ঢাকা, শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

মাছের রাজধানী চিলমারীতেই হোক কুড়িগ্রাম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়

প্রকাশনার সময়: ৩১ মে ২০২২, ১৪:৩৮

গত বছরের ২৮ জুন ‘কুড়িগ্রাম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় বিল-২০২১’ জাতীয় সংসদে উত্থাপিত হয়। যাচাই-বাছাই ও আলোচনা শেষে একই বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি বিলটি সংসদে উত্থাপন করলে কণ্ঠভোটে পাস হয় এবং ২২ সেপ্টেম্বর তা গেজেটভুক্ত হয়।

গতবছর ২৬ এপ্রিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ থেকে জারি করা এক আদেশে চার বছরের জন্য ময়মনসিংহ অবস্থিত বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফসল ও উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান এ কে এম জাকির হোসেনকে কুড়িগ্রাম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ৮মে তিনি উপাচার্য হিসেবে দাপ্তরিক কাজ শুরু করলেও এখনো নিশ্চিত করা হয়নি কুড়িগ্রাম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী ঠিকানা।

চিলমারীর ৫ বারের নির্বাচিত উপজেলা চেয়ারম্যান, মুক্তিযুদ্ধের জীবন্ত দলিল শওকত আলী (বীর বিক্রম), উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মাহবুবুর রহমান, চিলমারী উপজেলা ছাত্রলীগ এবং জনসাধারণের দাবি মাছের রাজধানী চিলমারীর মাটিতেই হোক গবেষণা নির্ভর কুড়িগ্রাম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী ঠিকানা।

শিক্ষায় পিছিয়ে পড়া জেলাগুলোর মধ্যে কুড়িগ্রাম অন্যতম। চরাঞ্চল বেষ্টিত চিলমারী, রৌমারী, রাজিবপুরসহ ৯টি উপজেলার সমন্বয়ে কুড়িগ্রাম জেলা।

কুড়িগ্রাম জেলা সদর থেকে মাত্র ৩০ কি.মি দক্ষিণে ব্রহ্মপুত্র নদীর মোহনায় অবস্থিত চিলমারী উপজেলা। ২২৪.৯৭ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের চিলমারী উপজেলায় লোকসংখ্যা প্রায় এক লাখ ৩৯ হাজার ৪৯২ জন। চরাঞ্চল হলেও শিক্ষিতের হার পুরুষ ৬০.১১%, মহিলা ৩৯.৮৯%। কৃষি আবাদযোগ্য জমি ৯ হাজার ৮৩০ হেক্টর। চরের প্রায় অর্ধেক মানুষ মাছ ধরে বিক্রি করতে অভ্যস্ত হলেও এখানকার মানুষের প্রধান পেশা কৃষি। এখানে কৃষি পরিবার ১৭ হাজার ৭৪৬টি।

হিন্দু সম্প্রদায়ের তীর্থস্থান ও ভাওয়াইয়া সম্রাট কিংবদন্তীতুল্য শিল্পী আব্বাস উদ্দিনের ‘ওকি গাড়িয়াল ভাই, হাঁকাও গাড়ি তুই চিলমারীর বন্দরে’ গানের এই উপজেলায় ফলে সব ধরনের ফসলেই। ধান, পাট, সরিষা, কলাই, বাদাম, তিশি, যব, ভুট্টা, রসুন, পিঁয়াজ এমন কোনো ফসল নেই, যা ফলে না চিলমারীতে।

কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় শুধু বিষয়ভিত্তিকই না, অঞ্চলভিত্তিকও বটে। অর্থাৎ কৃষিই শুধু তার গবেষণার বিষয় নয়; এ অঞ্চলের অসংখ্য নদ-নদী, খাল-বিল তার মধ্যকার মাছ, শুশুক, কাছিম-পাখি, অণুজীব ও খনিজ সম্পদ গবেষণার বিষয়। এমনকি শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, ইতিহাস, অর্থনীতি ও যোগাযোগ ব্যবস্থাও।

কুড়িগ্রামের বৈচিত্র্যময় কৃষি মূলত চিলমারী কেন্দ্রীক। কুড়িগ্রামের ৯৮ শতাংশ চরই চিলমারীর ব্রহ্মপুত্রে। সেগুলো আবার চিলমারী, রৌমারী ও রাজীবপুরকেন্দ্রিক। গোটা দেশের মধ্যে সবচেয়ে সুস্বাদু বাদাম ‘চিলমারীর বাদাম’ বলে বিখ্যাত। ইস্টার্ন বেঙ্গল অ্যান্ড আসাম ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ারস: রংপুর ১৯১১-তে বলা হচ্ছে, পুরো প্রদেশের সমতল অংশের মধ্যে এখানে সবচেয়ে বেশি বৈচিত্র্যময় মাছ পাওয়া যায়। কয়েক ধরনের কার্প মাছ পাওয়া যায়। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো রুই, কাতলা, মৃগেল, চান্দা, চেলা ও পুঁটি। মসৃণ ও তৈলাক্ত চামড়ার মাছের মধ্যে আইড়, বাগাড়, পাঙাশ, বাচা, রিটা ও ট্যাংরা। এ ছাড়া পাওয়া যায় বেলে, পাবদা ও শিঙ্গি। বিখ্যাত ইলিশের একটা জাত মাঝেমধ্যে ব্রহ্মপুত্রে ধরা পড়ে। এখন পর্যন্ত সর্বাধিক মাছ চিলমারীতেই ধরা পড়ে। গোটা উত্তরবঙ্গে নদীর মাছের রাজধানী চিলমারীকে বলা হয়।

ডব্লিউ ডব্লিউ হান্টার ১৮৭৬ সাল তার স্ট্যাটিস্টিক্যাল অ্যাকাউন্ট অব বেঙ্গলের রংপুর অংশে মসুর, খেসারি, তিন ধরনের মুগ ডাল—সোনা মুগ, কৃষ্ণ মুগ ও ঘোড়া মুগ, মাষ-কড়ি-বোড়া-কুন্তি কালাই, ধলা বুট, লাল বুট, মটরশুঁটি, মসুর ও অড়হড়ের উল্লেখ করেছেন। দুই ধরনের তিল—কৃষ্ণ ও আউশ। কয়েক জাতের ঝাল মসলার উল্লেখ করেছেন এবং যত ধরনের পাখি ও সরীসৃপের কথা উল্লেখ করেছেন, সব কটির চারণভূমি হিসেবে ব্রহ্মপুত্র বিধৌত চিলমারীর কথা উল্লেখ করেছেন।

কয়েক’শ জাতের ধান ও মাছ এই ব্রহ্মপুত্রের পাওয়া যায়। যেসব ধান বিলুপ্ত হয়েছে বলে শোনা যায়, তাও মাঝেমধ্যে মেলে চিলমারীর ব্রহ্মপুত্রের চরেই। শিক্ষায় পিছিয়ে থাকলেও প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলছে চিলমারী।এখানে আছে রেডিও চিলমারী (৯৯.২ মেগা হার্জ), আছে স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেল-৬৯। চিলমারীর ওপাড়েই ব্রহ্মপুত্রের মুক্তিযুদ্ধের ‘প্রাকৃতিক জাদুঘর’ মুক্তাঞ্চল রৌমারী।

কুড়িগ্রাম জেলার অন্যান্য উপজেলার তুলনায় চিলমারীতে জমির দাম তুলনামূলক কম। এখানে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হলে তৈরি হবে উচ্চ শিক্ষার পরিবেশ, বাড়বে উচ্চ শিক্ষার আগ্রহ ও শিক্ষিতের হার, তৈরি হবে গণসচেতনতা, কমবে শিক্ষার্থীদের ঝড়ে পড়া ও বাল্যবিবাহের হার।একসময়ের আমদানি-রপ্তানি কেন্দ্রীক প্রাচীন বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসাবে পরিচিত চিলমারী নদী বন্দর ফিরে পাবে প্রাণ। বাংলাদেশের সবচেয়ে দরিদ্রতম এই চিলমারীতে তৈরি হবে হাজারো কর্মসংস্থান। দুঃখ মুচবে হাজারো বাসন্তীর। ক্ষুধা, দারিদ্রতামুক্ত বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ বিনির্মাণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় চিলমারীতে কুড়িগ্রাম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন হতে পারে উন্নয়নের সারথি। পিছিয়ে পড়া চিলমারীও হতে পারে উন্নয়নশীল বাংলাদেশের অংশ।

এ ছাড়া একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস এমন একটি জায়গায় হওয়া উচিত, যাতে রেল, নৌ, সড়কসহ সব ধরনের যোগাযোগের স্টেশনগুলো ক্যাম্পাসের চারদিকে থাকে। চিলমারীর পেদী খাওয়ার বিল এমন একটি উপযুক্ত জায়গা, যে বিলের উত্তর মাথায় বাসস্ট্যান্ড, দক্ষিণ মাথায় রমনা রেলস্টেশন এবং পূর্ব প্রান্ত ধরে ব্রহ্মপুত্র আর এক কিলোমিটার দক্ষিণে চিলমারী বন্দর। সহজে পারাপারের জন্য চিলমারী থেকে গাইবান্ধার হরিপুর উপজেলায় তৈরি হয়েছে ব্রিজ। ক্যাম্পাসের সুউচ্চ হলগুলোর ছাদে দাঁড়ালেই আসাম আর মেঘালয়ের পাহাড় শ্রেণির আহ্বান আর কোথায় পাওয়া যাবে? এ রকম যোগাযোগ ও ভূসৌন্দর্যের অধিকারী ক্যাম্পাস বাংলাদেশে আর কোথায়? এমনি তো আর হাজার বছর ধরে চিলমারী তীর্থ হয়ে ওঠেনি!

লেখক : শিক্ষার্থী স্থানীয় সরকার ও নগর উন্নয়ন বিভাগ জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়

নয়া শতাব্দী/এসএম

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ