ঢাকা, শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১, ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

পদক যখন কৌতুক

প্রকাশনার সময়: ১৩ মে ২০২২, ০৮:২১

লেখার শুরুতেই মেরুদণ্ডী দুই বাঙালিকে জানাই ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বিশেষ সম্মান দিয়েছে বাংলা একাডেমি। তারই প্রতিবাদে ২০১৯ সালে পাওয়া অন্নদাশঙ্কর স্মারক সম্মান ফিরিয়ে দিলেন লেখিকা এবং গবেষক রত্না রশিদ বন্দ্যোপাধ্যায়। ২০০৯ সালে তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কারও পেয়েছিলেন। তবে শুধু ২০১৯ সালের স্মারক সম্মানই ফিরিয়ে দেয়ার কথা জানিয়েছেন রত্না।

পাশাপাশি, একই কারণে সাহিত্য একাডেমির বাংলা উপদেষ্টা পরিষদ থেকে ইস্তফা দিয়েছেন লেখক এবং সম্পাদক অনাদিরঞ্জন বিশ্বাস। বিবৃতি প্রকাশ করে অনাদি জানিয়েছেন, কলকাতায় রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তীর দিন কবিতাকে যেভাবে অসম্মান করা হয়েছে, তাতে তিনি ‘বিরক্ত’। সেই কারণেই তিনি ইস্তফা দিয়েছেন। আজকাল পুরস্কার পদক এসব বিষয়গুলো এমন এক জায়গায় পৌঁছে গেছে যেখানে আনন্দিত বা গর্বিত হওয়ার পরিবর্তে মানুষ থতমত খেতে বাধ্য হচ্ছে। আমাদের দেশের কথা না হয় বাদ দিলাম, ভাবতাম অতীত ঐতিহ্যে বলীয়ান ওপার বাংলায় অন্তত এমনটি হবে না। কিন্তু এটা মানতেই হবে মমতা ব্যানার্জীর খামখেয়ালিপনা আর উগ্রতায় ওপার বাংলার সবকিছু এখন রসাতলে যাওয়ার পথে। একটা বিষয় বলে নেয়া ভালো, মমতা কিন্তু জনগণের ভোটে নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রী। সেখানে ভোট নিয়ে কারচুপি বা জাল ভোটের অভিযোগ থাকে না এমন নয়, তবে সবমিলিয়ে ভোট হয়। মানুষ লাইনে দাঁড়িয়ে ভোট দেয়; এবং সে ভোটের বাক্সগুলো রাতে ভর্তি করে রাখার কোনো নিয়ম নেই। ভোটগুলো ঠিকভাবে গণনাও করা হয়। গণতন্ত্রের সে ধারায় মমতা নির্বাচিত নেতা। একের পর এক বিজয়ে বিশেষত গেলবার সাম্প্র্রদায়িক শক্তি নামে পরিচিত বিজেপিকে হারানোর কারণে তার পপুলারিটি অনেক চাঙ্গা; কিন্তু মুশকিল হচ্ছে সে চাঙ্গা তাকে একনায়কতন্ত্রের নায়িকা করে ফেলেছে। এমনিতেই তিনি কোনো স্টেজে বসতে পারেন না। যত সময় থাকেন দাঁড়িয়ে, তাও সুস্থির কিছু না। ঘড়ির পেন্ডুলামের মতো এদিক থেকে ওদিকে হাঁটতে থাকেন। মাঝেমধ্যে অন্যদের মুখ থেকে, হাত থেকে মাইক্রোফোন কেড়ে নিয়ে মাঝখানে কথা বলতেও দেখেছি। এসব কিন্তু মানসিক চিকিৎসকের ভাষায় এক ধরনের ডিসঅর্ডার। তবে একথা বলার বা শোনার সাহস ও ধৃষ্টতা নেই কারো।

বিস্ময়ের ব্যাপার এই শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের মতো নামি সর্বজন শ্রদ্ধেয় লেখক এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত। যুক্ত কবি শ্রীজাত ও জয় গোস্বামী। কলকাতার সঙ্গে আমার সম্পর্ক কৈশোর থেকে। আমাদের সবার চেনা-জানা দীর্ঘকালের। সমরেশ বসু, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সমপ্রতি প্রয়াত সৌমিত্র সবাই কোনো না কোনো রাজনৈতিক আদর্শের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সেসব কথা তাদের লেখায় এসেছে বারবার। উৎপল দত্ত বাম ঘরানার সেরা একজন অভিনেতা। নাট্য ব্যক্তিত্ব মৃত্যুর পর লাল পতাকা মুড়ে বিদায় চেয়েছিলেন তিনি; কিন্তু এদের কারো এমন স্খলন বা তোষামোদি দেখিনি। তবে কি যুগের এটাই নিয়ম? না এটাই এখন রীতি?

আমি যেটা বুঝতে চাইছি, এই ব্রাত্য বসু জাতীয় লোকেরা কী ভয় থেকে এসব করে, না হালুয়া রুটির লোভে? আমাদের দেশের পদকবাণিজ্য এখন মুখরোচক গল্প। টাকা-পয়সা খরচ না করলে এসব পাওয়া যায় না। আর এক শ্রেণি পায় তাদের দাপট আর পাওয়ার গেমে সরকারের কাছাকাছি বা প্রিয় হওয়ার কারণে। বছর বছর দু’-একজন ব্যতিক্রম থাকেন যারা মেধা বা পরিশ্রমের জন্য পুরস্কার পান। কিন্তু তারা হয় প্রয়াত: নয়তো বয়সের ভারে কাবু। একথা নিশ্চয়ই বলা যাবে না; মমতা টাকা খরচ করে পুরস্কার নিয়েছেন। দেখা যাবে তাকে দেয়ার জন্যই হয়তো টাকা-পয়সা খরচ করেছে খোদ বাংলা একাডেমি। এখানেই কিন্তু হিসাব চাকরি পদ, অর্থ আর মোহের কাছে পরাজিত শিল্পসাহিত্য ক্রমেই সেবাদাস হয়ে পড়ছে।

২৫ বৈশাখ উদযাপনের সরকারি মঞ্চ থেকে রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী এবং পশ্চিমবঙ্গ বাংলা একাডেমির সভাপতি ব্রাত্য বসু একটি বিশেষ পুরস্কারের কথা ঘোষণা করেন। তিনি জানান, শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিকদের মতামত নিয়ে এই পুরস্কার এ বছর দেয়া হবে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। প্রতি তিন বছর অন্তর ওই পুরস্কার দেয়া হবে বলেও জানিয়েছিলেন ব্রাত্য। মঞ্চে সেই সময় মমতা থাকলেও তার হয়ে ওই পুরস্কার নিতে দেখা যায় বাংলা একাডেমির সভাপতি ব্রাত্যকেই। এরপর বিভিন্ন মহলে আলোচনার কেন্দ্রে উঠে আসে মমতার এই পুরস্কার প্রাপ্তির ঘটনা। মঙ্গলবার বিকেলে জানা যায় রত্না এবং অনাদি, দু’জনেই এই পুরস্কার প্রাপ্তির প্রতিবাদ জানিয়েছেন।

মঙ্গলবার রত্না রশিদ জানিয়েছেন, যেভাবে বাংলা একাডেমি এই পুরস্কার ঘোষণা করেছে তার একটা প্রতিবাদ দরকার। তিনি বলেন, তিনি একজন মান্যগণ্য মানুষ। তিনি আমাদের সবার ভোটে জিতে মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন। তার কাছ থেকে পরিপক্ব সিদ্ধান্ত আশা করি। বইয়ের তো একটা স্ট্যান্ডার্ড (মান) থাকতে হবে। পুরস্কার দিলেই তিনি নিয়ে নেবেন কেন! রত্না তার একটি পদকও ফিরিয়ে দেবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন।

অন্যদিকে, আন্দামান থেকে অনাদি বাবু জানিয়েছেন, রবীন্দ্রনাথের জন্মদিনে বাংলা কবিতাকেই অসম্মান করেছে কলকাতা। তিনি বলেন, ছোটবেলা থেকে রবীন্দ্রনাথকে বুকের মাঝে রেখেছি। তার কবিতা আমার কাছে দুর্মূল্য। সেই কবির জন্মদিনে যদি এমন পুরস্কার দেয়া হয় কবিতার নাম করে, তা হলে তা সামগ্রিকভাবে কবিতাকেই অসম্মান করে। তারই প্রতিবাদে আমি সাহিত্য একাডেমির বাংলা উপদেষ্টা পরিষদ থেকে ইস্তফা দিয়েছি।

প্রশ্ন একটাই, বড় বড় নামি লেখক বা বুদ্ধিজীবীদের মুখে কুলুপ কেন? জিজ্ঞাসা যদি আপনারা ভয় বা প্রলোভনে মুখ না খোলেন, কলম না ধরেন মানুষ কেন আপনাদের কথা বিশ্বাস করবে? কেন পড়বে মন জাগানো মিথ্যা কথার উপন্যাস বা গল্প কবিতা? একদা আদর্শের পীঠভূমি নামে পরিচিত কলকাতার দৈন্য আমি আগেও দেখেছি। বিশ্বাস করুন ওদের স্তাবকতা ও চামচামি আমাদের হার মানায়। একবার দুর্গাপূজার সময় গিয়ে দেখি রাস্তার মোড়ে মোড়ে বিরাট হোর্ডিং ঝুলছে। হিন্দুরা দুর্গাকে মা মনে করেন। দুর্গা জননীর চোখ ফোটানোর একটা বিশেষ নিয়ম আছে। ওইসব হোর্ডিংয়ে আঁকিয়ে মমতা শিল্পী মমতা দিদি এক হাতে তুলি নিয়ে দেবীর কপালে যে তৃতীয় নয়ন তা ফোটাচ্ছেন, মানলাম। কিন্তু কি লেখা ছিল তাতে? লেখা ছিল জগজ্জননীর চোখ ফোটাচ্ছেন বঙ্গ জননী। এমন নানা উপায়ে কলকাতা কিন্তু ঢাকারও চোখ খুলে দিচ্ছে। রাস্তা পরিষ্কার করে দিচ্ছে। যেমনটা করল বাংলা একাডেমি পুরস্কারের নামে।

যারা রুখে দাঁড়ান বা সাহস করে বলেন, যেমন শ্রীলেখা মিত্রের কবিতা পাঠ তাদের সংখ্যা হাতে গোনা। জনগণ উভয় বাংলায় সেগুলো পছন্দ করে হাসতে হাসতে মারা গেলেও মুখ খোলে না। আর এই বন্ধ্যত্ব সাহিত্য সংস্কৃতি এবং পদক পুরস্কারকে ক্রমেই কৌতুকময় করে তুলেছে। এটাই ভয়ের।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, সিডনি প্রবাসী

নয়া শতাব্দী/এস

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ