ভোক্তা পর্যায়ে গ্যাসের দাম গড়ে ২০ শতাংশ বৃদ্ধির সুপারিশ করেছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। পেট্রোবাংলার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে চার দিন শুনানি করে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা। যদিও এই দাম বৃদ্ধির যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে বিভিন্ন মহল থেকে। এর কারণ হচ্ছে, এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) আয়োজিত গণশুনানিতে অনেক প্রশ্নেরই ঠিকঠাক জবাব দিতে পারেনি সংস্থাটি। তাছাড়া তাদের দেয়া তথ্য-উপাত্তেও প্রচুর গরমিল পাওয়া গেছে। শুনানির শুরুতে পেট্রোবাংলা প্রতি ইউনিট (ঘনমিটার) গ্যাসের দাম ১৫ টাকা ৩০ পয়সা করার প্রস্তাব দিলেও কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি বলেছে, পেট্রোবাংলার খরচ হয় ১২ টাকা ৪৭ পয়সা।
পেট্রোবাংলার এবারের হাবভাব দেখে শুরু থেকেই মনে হয়েছে, যেভাবেই হোক গ্যাসের দাম বৃদ্ধি করার প্রতিজ্ঞা নিয়েই মাঠে নেমেছে তারা। শুরুতে এই দাম বাড়ানোর প্রস্তাব আইন ও প্রবিধান অনুসারে উত্থাপিত না হওয়ায় বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনও (বিইআরসি) আমলে নেয়নি; কিন্তু পেট্রোবাংলা এতে দমে না গিয়ে নতুন করে আবারো আবেদন করিয়েছে বিতরণ কোম্পানিগুলোকে দিয়ে। সম্ভবত এটাই মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা। কারণ, যখন শিল্পকারখানা বন্ধ রাখতে হচ্ছে গ্যাসের অভাবে, অনেক বাসাবাড়িতে গ্যাসের অভাবে বিকল্পব্যবস্থায় রান্নার কাজ চলছে, পূর্ব ইউরোপীয় দুই দেশের যুদ্ধ বাংলাদেশের বাজারে খাদ্যশস্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে— তখনই গ্যাসের দাম বৃদ্ধি করে জনজীবনের অস্বস্তি আরো বাড়িয়ে দেয়া হচ্ছে।
গত নভেম্বরে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিকে কারণ দেখিয়ে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারপ্রতি ১৫ টাকা বাড়িয়েছিল সরকার। গত সাড়ে তিন মাসে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির এই বিরূপ প্রভাব হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে সাধারণ মানুষ। কারণ, এই মূল্যবৃদ্ধি শুধু জ্বালানি তেলের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি, গণপরিবহনসহ বাজারের সব নিত্যপণ্যের ওপর গিয়ে পড়েছে।
অন্যদিকে, গ্যাসের এই দাম বাড়ানোর তোড়জোড়ের অনেক আগে থেকেই বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর দাবি জানিয়ে রেখেছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। এ ক্ষেত্রে তারা বলছে, গ্যাসের দাম বাড়ানো হলে বিদ্যুতের পাইকারি দামও বাড়াতে হবে। কারণ, দেশের প্রায় ৭০ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় গ্যাস থেকে। মানে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির ফলে এখন বিদ্যুতের দামও বাধ্য হয়েই বাড়াতে হবে। তদুপরি, সারও উৎপাদন করা হয় গ্যাস পুড়িয়ে। তাহলে ইক্যুয়েশন বলছে, দাম বাড়বে সারেরও। যার প্রভাব গিয়ে পড়বে কৃষিতে। তাছাড়া এই মূল্যবৃদ্ধির অজুহাতে আরো নানারকমের অপ্রাসঙ্গিক মূল্যবৃদ্ধিও যোগ হবে।
কিছুদিন আগে এমনিতেই ডিজেলের দাম বৃদ্ধিতে এক দফা দুর্ভোগের শিকার হয়েছে সাধারণ মানুষ। এ অবস্থায় গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ানো মানে হলো— তা সাধারণ মানুষের যাপিত জীবনে আরেকটি বড় ধাক্কা আসা। আরেকটি ব্যাপার হচ্ছে, গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়লে শুধু সাধারণ মানুষের দুর্ভোগই কিন্তু বাড়বে না, দেশের শিল্পকারখানা তথা শিল্পক্ষেত্রেও পড়বে এর নেতিবাচক প্রভাব। এই মূল্যবৃদ্ধি উচ্চবিত্ত, উচ্চ মধ্যবিত্ত কিংবা ধনিক শ্রেণির জীবনমানে তেমন প্রভাব ফেলবে না হয়তো; কিন্তু মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত, সীমিত ও স্বল্প আয়ের মানুষ যে দুর্ভোগের মধ্যে পড়বে, তা বলাই বাহুল্য।
করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে এমনিতেই অনেকেই দুর্বিষহ জীবনযাপন করছে। কাজ হারানোদের বেশিরভাগই হয়তো নতুন করে কাজ পেয়েছে; কিন্তু সমাজ অর্থনীতির সব পর্যায়ে এখনো অর্থনৈতিক সংকটের চিত্র বিদ্যমান। এ পরিস্থিতিতে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রক্রিয়া উৎপাদন-বণ্টনসহ মানুষের জীবনকে আরো দুর্বিষহ করে তুলবে। তার পরিবর্তে এই বিতরণ কোম্পানিগুলোর মধ্যে থাকা দুর্নীতি-অনিয়ম বন্ধ করাসহ সিস্টেম লস কমিয়ে সম্পদের সঠিক ব্যবহার করে কীভাবে ভর্তুকির চাপ কমানো যায়, সেদিকে দৃষ্টি দেয়ার সময় এসেছে। কারণ, গ্যাসের দাম বাড়িয়ে পেট্রোবাংলা যা লাভ করত সিস্টেম লস কমিয়ে আনলেই সেটা পূরণ করা যায়।
কারণ, খোদ রাজধানীর অনেক এলাকায়ই বৈধ সংযোগের চেয়ে অবৈধ সংযোগের সংখ্যা অনেক বেশি। সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান তিতাসের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মদদেই এসব অবৈধ সংযোগ দেয়া হয়। রাজধানীর কড়াইল বস্তিতে গ্যাস সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান তিতাসের কোনো বৈধ সংযোগ না থাকলেও এখানকার প্রতিটি ঘরেই জ্বলে গ্যাসের চুলা। কেবল বাসা নয়, বস্তির দোকান আর রেস্তোরাঁগুলোতেও রয়েছে তিতাসের এই অবৈধ চুলার সংযোগ। বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর এসেছে, তিতাসের লোকজনের মাধ্যমেই পাওয়া যায় এই সংযোগ। শুধু কড়াইল বস্তি নয় রাজধানী এবং এর আশপাশে জালের মতো ছড়িয়ে আছে অবৈধ গ্যাস সংযোগ। এসব সমস্যার দ্রুত কোনো সমাধান করতে না পারলে গ্যাসের দাম বারবার বাড়িয়েও লাভ নেই।
গ্যাস নিয়ে যদি সংকট সৃষ্টি হয়ই, তবে মূল্যবৃদ্ধি না করেও সংকট সমাধানের আরো পথ খোলা আছে। প্রথমত, দেশে নতুন যেসব গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়েছে; কিন্তু উত্তোলন শুরু হয়নি, সেগুলো থেকে উত্তোলনের উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। তাছাড়া বন্ধ হয়ে যাওয়া খনি ও কূপগুলোর আরো গভীরে অনুসন্ধান করা প্রয়োজন। একইসঙ্গে উন্নত প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে দেশের হাইপ্রেশার জোনগুলোতে অনুসন্ধান ও উত্তোলন কূপ খনন করা। দ্বিতীয়ত, গ্যাস খাতের চুরি ও অপচয় কমিয়ে এনে রাজস্ব বাড়ানো। সরকার ঢাকা শহরে বাসাবাড়িতে প্রিপেইড মিটার সরবরাহের উদ্যোগ নিয়েছিল। ওইসময়ে মাত্র ১০ শতাংশ বাসাবাড়িতে প্রিপেইড মিটার সরবরাহ করার পর অদৃশ্য কারণে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। যদিও কার্যক্রমটি পুনরায় চালু হয়েছে। এবার এক লাখ প্রিপেইড মিটার সরবরাহ করা হবে। গ্যাসের চুরি ও অপচয় বন্ধে এই কার্যক্রমটিকে সারাদেশে ছড়িয়ে দেয়া কার্যকর পদক্ষেপ হতে পারে। সবখানে প্রিপেইড মিটার চালু হলে কেবল সরকারের রাজস্বই বাড়বে না, গ্রাহকদেরও সাশ্রয় হবে।
বঙ্গোপসাগরের নিচে ব্যাপক গ্যাস ও তেলসম্পদ আবিষ্কার ইতোমধ্যেই ভারত ও মিয়ানমারকে বিশ্বের বড় বড় তেল-গ্যাস অনুসন্ধানীদের কাছে আকর্ষণীয় করে তুলেছে। এ ক্ষেত্রে পেছনে পড়ে রয়েছে বাংলাদেশ। অথচ দেশ দু’টির সঙ্গে দীর্ঘদিনের সমুদ্রসীমানা বিরোধ নিষ্পত্তি করে সমুদ্রজয় ছিল বর্তমান আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের একটি বড় অর্জন। এই সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যাপক সাফল্য দেখিয়েছে। মাত্রই কয়েক দিন আগে শতভাগ বিদ্যুতায়নের মাইলফলকে পৌঁছানোর ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর পাশাপাশি সার্বিক অবকাঠামো উন্নয়নেও সমগ্র বিশ্বের নজর কেড়েছে বাংলাদেশ। সমুদ্রজয় তাদের বড় একটি সাফল্য হলেও এখনো সাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উৎপাদনে কার্যকর উদ্যোগ নিতে পারেনি। ফলে ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে গিয়ে সরকার গ্যাস আমদানির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। অথচ, দেশের জ্বালানি খাতকে স্বনির্ভর করতে এবং সংকট থেকে রক্ষা করতে সাগরের গ্যাসই হতে পারে রক্ষাকবচ।
একটি বিষয় লক্ষণীয়, টিসিবির ট্রাক থেকেও পণ্য কিনতে ভোগান্তির শিকার হচ্ছে সাধারণ মানুষ। খোদ রাজধানীর অনেক জায়গাতেই এখন টিসিবির ট্রাক থেকে পণ্য কিনতে কাগজে সিরিয়াল নম্বর লিখে তারপর দাঁড়াতে হচ্ছে। কিন্তু দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়েও পণ্য না পেয়েই ফিরছেন অনেকে। সেখানেও লাইন এখন প্রতিনিয়ত দীর্ঘ ইচ্ছে। এখন কেবল নিম্ন বা নিম্নমধ্যবিত্তই নয়, মধ্যবিত্তরাও দাঁড়াচ্ছে। দাঁড়াচ্ছে বললে ভুল হবে, দাঁড়াতে বাধ্য হচ্ছে।
আগামী বছর জাতীয় নির্বাচন। এখন এ পরিস্থিতিতে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের আগে সরকারের নীতিনির্ধারকদের উচিত নির্বাচনকেও বিবেচনায় নেয়া। কারণ, এই অবস্থায় গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির কারণে আবারো যদি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ে, তাহলে এই চাপ সাধারণ মানুষের জন্য অসহনীয় হয়ে উঠতে পারে। জনজীবনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। বিশেষ করে নিম্নমধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত মানুষের জীবনমানের ধারাকে অবনমন করবে। তাই এ ক্রান্তিকালে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত থেকে সরকার যদি সরে আসে তাহলে দেশের অর্থনীতি ও জনগণ লাভবান হবে।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ