ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৪ আশ্বিন ১৪৩১, ১৫ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

লঞ্চে অগ্নিকাণ্ড: যাত্রী পুড়ে মরলে তাদের কি হয়?

প্রকাশনার সময়: ২৫ ডিসেম্বর ২০২১, ০১:২৯

ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে লঞ্চে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড। ক্রমেই লাশের সারি দীর্ঘ হচ্ছে। ছুটির দিনে ঘুম থেকে উঠেই এমন দুর্ঘটনার খবর শুনে দিনটাই আমার পুরো পরিবারের খারাপ কেটেছে। ঘুরেফিরে একটা বিষয়ই আমার মাথায় আসছে, হয়তো ভাগ্য খারাপ হলে এই লাশগুলোর মধ্যে আমিও থাকতে পারতাম। কারণ আমার গ্রামের বাড়ি বরগুনা, এই লঞ্চে আমিও প্রতিনিয়ত যাতায়াত করে থাকি।

আমি একজন সাধারণ যাত্রী হিসেবে লঞ্চ কর্তৃপক্ষ, চালক, আনসার সদস্য, কেবিন বয়, হোটেল কর্মীসহ সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বে অবহেলার চিত্র দেখেছি। ঢাকা থেকে বরগুনাগামী লঞ্চ প্রতিদিন বিকেল সাড়ে ৫টা ও সন্ধ্যা ৬টায় দুটি লঞ্চ ছেড়ে যায়। মূলত বেলা ২টা থেকেই লঞ্চগুলোতে যাত্রীরা আসতে শুরু করে। এই সময় থেকে লঞ্চ ছাড়ার আগ মূহুর্ত পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট সকলকে পুরোদমে তাদের দায়িত্ব পালন করতে দেখা গেলেও বিপত্তি শুরু হয় রাত ১০টার পরে।

লঞ্চে থাকা আনসার সদস্যরা নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকলেও বাস্তবে তাদের থাকার জন্য যে বরাদ্দকৃত স্টাফ কেবিনটি ও একেকজন লঞ্চের ডেকে দুই থেকে তিনটা বিছানা বিছিয়ে সেগুলো যাত্রীদের কাছে চড়া দামে বিক্রির ধান্দায় ব্যস্ত থাকে। রাত ১০টার পরে এসব আনসার সদস্যদের আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না।

প্রতিটি লঞ্চের ইঞ্জিনের কাছে অর্থাৎ লঞ্চের পেছন দিকটায় একটি হোটেলের অবস্থান। আর ইঞ্জিনের সামনের দিকের ‘বাম’ পাশে একটি চা-সিগারেটের দোকান থাকে। এই দোকানটায় চা তৈরির জন্য তারা গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহার করে।

গতকাল সুগন্ধা নদীতে লঞ্চে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর থেকে আমার কাছে একটা বিষয়ে খটকা লেগেই আছে। তাহলো, সেই চা-সিগারেটের দোকানটা মূলত সারারাত চালু থাকে। যারা সিগারেট-চা খেয়ে থাকেন সেখানে প্রতি মূহুর্তে কম হলেও এমন ১০ থেকে ১৫ জন মানুষ থাকেন। এ বিষয়টা বুঝতে পারবেন যারা প্রতিনিয়ত লঞ্চ ভ্রমণ করেন।

আমার প্রশ্ন হচ্ছে লঞ্চের ইঞ্জিনে অথবা হোটেলে যখন আগুন লাগলো তখন চা-সিগারেটের দোকানে থাকা লোকজন কি একটুও চেষ্টা করেনি আগুন নেভানোর? নাকি আগুন নেভানোর কোন সরঞ্জামই ছিলো না সেই লঞ্চে? তখন সেই আনসার সদস্যরাও বা কোথায় ছিলো?

সারাদিন টিভিতে দেখলাম লঞ্চে থাকা প্রত্যক্ষদর্শীরা অভিযোগ করেছেন, লঞ্চ কর্মীরা চেষ্টা করলে আগুনের ভয়াবহতা এতটা ছড়াতো না। তাহলে কি এর দায় শুধু লঞ্চ কর্মীদের? আমি মনে করি এর দায় এসব বিষয় যারা তদারকি করেন এমন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারিদেরও রয়েছে।

লঞ্চগুলোতে মূলত ঢাকা থেকে বৃহস্পতিবার এবং দক্ষিণাঞ্চল থেকে শনিবার প্রচুর ভীড় থাকে। কারণ শুক্র-শনিবার অফিস বন্ধ থাকায় বৃহস্পতিবার অনেকেই গ্রামে যান। আবার রোববার অফিস খোলা থাকায় শনিবার সবাই কর্মে ফেরার তাগিত থাকে। আর এই সুযোগে প্রতিটি লঞ্চ তাদের ধারণ ক্ষমতার তিন/চারগুণ যাত্রী বোঝাই করে যাত্রা করে। যেহেতু আমি ওই রুটে প্রতিনিয়ত চলাচল করি সেই অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি এমভি অভিযান-১০ নামের ওই লঞ্চে কম হলেও এক হাজার থেকে ১২শ’ যাত্রী ছিলো। কিন্তু বাস্তবে ওই লঞ্চের ধারণক্ষমতা ছিলো মাত্র ৩৫০ জনের।

ব‌রিশা‌ল বিআইডব্লিউটিএর যুগ্ম প‌রিচালক এস এম আজগর আলীর ভাষ্য, এমভি অভিযান-১০ লঞ্চে যাত্রী ধারণ ক্ষমতা ৩৫০ জন। ঘাট ছাড়ার সময় নৌযানে ছিলেন মাত্র ৩১০ জন যাত্রী। তবে যাত্রী মো. সোহান বলেন, ‘লঞ্চটিতে নয়শ থেকে এক হাজার যাত্রী ছিল।’

অর্থাৎ লঞ্চে ৫ হাজার যাত্রী বহন করা হলেও অদৃশ্য কারণে তালিকায় ধারণক্ষমতার একজনও বেশি উঠবে না। এটা আমাদের দেশে একটা ওপেন সিক্রেটও বলতে পারেন!

এমভি অভিযান-১০ লঞ্চে লাইফ বয়া-অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র আদউ ছিলো কিনা এখন সেই প্রশ্ন! প্রশ্ন এটাও গরিবের ট্যাক্সের টাকায় এসব দেখার জন্য যাদের সরকারিভাবে নিয়োগ দেয়া আছে তারা কি এর দায় এড়াতে পারে?

প্রতিটি লঞ্চঘাটে কুলিরা গরিব মানুষদের হয়রানি করে। গরিবের কাঁধে একটা বস্তা দেখলেই কুলি হাজির, মোটা অংকের টাকা না দিলে নানাভাবে হেনস্তার শিকার হতে হয় তাদের। এমন ঘটনার কয়টা বিচার ট্যাক্স খাওয়া চাকরগুলো করেছে?

প্রতিবার এমন দুর্ঘটনায় আমাদের মত গরিব মানুষের প্রাণ গেলে সরকারিভাবে ২৫ হাজার টাকা দাফন-কাফন বাবদ দিয়ে দায়িত্ব খতম! ২৫ হাজার কেন? ২৫ কোটি টাকা দিয়েও কি এমন একটা গরিবের প্রাণ ফিরিয়ে দিতে পারবে তারা?

বৃহস্পতিবারের ঘটনা হয়তো আগামী বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সবার মুখে মুখে, টিভি-পত্রিকার পাতায় পাতায় আলোচনা চলবে, কিন্তু এরপরে কি হবে কেউ কি খোঁজ রেখেছেন? অথবা কেউ রাখবে? কত তদন্ত, কত রিপোর্ট, কত আইনি লড়াই সবই একদিন থেমে যাবে। কিন্তু থামবে না পুড়ে মারা যাওয়া স্বজনদের কান্না আহাজারি আর শুণ্যতা। থামবেই বা কেমন করে? সন্তান হারা মা কি ভুলতে পারবে তার সন্তানের পুড়ে মরার স্মৃতি?

লেখক- এম সুজন আকন, সংবাদকর্মী, স্পাইস টেলিভিশন।

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ