হালের সেনসেশন ই-সিগারেট, যা এখন দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়েছে। যুবসমাজের কাছে ফ্যাশন ও ভাব নেয়ার উপকরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত দু’বছরে দেশে ভ্যাপ’র বিক্রি বেড়েছে কয়েক গুণ। ভ্যাপ মূলত ই-সিগারেটের উন্নত সংস্করণ।
তাদের বক্তব্য ই-সিগারেটে সাধারণ সিগারেটের মতো ক্ষতিকারক পদার্থ নেই! আবার স্টাইল করেও ব্যবহার করা যায় বলে, যুবসমাজে এর প্রতি আকর্ষণ বেশি। কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায়, আদৌ কতটুকু নিরাপদ এই ই-সিগারেট বা ভ্যাপ?
ওৎরংয ঈধহপবৎ ঝড়পরবঃু-এর মতে, প্রচলিত সাধারণ সিগারেটে কয়েক হাজার ক্ষতিকর উপাদান রয়েছে। তার মধ্যে ১০-১১টি উপাদান উল্লেখযোগ্য যা সিগারেটে বেশি পরিমাণে রয়েছে ও যা থেকে ক্ষতির সম্ভাবনা বেশি। যেমন— নিকোটিন, টার, আর্সেনিক, এমোনিয়া, এসিটোন, টোলুইনন, পেস্টিসাইডস ও পোলোনিয়াম-২১০ ইত্যাদি।
‘নিকোটিন’ যা তামাকে বিদ্যমান প্রধান ক্ষতিকারক উপাদান। এটি ধূমপায়ীর মস্তিষ্কে সরাসরি প্রবেশ করে ও ধূমপানকে নেশাগ্রস্থ অভ্যাসে পরিণত করে। ‘টার’ হলো বিষাক্ত কিছু উপকরণের নাম একত্রে ‘টার’ বলা হয়। এইগুলো ফুসফুসে প্রবেশ করে ক্যান্সারের কোষ তৈরি করে থাকে। পোলোনিয়াম-২১০ একটি পারমাণবিক তেজষ্ক্রিয় পদার্থ। এছাড়া আর্সেনিক, এমোনিয়া ও পেস্টিসাইডস যা তামাক খেতে ব্যবহূত হয় সার ও কিটনাশক হিসেবে, সিগারেটে এরও উপস্থিতি উল্লেখযোগ্য হারে আছে। এসিটোন, টোলুইনন এসব একপ্রকারের রাসায়নিক বজ্য যা তামাক ক্ষেত থেকে সিগারেটে প্রবেশ করে।
উক্ত ক্ষতিকারক উপাদান সমৃদ্ধ তামাকগুলো যেমন সিগারেটে বিদ্যমান, তেমনি ই-সিগারেটেও বিদ্যমান থাকে।
দীর্ঘ সময় ধরে ই-সিগারেটের ওপর গবেষণা চালানো হচ্ছে। এই পর্যন্ত ২৪টির বেশি গবেষণাবিষয়ক জার্নাল দাবি করেছে, ‘ই-সিগারেট/ভ্যাপ’তে সাধারণ সিগারেটের তুলনায় বেশি ক্ষতিকারক পদার্থ থাকে।’
এই গবেষণায় একাধিক ধূমপায়ীর রক্ত ও প্রস্রাবের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। এসব নমুনা থেকে প্রাপ্ত ফলাফল বলছে , ‘ই-সিগারেট ধূমপায়ীদের শরীরে অধিক পরিমাণে ক্ষতিকারক পদার্থ পাওয়া গেছে। লেড, আর্সেনিক ও নিকেলের মতো ধাতব বিষ তার মধ্যে অন্যতম। এসব ক্ষতিকারক ধাতব পদার্থ ই-সিগারেট থেকে তাদের শরীরে প্রবেশ করেছে বলে গবেষকরা বলেছেন।
সাধারণ সিগারেটের উপাদান কার্ডমিয়াম বাদে ই-সিগারেটের মধ্যে তারা সব উপকরণের উপস্থিতি লক্ষ করেছেন। ঈ্ঊঘ বিজ্ঞানবিষয়ক জার্নাল গবেষণার বরাত দিয়ে বলছে, ‘ই-সিগারেটপায়ীরা সিগারেটের তুলনায় বেশি ধাতব পদার্থ গ্রহণ করে থাকে, কেননা ই-সিগারেটে তামাক ছাড়াও বিভিন্ন তরল ফ্লুইড ব্যবহার করা হয়। এতে এমন কিছু উপকরণ সংযুক্ত থাকে যা তামাকের ধোঁয়া কয়েকগুণ বৃদ্ধি করে। যার ফলে নিকোটিন অতিমাত্রায় শরীরে প্রবেশ করে থাকে।’ এই সব গবেষণা চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। শুরুতে সকলে ধারণা করেছিলেন, ই-সিগারেট তেমন ক্ষতিকারক নয়, কিন্তু সামপ্রতিক সব গবেষণাই উল্টো কথা বলছে। এর প্রেক্ষিতে ইতোমধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে স্বাস্থ্যঝুঁকির কথা ভেবে এটি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ভারতেও ই-সিগারেট উৎপাদন, আমদানি ও বিক্রি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। কানাডাসহ ইউরোপের কয়েকটি দেশেও ই-সিগারেট নিষিদ্ধ। সমপ্রতি নিউজিল্যান্ডে সবপ্রকার ধূমপান চিরতরে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
কিন্তু বাংলাদেশে উল্টো চিত্র, ই-সিগারেট ও এর বিভিন্ন উপাদান আমাদের দেশে উৎপাদিত না হলেও, আইনে নিষিদ্ধ না হওয়ায় বাংলাদেশে ই-সিগারেট আমদানি ও বিপণন নিষিদ্ধ নয়।
জাতীয় হূদরোগ ফাউন্ডেশন হাসপাতাল ও গবেষণাকেন্দ্রের চিকিৎসক অধ্যাপক সোহেল রেজা চৌধুরী বলেন, ‘সিগারেটের চেয়ে ই-সিগারেটে নিকোটিন বেশি পরিমাণে বের হয় বা সেবন হয়। এতে আসক্তি বাড়ে। এছাড়া বাজারে সস্তায় যেসব ভ্যাপ জুস পাওয়া যায়, এগুলোতে কী উপাদান থাকে, তা অজানা। নিকোটিন ফুসফুসের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকারক । আর ভ্যাপ জুসে রাসায়নিক উপাদান বেশি বেশি সেবনে ফুসফুসের আরো ক্ষতি করে। তাই এখনই সরকারের উচিত এর বাজারজাত নিষিদ্ধ করা।’
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, সরকার ২০০৫ সালে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন প্রণয়ন করে। আইনটি ২০১৩ সালে সংশোধন করা হয়। আইনটি আবার সংশোধন করার কার্যক্রম চলমান। আইনটি সংশোধনে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তিনটি সভা করেছে। এবারের সংশোধনীতে ই-সিগারেট নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ নেয়া হবে।
আবার ২০১৯ সালে ভারতে ই-সিগারেট নিষিদ্ধ করা হলে বাংলাদেশও আইন সংশোধনের মাধ্যমে ই-সিগারেট নিয়ন্ত্রণে উদ্যোগ নেয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। কিন্তু অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের আপত্তিতে সে উদ্যোগ তখন সফল হয়নি।
এই বিলম্বের বিষয়ে জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেলের প্রোগ্রাম অফিসার মো. ফরহাদুর রেজা বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিবেদনে ই-সিগারেটের ক্ষতিকর দিকগুলোর বিষয়ে জানা যাচ্ছে। এতে স্বাস্থ্যগত বিভিন্ন ঝুঁকি আছে। ক্ষতিকর বলেই বিভিন্ন দেশ এটি নিষিদ্ধ করেছে। বাংলাদেশে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনটির সংশোধনী খসড়া পর্যায়ে আছে। এবারের সংশোধনীতে ই-সিগারেট নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি থাকতে পারে।’
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানায়, বিশ্বে খুব ধীরগতিতে ধূমপায়ীর সংখ্যা কমছে। সংখ্যাটি এক বিলিয়নের বেশি। তবে ই-সিগারেটের চিত্র ভিন্ন। এর ব্যবহারকারী দ্রুত বাড়ছে। ২০১১ সালে ই-সিগারেট ব্যবহারকারী ছিলেন ৭ মিলিয়ন, ২০১৮ সালে বেড়ে হয় ৪১ মিলিয়ন। বাজার বিশ্লেষণ নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান ইউরোমনিটর বলছে, ‘বিশ্বে ২০২১ সালে ই-সিগারেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ৫৫ মিলিয়ন ছাড়িয়েছে।’
এমতাবস্থায় আন্তর্জাতিকভাবে এর উৎপাদন ও বিপণনের বিপক্ষে কঠোর পদক্ষেপ না নিলে, নতুন বৈশ্বিক স্বাস্থ্যঝুঁকি দেখা দেবে বলে আশঙ্কা করছি। দেশের নীতিনির্ধারকদের প্রতি বিনীত অনুরোধ থাকবে, দেশের যুবসমাজকে বাঁচাতে অনতিবিলম্বে একটি কার্যকরী পদক্ষেপ নিন।
লেখক: কলামিস্ট
নয়া শতাব্দী/এস
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ