ঢাকা, রোববার, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১, ১৮ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

বায়ুদূষণে বিপর্যস্ত বিশ্ব

প্রকাশনার সময়: ২৮ মে ২০২২, ১০:৪১

পৃথিবীটা ধ্বংস হচ্ছে মানুষের কারণে। নানাভাবে দূষণ হওয়া এর মধ্যে অন্যতম। বায়ুদূষণ, পানিদূষণ, মাটিদূষণ, শব্দদূষণ এবং আলোদূষণ। প্রতিটি দূষণই মানুষ ও অন্যান্য জীবের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর এবং প্রতি বছর প্রাণহানিসহ বিভিন্নভাবে মানুষের ক্ষতি করছে। দূষণের যে কয়েকটি রূপ এখন পৃথিবীকে ভোগাচ্ছে বা দুশ্চিন্তায় ফেলছে, তার মধ্যে অন্যতম হলো বায়ুদূষণ। এর প্রধান কারণ এই যে, প্রতিটি সেকেন্ডে বাতাস আমরা শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে গ্রহণ করছি এবং তার চেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার হলো এই বাতাস হলো দূষিত বা ক্ষতিকর। এটা জানা সত্ত্বেও আমাদের কিছুই করার নেই। কারণ এর জন্য কোনো একক ব্যক্তি বা দেশ বা মহাদেশ দায়ী নয়। এর জন্য সমগ্র মানব জাতিই কম-বেশি দায়ী। যদিও বায়ুদূষণের তীব্রতা সব দেশে বা শহরে সমান নয়। গ্লোবাল বারডেন অব ডিজিস নামে যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটনের চলমান গবেষণায় বিশ্বজুড়ে বায়ুদূষণ পরিস্থিতি ও বায়ুদূষণের কারণে কত মানুষের মৃত্যু ঘটছে সেই হিসাব করা হয়। সম্প্রতি বিজ্ঞানীদের করা এক গবেষণায় জানা যায়, বিশ্বে নানারকম দূষণে প্রতি বছর প্রায় ৯০ লাখ মানুষ মারা যায়। বায়ু ও বিষাক্ত বর্জ্যের দূষণে পরিবেশ দূষিত হয়ে ২০১৫ সাল থেকে প্রতি বছর এই পরিমাণ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, ২০০০ সালের তুলনায় এখন গাড়ি, ট্রাক ও শিল্প থেকে বায়ুদূষণের মাত্রা ৫৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৯ সালে শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই দূষণের কারণে ১ লাখ ৪৩ হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। জানা গেছে, দূষণে সব থেকে বেশি মানুষের মৃত্যু হয় ভারত ও চীনে। দুই দেশে বছরে ২৪ লাখ মানুষ মারা যায় নানারকম পরিবেশ দূষণে। পৃথিবীর কিছু শহরে তা মোটামুটি খারাপ মাত্রায় পৌঁছে গেছে। এখনই এর সমাধান সম্ভব না হলে, তা বসবাসের অনুপযুক্ত হয়ে উঠতে পারে। কারণ, বুকভরে শ্বাস নেয়া ছাড়া কেউ কোনো শহরে থাকতে পারে না। সম্প্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এ নিয়ে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে। সেখান থেকে জানা যায়, বিশ্বের প্রায় ৭৫০ কোটি মানুষ এখন দূষিত বায়ু গ্রহণ করছে। জলবায়ু সংকটের কারণে ফুসফুসে নির্মল বাতাস পাওয়া একটি কষ্টসাধ্য বিষয় হয়ে উঠেছে। বিষাক্ত বাতাসে ভরে উঠছে পৃথিবী। শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ফুসফুসে জমা হচ্ছে দূষিত ক্ষতিকর পদার্থ। সম্প্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসের অনুষ্ঠানে বাংলাদেশে নিযুক্ত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিনিধি বর্ধন জং রানা এক তথ্যে জানান যে, বাংলাদেশে বায়ুদূষণের কারণে নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে বছরে প্রতি ১ লাখে ১৪৯ জন মারা যায়। বছরে মোট মৃত্যু হয় ২ লাখ ৪০ হাজার মানুষের। এছাড়াও জীবাশ্ম জ্বালানির কারণে বায়ুদূষণে বিশ্বে প্রতি বছর ৭ লাখ অপরিণত নবজাতকের মৃত্যু হয়। প্রতি মিনিটে মারা যান ১৩ জন। আমাদের গড় আয়ুও বায়ুদূষণের ফলে কমছে। বায়ুদূষণ নিয়ে এক বৈশ্বিক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।

প্রতিদিন বিনামূল্যে সেই বাতাস আমরা ফুসফুসে ভরছি। আর আমরা সেগুলো কেটে নিজেদের পায়ে নিজেরাই কুড়াল মেরেছি। আমাদের দেশের অবস্থা এখনো সে পর্যায়ে যায়নি। কারণ আমরা এখনো বিশুদ্ধ বাতাস নিতে কোনো নির্দিষ্ট জায়গায় ভিড় করছি না। তবে আমাদের রাজধানী ঢাকাও সেই পরিণতিতেই অগ্রসর হচ্ছে। সেই দিন হয়তো বেশি দূরে নয়, যেদিন একটু সময় বিশুদ্ধ বাতাস পেতে লাইন দিয়ে অপেক্ষা করতে হবে। দখল-দূষণে রাজধানী আজ বিপর্যস্ত। বাতাসে নানা ধরনের ক্ষতিকারক কণা আমাদের নিঃশ্বাসের সঙ্গে শরীরে প্রবেশ করছে। এসব বস্তু কণার মধ্যে প্রাণঘাতী কণা হলো বস্তুকণা ২.৫ যা অতি সুখ্যাতি সুক্ষ্ম। এটি মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে ঢুকে যায়। শহরে গাড়ি বাড়ছে, বাড়ছে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার। এই কণার অন্যতম উৎপত্তিস্থল হলো, জীবাশ্ম জ্বালানি। গত মার্চে ওয়ার্ল্ড এয়ার কোয়ালিটি রিপোর্ট ২০২০ অনুযায়ী, বাংলাদেশের বাতাসে এই বস্তুকণা ২.৫-এর পরিমাণ ৭৭.১ মাইক্রোগ্রাম পার কিউবিক মিটার যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ডের চেয়ে সাতগুণ বেশি। পরিচ্ছন্ন দেশ এবং পরিচ্ছন্ন নগরী গড়ে তুলতে সঠিক পরিকল্পনা প্রয়োজন। উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বৃদ্ধিও সঙ্গে সঙ্গে যদি পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি সাধন করে তবে তা মানুষের জীবন ধারণের জন্যই বুমেরাং হবে। অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠার সবচেয়ে বড় অসুবিধা হলো, এতে আমাদের প্রাণশক্তি গাছপালা কাটা যায় প্রচুর। রাজধানীর ক্ষেত্রেও এমনটা হয়েছে। আজ সেখানে কংক্রিটের নিষ্প্রাণ আস্তরণ। মুক্ত বাতাস নেয়ার মতো জায়গার অভাব সেখানে প্রকট। গাছ কেটে ফেলার পর তা আর লাগানো হয় না। ফলে শহরটা একসময় কেবল কংক্রিটের জঞ্জাল হয়ে পড়ে থাকে। যেখানে গাছপালা নেই সেখানে কীটপতঙ্গ-পাখি নেই, ফলে সেখানে প্রাণ নেই। শহরের পরিণতি হয় ক্রমশ নিষ্প্রাণ। এই নিষ্প্রাণ শহর হওয়ার পরিণতি থেকে ঢাকাকে বাঁচাতে হবে। কিন্তু কীভাবে? কংক্রিটের জঞ্জাল সরিয়ে প্রচুর সবুজ বনায়ন করতে হবে।

বিশ্বের যেসব দেশের শতভাগ মানুষ মাত্রাতিরিক্ত বায়ুদূষণের মধ্যে বাস করছে, তার ওপরের সারিতে রয়েছে বাংলাদেশ। আর বলাই বাহুল্য যে, আমাদের দেশের অন্য শহরের তুলনায় রাজধানীর বায়ুদূষণের মাত্রা বেশি। ঢাকার বাতাসে মাত্রাতিরিক্ত ক্ষতিকর পদার্থ রয়েছে যা নিঃশ্বাসের সঙ্গে দেহের অভ্যন্তরে পৌঁছে নানা রোগের জন্ম দিচ্ছে। অথচ প্রতিদিন ঘর থেকে বের হয়েই বিষাক্ত বাতাস টানতে হচ্ছে এ শহরের মানুষকে। একদিকে ইট-কাঠের শহর থেকে গাছের সংখ্যা একেবারে কমে যাওয়া, অন্যদিকে ক্রমাগত বৃদ্ধি পাওয়া যানবাহনের ধোঁয়া, আশপাশের ইটভাটার ধোঁয়া এসব মারাত্মকভাবে বাতাসে ক্ষতিকর পদার্থের জন্ম দিচ্ছে। একসময় ঢাকার বাতাস যখন মানুষের অনুপযোগী হয়ে উঠবে তখন আমরা কী করব? এত কিছুর চেয়ে বরং সমস্যা সমাধানের দিকেই মনোযোগ দেয়া ভালো। বাতাসে যে কারণে আজ বিষ ঢুকে গেছে সেসব কারণ রোধ করতে হবে। আর অবশ্যই প্রচুর গাছ লাগাতে হবে। সেক্ষেত্রে ঢাকার প্রতিটি ছাদ বেছে নেয়া যেতে পারে। প্রতিটি ছাদেই যদি পরিকল্পনামাফিক বাগান তৈরি করা যায়, তাহলেও কিছুটা সমাধান সম্ভব। রাজধানীর অস্তিত্ব রক্ষার জন্য এবং মানুষের বসবাসের উপযুক্ত করে তোলার জন্য সঠিক পরিকল্পনা এবং তার বাস্তবায়নের কোনো বিকল্প আমাদের হাতে নেই। আমরা নিজেদের ভবিষ্যৎ সুরক্ষার জন্য কতকিছুই করতে পারছি। তবে প্রকৃতিকে কেন কাছে টানতে পারছি না। নিজেদের সর্বনাশ নিজেরাই করছি। প্রবাদে আছে, যে ডালে বসে আছি সেই ডালটিই যদি কেটে ফেলি তাহলে সেই ডালের সঙ্গে আমার মাটিতে অধঃপতিত হওয়া অবশ্যম্ভাবী। যে গাছপালা আমাদের বুক ভরে শ্বাস নিতে অক্সিজেন জোগাচ্ছে সেই গাছ কেটে অক্সিজেনের উৎস নষ্ট করলে আমাদের ধ্বংসও নিশ্চিত।

পরিবেশের সব উপাদান আজ দূষিত। মানব জীবনের সঙ্গে এসব উপাদানের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। পরিবেশের ভারসাম্য বিনষ্ট হলে তা মানব জীবনের ওপরও প্রভাব বিস্তার করে। প্রতিদিন প্রতিনিয়তই আমাদের মাটি, পানি ও বায়ুদূষিত হচ্ছে। আমরা যে নিঃশ্বাস নিচ্ছি তাতে ফুসফুসে জমা হচ্ছে বিষ। বিখ্যাত গায়ক নচিকেতার গানের সেই লাইনের মতো আমাদের অবস্থা’ নিঃশ্বাসে নিকোটিন জমা হয় প্রতিদিন’। আমাদের নিঃশ্বাসে কেবল নিকোটিন নয় বরং এর সঙ্গে সিসাসহ আরো মারাত্মক সব ক্ষতিকারক উপাদান জমা করছে। এসব বিষাক্ত উপাদান আমাদের শরীরে বহু রোগের জন্ম দিচ্ছে। প্রতিদিন কঠিন সব অসুখ নিয়ে আমাদের ডাক্তারের কাছে দৌড়াতে হচ্ছে। আমাদের দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্ধিত জনসংখ্যার জন্য প্রয়োজন হয় বর্ধিত আবাসনের। উন্নত দেশগুলোতে আবাসনব্যবস্থা পরিকল্পিত। কিন্তু আমাদের দেশের ক্ষেত্রে এমনটা দেখা যায় না। যার যেখানে ইচ্ছা জমি, বন উজাড় করে বাড়িঘর তৈরি করছে। বাতাসে নানা কারণে দূষিত ও ক্ষতিকর কণা মিশে যাচ্ছে। কলকারখানা, যানবাহন ও জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর কারণে এসব ক্ষতিকর ধোঁয়া বাতাসে মিশে বাতাস বিষাক্ত করে তুলছে। এসব ইমারত নির্মাণ করতে প্রতিদিন ক্ষতিকর কণা বাতাসে গিয়ে মিশছে। সেই বাতাস থেকে আমাদের ফুসফুসে স্থান পাচ্ছে। এভাবে এলোমেলো বাসস্থান তৈরি করার ফলে গত কয়েক দশকে আমাদের দেশে কমেছে গাছপালার পরিমাণ। কোনো দেশের আয়তনের তুলনায় শতকরা ২৫ ভাগ বনভূমি থাকার কথা থাকলেও আমাদের রয়েছে ১৭ ভাগ। সামাজিক বনায়ন কর্মসূচি থাকলেও তাতে বনভূমি খুব বেশি বৃদ্ধি পায়নি। তাছাড়া প্রতিদিন কোথাও না কোথাও গাছপালা কাটার কারণে বাতাসে কার্বনডাই অক্সাইডের মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু তা শোষণ করার মতো পর্যাপ্ত গাছপালা থাকছে না। ফলে ক্রমশই বিষাক্ত হয়ে উঠছে বাংলাদেশসহ গোটা দক্ষিণ এশিয়া। একসময় রাজধানী বা বড় বড় শহরগুলোতে বায়ুদূষণের মাত্রা আরো তীব্র হবে, তখন সেখানে বসবাস করা মানুষের উপায় কি হবে? মানুষ কি তখন বাঁচার তাগিদে গ্রামের দিকে ছুটবে? কিন্তু ততদিনে গ্রামও কি বায়ুদূষণ থেকে মুক্ত থাকবে? এভাবে বসবাসের অযোগ্য হতে হতে মানুষের নিরাপদ আবাসন পৃথিবীই বিষাক্ত বাতাসে ভরে উঠবে। একটু নির্মল বাতাস পেতে মানুষ তখন বৃক্ষ সারির খোঁজ করবে। মানুষ যে হারে গাছ কাটছে তাতে সেরকম কোনো নির্মল পরিবেশ আদৌ থাকবে তো? এতসব চিন্তা-ভাবনা করেই আমাদের নির্মল বাতাসের নগরী গড়ে তুলতে হবে। সুস্থ জীবনে বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা দিতে হবে। বুক ভরে যে শ্বাস নেই তাতে কোনো ক্ষতিকারণ কণা থাকবে না; এই নিশ্চয়তা দিতে হবে।

লেখক: শিক্ষক ও মুক্তগদ্য লেখক

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ