ঢাকা, শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১, ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে নীতিমালা জরুরি

প্রকাশনার সময়: ০৭ মে ২০২২, ০৯:১৩

সারা পৃথিবীতে দানবের মতো অবিরাম ধ্বংসাত্মক তাণ্ডব চালিয়েছে করোনাভাইরাস। যা খালি চোখে দেখা যায় না। সময়ের পরিবর্তনে করোনাভাইরাস তার চেহারা পাল্টিয়েছে। ধনী থেকে গরিব কিংবা গাছতলা থেকে পাঁচতলা সব মানুষ করোনাভাইরাসের কাছে অসহায় হয়ে পড়েছিল। প্রকৃতিকে অত্যাচার করলে প্রকৃতি যে বিশ্রাম নেয় না বরং পাল্টা আঘাত করে তার প্রমাণ হিসেবে করোনাভাইরাস; কিন্তু আমরা মানুষ জাতি কি করোনাভাইরাস থেকে শিক্ষা নিতে পেরেছি। কখনো কি উপলব্ধি করতে পেরেছি প্রকৃতির প্রতি যত্মশীল হতে হবে। বিশেষ করে করোনা একেবারে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল আমাদের দেশের সমাজব্যবস্থায় শ্রেণিবৈষম্য যে কতটা প্রকট। আরো দেখিয়ে দিল, শহর ও গ্রামের মানুষের মধ্যে জীবনব্যবস্থার আয়োজন।

রাষ্ট্রযন্ত্র যতই উন্নয়ন, প্রবৃদ্ধি ও জিডিপির কথা বলুক না কেন, করোনা দেখিয়ে দিল আমাদের বেশিরভাগ মানুষ তার মৌলিক অধিকারগুলো থেকে বরাবর বঞ্চিত। আর স্বাস্থ্য খাতের অবস্থান তো বেহাল দশা। এখন করোনার দাপট কমেছে সত্য কথা; কিন্তু আমাদের দেশের মানুষ কি সুস্থ আছে? মানে সুস্থ বায়ু সেবন করতে পারছে? প্রশ্নের উত্তর বলতে গেলে উদ্বিগ্ন ও উৎকণ্ঠার সঙ্গে বলতে হয়। আমাদের দেশের পরিবেশ দূষিত হওয়ার কারণে মানুষ নানা বায়ুবাহিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। মানুষের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা দায়িত্ব কার? আমাদের সংবিধানে মৌলিক অধিকারের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ অধিকার হলো চিকিৎসা। অর্থাৎ জনগণের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব; কিন্তু দুঃখের বিষয় রাষ্ট্র যখন পুঁজিবাদীদের স্বার্থের সঙ্গে আঁতাত করে সাধারণ জনগণের চিন্তা করে না তখনই রাষ্ট্রকে নিয়ে প্রশ্ন তুলতে হয়, রাষ্ট্র তুমি কার? বড় বড় শিল্পকারখানা কে গড়ে তুলেন? বড় ইটভাটা কে তৈরি করেন? নিশ্চয় মোটাদাগে এদেশের পুঁজিবাদীরা।

তাহলে প্রতিদিন পরিবেশ দূষিত হওয়ার জন্যই তো এদেশের কৃষক, শ্রমিক, কামার-কুমার, তাঁতি-জেলে নয়, যারা এদেশের ১৭ কোটি মানুষকে শোষণ করে পুঁজির পাহাড় গড়ে তোলে তারাই দায়ী। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় যে, জয়পুরহাটে ইট প্রস্তুত ভাটা স্থাপন নিয়ন্ত্রণ আইন-২০১৩ কে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে কৃষিজমির পাশে চলছে ইটভাটা। আইনে পরিবেশের বাধ্যতামূলক ছাড়পত্র, পৌর এলাকায় ইটভাটা না করা, ইটভাটার জন্য মাটির সংস্থান নিশ্চিত করা, কৃষিজমি ও আবাসিক এলাকায় ইটভাটা তৈরি না করার শর্ত থাকলেও আইন অমান্য ও পরিবেশ অধিদফতরেরে ছাড়পত্র ছাড়াই উপজেলায় ১৩টি ইটভাটা তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। এতে করে ভাটা চালু ও বন্ধের আগে গরম বাতাসে ও গ্যাসে কৃষিজমিতে ফসল উৎপাদন হয় না।

ফলের বিভিন্ন উদ্ভিদে ফল ধরে না। ইট ভাটার আশপাশে বাসা বাড়িতে ধুলাবালি ও ছাই পড়ে রাতে ঘুমাতে কষ্ট হয় এই এলাকার মানুষের; কিন্তু প্রশ্ন হলো— জনগণের স্বাস্থ্যের সমস্যা কী প্রশাসনের নজরে আসে না? নজরে আসলেও কিছু করার থাকে না। ফলে এই চিত্র শুধু জয়পুরহাটে নয়, সারাদেশের চিত্র একই। মালিকরা ক্ষমতার দাপট খাটিয়ে দিনের পর দিন দেশকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাচ্ছে। পৃথিবীকে বসবাসের অযোগ্য করে তুলছে। তবে আমাদের জন্য দুঃখজনক খবর রাজধানী ঢাকার মানুষের আয়ু প্রায় সাড়ে সাত বছর কমেছে। এমন তথ্য নিশ্চিত করেছেন শিকাগো ইউনিভার্সিটির এনার্জি পলিসি ইনস্টিটিউট। পরিবেশ দূষণের প্রধান কারণ হলো যানবাহনের কালো ধোঁয়া, মিলকারখানা ও ইট ভাটার কালো ধোঁয়া ইত্যাদি। তবে পরিবেশ না থাকলে আমাদের সমাজে মানুষের কী কোনো অস্তিত্ব টিকে থাকবে?

না এক মুহূর্তও টিকে থাকতে পারব না। যার কারণে তো বুধ, শুক্র, মঙ্গল, বৃহস্পতি, শনি, ইউরেনাস ও নেপচুন নামক গ্রহগুলোতে মানবজাতির অস্তিত্ব নেই। মানবজাতির কর্মকাণ্ডের জন্যই বৈশ্বিক উষ্ণায়ন বাড়ছে ইতোমধ্যে তাপমাত্রা উঠছে ৪৯ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপর এবং দেখা দিচ্ছে চরম আবহাওয়া। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে এখন যে চরম তাপপ্রবাহ, প্রচণ্ড ভারি বৃষ্টিপাত, খরা বা সাইক্লোন হতে দেখা যাচ্ছে, তাতে জলবায়ুর এই পরিবর্তন স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। যার ফলে পৃথিবী নামক গ্রহে মানুষের বসবাসের অযোগ্য হয়ে যাচ্ছে যা মানবজাতির জন্য অশনিসংকেত। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলার যুদ্ধে বাংলাদেশ কতটুকু প্রস্তুত? সমপ্রতি ঢাকার এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স (একিউআই) ২০০ রেকর্ড করা হয়েছে, যা বাতাসের মানকে ‘অস্বাস্থ্যকর’ বলে নির্দেশ করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) ও যুক্তরাষ্ট্রের পরিবেশবিষয়ক সংস্থা ইপিএর হিসাবে কোনো একটি শহরের বায়ুর মানের সূচক ২০০-এর বেশি হলে তাকে খুবই অস্বাস্থ্যকর বলা হয়। ৩০০-এর ওপরে হলে সেটিকে দুর্যোগপূর্ণ বলা হয়। চীনের উহান ২১৮ একিউআই স্কোর নিয়ে শীর্ষস্থান, ঢাকা শহর দ্বিতীয় স্থানে এবং ভারতের কলকাতা ১৯৩ স্কোর নিয়ে তালিকায় তৃতীয় স্থানে রয়েছে। বাতাসের মান নিয়ে তৈরি করা একিউআই সূচক দ্বারা প্রমাণিত হয় শহরের বাতাস দূষিত তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

ঢাকা দীর্ঘদিন ধরে বায়ু দূষণে ভুগছে। ঢাকা শহরকে কারা অস্বাস্থ্যকর করছে? শীতের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে নির্মাণ কাজ, রাস্তার ধুলা ও অন্যান্য উৎস থেকে দূষিত কণার ব্যাপক নিঃসরণের কারণে শহরের বাতাসের গুণমান দ্রুত খারাপ হতে শুরু করে। বিশেষজ্ঞদের গবেষণার মাধ্যমে উঠে এসেছে বায়ুদূষণের শিকার দেশের মধ্যে শীর্ষ শহর রাজধানী ঢাকা। এর কারণ পুরোনো যানবাহনের আধিক্য, অপরিকল্পিতভাবে শহরের যেখানে-সেখানে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি, শহরের আশপাশের ইটভাটা ও শিল্প-কলকারখানার দূষণ, শহরের ভেতরে যে ময়লা আবর্জনা জমে সেগুলো পোড়ানোর ধোঁয়া এবং সর্বশেষ রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে যথাযথ পদক্ষেপ না নেয়ার জন্যই বসবাসের অযোগ্য নগরী ঢাকা শহর। ঢাকা শহরের গাছপালায় প্রতিদিন ৪৩৬ মেট্রিক টন ধূলিকণা জমে। সেই হিসাবে মাসে ১৩ হাজার মেট্রিক টন ধুলা জমা হয়। এই জমে থাকা ধুলা দিনের বেলা বাতাসের সঙ্গে মিশে যেমন দূষণ বাড়ায়, তেমনি রাতে গাড়ির অতিরিক্ত গতির সঙ্গে বাতাসে উড়তে থাকে। আর তাই দিনের বেলা থেকে রাতের বেলা বায়ুদূষণের মাত্রা বেড়ে যায়।

বায়ুদূষণের কারণে ঢাকা শহরে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করেছে। বিশেষ করে শিশুদের স্বাভাবিক শ্বাসপ্রশ্বাস বিঘ্নিত হওয়ার পাশাপাশি নানা শারীরিক জটিলতা দেখা দিচ্ছে। বাতাসে ভারী ধাতু ও সূক্ষ্ম বস্তুকণা বেড়ে যাওয়ার কারণে ক্যান্সার, শ্বাসকষ্ট, স্নায়ুজনিত সমস্যা বেড়ে যাচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মতে, বায়ুদূষণে বিশ্বব্যাপী প্রতি বছর মূলত স্ট্রোক, হূদরোগ, দীর্ঘস্থায়ী বাধা পালমোনারি রোগ, ফুসফুসের ক্যান্সার ও তীব্র শ্বাসকষ্ট সংক্রমণের ফলে আনুমানিক ৭০ হাজার মানুষের মৃত্যু হচ্ছে।

আমাদের দেশের বায়ুদূষণের অবস্থা দিন দিন খারাপ। কিন্তু দুঃখের বিষয় বায়ুদূষণের উৎস দিন দিন বাড়ছে। বায়ুদূষণ রোধে রাষ্ট্রের ভূমিকা তেমনটা লক্ষ করার মতো না। বায়ুদূষণ রোধের প্রধান কাজ তো পরিবেশ অধিদফতরের; কিন্তু তারা যখন বায়ুদূষণ ঠেকাতে পারছে না তখন তাদের অবশ্যই জবাবদিহিতা কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে। পূর্বে আমরা দেখেছি রাজধানীর কারওয়ান বাজার এলাকার বায়ুর মান ছিল ২৯৮, যা দুর্যোগপূর্ণের কাছাকাছি, ফলে স্বাস্থ্যের জন্য যেমন খুবই অস্বাস্থ্যকর। ঠিক তেমনি ওই স্থানের পরিবেশও দূষিত। ফলে দূষিত পরিবেশ নিয়ে মানুষ কী বসবাস করতে পারবে। আমাদের দেশের রাজধানী শহর ঢাকা। ফলে আমরা জানি এই শহরের শিক্ষিত মানুষ ও পরিবেশ উন্নত; কিন্তু দিনের পর দিন খবর প্রচারিত হচ্ছে ঢাকা শহর অস্বাস্থ্যকর তখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে— এই শহরেই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বেশি, প্রকৌশলী বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ, জাতীয় সংসদ ভবন, প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনসহ ইত্যাদি সব গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ ঢাকা শহরেই আছে। কিন্তু এত শিক্ষিত ব্যক্তি থাকার পরেও আজ ঢাকা শহর কেন অযোগ্য নগরী হবে? আমাদের দেশের ভিআইপি মানুষ তো খোলা রাস্তায় বের হয় না তারা তো ভিআইপি গাড়িতেই ঘুরেন, ফলে তাদের পরিবেশ নিয়ে মাথাব্যথা থাকে না। কিন্তু পরিবেশ দূষণের কবলে বেশি শ্রমজীবী মানুষ। যারা কিনা দিনের পর দিন পেটের ক্ষুধা নিবারণের জন্য হন্যে হয়ে ঢাকা শহর ছুটেন, তারাই বেশি এর ভুক্তভোগী। কিন্তু মনে রাখতে হবে পরিবেশ বাঁচলে মানুষ বাঁচবে। তাই মানুষ হিসেবে প্রধান দায়িত্ব শুধু উন্নয়নে নয়, পরিবেশ রক্ষার দায়িত্ব নিতে হবে। ফলে দায়িত্ব জনগণের সচেতনতার পাশাপাশি রাষ্ট্রকে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতে হবে। বায়ুদূষণের সূচক ৩০০ নয়, দূষণের পর্যায় সূচক ৫০ নিয়ে আসতে হবে।

তার জন্য প্রয়োজন ঢাকাকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা।

অপরিকল্পিত যেসব কার্যকলাপ তা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ঢাকা শহরে এখনো প্রচুর ডিজেল চালিত পুরোনো বাস চলে এবং প্রতিদিন কয়েক ঘণ্টার যানজটে বিপুল পরিমাণ ধোঁয়া নির্গত হয়। কালো ধোঁয়া নির্গত যানবাহন জব্দ করতে হবে। সেই সঙ্গে ডিজেল বাসের পরিবর্তে ইলেকট্রিক বাসের ব্যবহার বৃদ্ধির মাধ্যমে এই সেক্টর থেকে বায়ুদূষণ কমিয়ে আনতে হবে।

সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে নিয়মিত রাস্তায় পানি ছিটিয়ে দিতে হবে। রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি কাজে টেন্ডারের শর্ত পালন করতে হবে। যানবাহনের কালো ধোঁয়া, মিলকারখানা ও ইটভাটার কালো ধোঁয়া যেন বের না হয় তার ব্যবস্থা করতে হবে। যারা বায়ুদূষণের সঙ্গে জড়িত তারা যত বড়ই ক্ষমতাশালী ব্যক্তি হোক না কেন তাকে আইনের আওতায় এনে শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।

যানজট কমানোর প্রতি মনোযোগী হওয়া ও ধীরে ধীরে বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণকে টার্গেট করে আমাদের নীতিমালা গ্রহণ করতে হবে। শহরের ধারণক্ষমতা অনুযায়ী পরিকল্পনা করা। বৃদ্ধির বিষয়টিও পরিকল্পিতভাবে হতে হবে। নাগরিকরা যেসব সমস্যা মোকাবিলা করছে, সেগুলো সমাধানে উদ্যোগী হতে হবে। বিভিন্ন গণমাধ্যম, রাজনৈতিক দল, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের অংশগ্রহণও আবশ্যক। বাসযোগ্য দেশ ও নগরী হিসেবে গড়ে তোলার কাজটি মেয়র, কাউন্সিলর ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে হবে। ফলে মানুষকে মুক্ত বায়ু সেবন করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব ও কর্তব্য।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

নয়া শতাব্দী/এস

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ