছে। কিন্তু মানুষের মনের ময়লা দূর হয়নি। কিছু মানুষ বলাটা সান্ত¦Íনার হতে পারে, আসলে এক বিশাল অংশ আজো ইতিহাস বিমুখ। এদের কারণে আর সময়ের চাহিদায় সরকারি দলে ঘাপটি মেরে থাকা আওয়ামী লীগারদের অনাচার ঠেকাতে হবে।
সরকারের ক্লিন ইমেজ আর ভাবমূর্তির সঙ্গে জড়িয়ে আছেন আমাদের মহান নেতা বঙ্গবন্ধু। তাকে ভালোবাসলে এদের নির্মুল করা জরুরি। আর কিছু কাজ যা করতেই হবে তা কিন্তু এখনো হয়নি। আন্তর্জাতিক মহলে যেমন প্রচার দরকার তেমনি দেশেও খালি আইন করে এসব করা যাবে না। কাজের কাজ হলো নিজেদের আত্মশুদ্ধি। নিজেরা আইডল আদর্শ হতে পারলে মানুষ আপনি ঝুঁকে পড়বে। বঙ্গবন্ধু যতদিন ছিলেন বাংলাদেশ পথ হারায়নি। এই পথ হারানো বিষয়টা আসলে কী? এটা বোঝার জন্য বঙ্গবন্ধু পরবর্তী বাংলাদেশকে দেখলেই বোঝা সম্ভব। একের পর এক সরকার আর চেতনা হননে দেশ হয়ে উঠেছিল ভয়াল। সামাজিক পরিবেশও ছিল ভয়াবহ। এই মহানায়ককেও আমরা একত্রে মানি না। অপরাজনীতির অপকৌশলে তিনিও বিতর্কিত। সাধারণ মানুষ এই বিতর্কে না থাকলেও অপরাজনীতি তাকে ছাড় দেয়নি।
এই দুর্ভাগ্য আমাদের এখনো ছাড়েনি। অথচ আজ আমরা এই নেতার একশতম জন্মদিন পেরিয়ে এসেছি। দেশের বয়সও ৫০। আর কতকাল লাগবে ঐকমত্যে পৌঁছাতে? দুনিয়ার কোনো দেশে এমন বিতর্ক নাই। আধুনিক তুরস্কের জনক নামে পরিচিত কামাল বিন আতার্তুক। আতার্তুক শব্দের অর্থই জনক। সে তুরস্ক আজ বহু জায়গায় বহু কারণে পরিবর্তিত। কিন্তু এই নিয়ম পাল্টায়নি। এবং তাকে নিয়ে কারো কোনো খেদ বা অশ্রদ্ধা দেখি না। গান্ধী জিন্নাহকে নিয়েও তাদের দেশের জনগণ সন্তুষ্ট। গোলমাল খালি আমাদের বেলায়।
কেন এবং কি কি কারণে সে কথা থাক। অন্তত এই একজন মানুষের বেলায় কি আমরা এক হতে পারি না? আর কতদিন এই বিবাদ? কত পানি গড়াল কত দেশ আবার ভাঙল গড়ল আমরা এই বিষয়েও সহমত হতে পারলাম না। নেতা যদি কেউ থাকেন তো তিনি একজনই। তাকে বাদ দিয়ে এদেশের ইতিহাস মুক্তি কিংবা সংগ্রাম ইতিহাস কিছু হয় না।
হবে না। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস উহ্য থাকার পরও সূর্যের আলোর মতো তিনি ছিলেন মাথার ওপর। তার এক ভাষণে লেজ গুটিয়ে পালিয়ে যাওয়া ভীতু পাকিরা নির্বিচারে গণহত্যা করার পরও বাঙালি দমেনি। তাদের বুকের ভেতর অভয় বাজাত এই ভাষণ। সে মানুষটিকে পাকিস্তান আমেরিকা চীনের আঁতাত ও মারতে পারেনি। মারা সাহস করেনি।
অথচ আমরা বাঙালিরা তা করেছি। মানুষের জন্য, বাঙালির মুক্তির জন্য, স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে না পারা মানুষটি কি এমন হত্যার শিকার হবার কথা? না এটা ন্যায়? অথচ এই কালো দিন, এই অন্যায় নিয়েও রাজনীতি হয়েছে। রক্তমাখা কেক কেটে জন্মদিন পালনের ভয়াল সংস্কৃতি আপাতত চাপা পড়ে আছে। কিন্তু সুযোগ পেলে মাথা চাড়া দেবে না, তার কোনো গ্যারান্টি আছে কি?
আওয়ামী লীগ মুখে যা বলুক তাদের দেখে মনে হয় না, তারা এ কাজ করতে পারবে। কারণ সরকারে থাকতে থাকতে তারা অন্যভাবে ব্যস্ত। রাজপথ ও মাঠের নেতা বঙ্গবন্ধু তাদের আদর্শ হতে পারে কিন্তু তাকে যতটা চর্চা করা দরকার, তাকে যতটা নিতে পারলে তিনি সবার হবেন তার দেখা নাই। অথচ দেশে, দেশের বাইরে বাঙালি বাংলাদেশবিরোধী শক্তি তৎপর। আমরা মানি আর না মানি মুক্তিযুদ্ধের সময় বিরোধিতাকারীরাও এখন নতজানু।
একাত্তরের পুরো সময় ধরে আমাদের বিরোধিতাকারী আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি বলেন, সহিংস ও কাপুরুষোচিতভাবে বাংলাদেশের জনগণের মাঝ থেকে এমন প্রতিভাবান ও সাহসী নেতৃত্বকে সরিয়ে দেয়া কী যে মর্মান্তিক ঘটনা!
দীর্ঘকাল বিদেশে বসবাস করার কারণে নানা দেশে যেতে হয়েছে। উপমহাদেশে রাজনৈতিক নেতা গান্ধী ব্যতীত কাউকেই তেমন চেনেন না সাধারণ মানুষ। শুধু বাংলাদেশ বললেই প্রবীণ মানুষরা বলেন, ও হো তোমরা না শেখ মুজিবকে মেরে ফেলেছিলে? কেউ কেউ এই সেদিনও বলতেন এই কাজের জন্য তোমরা অভিশপ্ত। অস্ট্রেলিয়ায় শায়িত বীর মুক্তিযোদ্ধা ডাচ অস্ট্রেলিয়ান বীরপ্রতীক ওডারল্যান্ড বঙ্গবন্ধু হত্যার পর বাংলাদেশের কথা বললেই রেগে যেতেন। তার কথা ছিল : এ কারণেই কি আমি যুদ্ধ করেছিলাম জানবাজি রেখে?
নেতা বেঁচেছিলেন মাত্র ৫৫ বছর। কিন্তু শতবর্ষেও তিনি গৌরবদীপ্ত এক মহানায়ক। এখন আমাদের সবার কাজ, সবার দায়িত্ব তাকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে একক নেতা ও জাতির জনক হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত করা। আমরা যেন সরকারের তরফ থেকে সে কাজের সূচনা দেখতে পাই।
এই দেশ, এই জাতিকে ভালোবেসে পরিবার-পরিজনসহ নিহত আমাদের মহান নেতাকে নিয়ে বাণিজ্য বন্ধ হোক। শুরু হোক তার পরিমিত ব্যবহারে অপরিমেয় উন্মোচন।
লেখক : প্রবাসী সিনিয়র সাংবাদিক
নয়া শতাব্দী/এসএম
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ