ঢাকা, শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

৫১ বছরের পথচলা বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ

প্রকাশনার সময়: ২৪ ডিসেম্বর ২০২১, ০৯:২৭

নারীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা ও অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক সমতাভিত্তিক মানবিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এবং পরিবার-সমাজ ও রাষ্ট্রে নারীর সমঅধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ ১৯৭০ সালের ৪ এপ্রিল কবি সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠা লাভ করে।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ একটি স্বেচ্ছাসেবী, অলাভজনক এবং গণমানুষের জাতীয়ভিত্তিক সংগঠন। দীর্ঘ পাঁচ দশকেরও বেশি সময় ধরে নারী ও কন্যাশিশুর প্রতি সব প্রকার সহিংসতা প্রতিরোধ ও নির্মূল নারীর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের আন্দোলনসহ নারীর পরিবার-সমাজ ও রাষ্ট্রে সমমর্যাদা ও নারীর মানবধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ধারাবাহিক কর্মসূচি পালন করে যাচ্ছে। সারাদেশে ৬০টি জেলা শাখা, ২৩০০টি তৃণমূল শাখা (উপজেলা, ইউনিয়ন, গ্রাম, পাড়া) কমিটি এবং দেড় লাখেরও অধিক সদস্য রয়েছে। কেন্দ্র, জেলা শাখা এবং তৃণমূল শাখাগুলো একসূত্রেগাঁথা। কেন্দ্র এবং শাখাগুলোর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ থাকে। মহিলা পরিষদ কেন্দ্র, জেলা এবং তৃণমূল শাখার মাধ্যমে বহুমাত্রিক কাজ করে থাকে। সহিংসতার শিকার নারী ও কন্যাশিশুদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে মামলা পরিচালনা ও আইনগত সহায়তা প্রদান করে থাকে। ঢাকায় আমাদের কেন্দ্রীয় কমিটি, কেন্দ্রীয় অফিসে ১৯৮৫ সাল থেকে নির্যাতনের শিকার কন্যা ও নারীদের সাময়িক আশ্রয়কেন্দ্র রোকেয়া সদন পরিচালিত হয়ে আসছে। যেখানে নির্যাতন ও বঞ্চনার শিকার নারী ও কন্যাশিশুদের শারীরিক ও মানসিক চিকিৎসা, নিরাপদ আশ্রয় প্রদান ও সমাজের মূলধারায় পুনর্বাসনের লক্ষ্যে শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, কর্মসংস্থান এবং সৃজনশীল কর্মকাণ্ডে উৎসাহ ও সহায়তা প্রদানসহ নানা কর্মসূচি পরিচালিত হয়ে থাকে।

মহিলা পরিষদ বহুমাত্রিক ও ধারাবাহিক কার্যক্রম পরিচালনা করে। আইন সংস্কার আন্দোলন, জাতীয় ও স্থানীয়ভাবে ইস্যুভিত্তিক আন্দোলন এবং সব প্রকার বৈষম্যমূলক আইন সংস্কারের আন্দোলন, সংসদে নারীর এক-তৃতীয়াংশ আসন সংখ্যা বৃদ্ধি ও সরাসরি নির্বাচনের দাবিসহ নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে জনসচেতনতা সৃষ্টি, সভা-সমিতি, প্রচার প্রকাশনা, গবেষণা, সরকারি-বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে কার্যক্রম পরিচালনা, নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে অ্যাডভোকেসি ও লবি, নাগরিক সমাজের সঙ্গে ইস্যুভিত্তিতে মতবিনিময় এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নেটওয়ার্কিং নিয়মিত করে যাচ্ছে।

বিগত ২০১১ সাল থেকে জেন্ডার নারীর ক্ষমতায়ন ও উন্নয়নবিষয়ক ০৩ (তিন) মাসের একটি সার্টিফিকেট কোর্স পরিচালনা করছে। একটি সামাজিক সংগঠন হিসেবে বিভিন্ন দুর্যোগকালীন ত্রাণকার্য পরিচালনা এবং বিভিন্ন সমাজকল্যাণ কর্মকাণ্ড করে থাকে এ সংগঠন।

এদেশের নারীরা পাহাড়ের চূড়ায় উঠেছেন, সমুদ্র পাড়ি দিচ্ছেন, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। দেশের অর্থনীতিকে মজবুত রাখছেন, শস্য ভাণ্ডারপূর্ণ করছেন। সমাজ রাষ্ট্র পরিচালনায় আগ্রহ এবং সক্ষমতার স্বাক্ষর রাখছেন। দুর্যোগ মোকাবিলা করেছেন এবং নিজে স্বপ্ন দেখছেন এবং দেখাচ্ছেন। বাংলাদেশ আজ বিশ্বের বুকে একটি দারিদ্র্যমুক্ত উন্নত মর্যাদাসম্পন্ন দেশ হিসেবে নিজের অবস্থান দৃঢ় করার প্রত্যয় ঘোষণা করেছে। নারী যখন এগিয়ে যায় পরিবার সমাজ ও দেশও এগিয়ে যায়। নারীর এই অগ্রযাত্রার গতিকে বাধা দেয়া যা শুধু নারীকে নয়, দেশের অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্থ করে। নারীর অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রার আর উন্নয়নের অপার সম্ভবনার বিপরীতে বিরাজ করেছে নানা চ্যালেঞ্জ। নারীর অসহায়ত্বের, বাঞ্চনার, বৈষ্যমের ও নির্যাতনের ছবি।

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ আজ যে সামাজিক, অর্থনৈতিক সূচক এগিয়ে চলেছে তা সম্ভব হচ্ছে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক সমাজ জীবনে ব্যাপক গণনারীর সম্পৃক্ততার কারণে। এদেশের নারী আন্দোলনের দীর্ঘ ধারাবাহিক নিরলস সংগ্রাম। ‘নারী উন্নয়নের লক্ষ্য নয় বাহন’ নোবেল বিজয়ী মানবতাবিদ অমর্ত্য সেনের উক্তি নারী সমাজ প্রমাণ করে চলেছে।

মহিলা পরিষদ তথা নারী আন্দোলন রাজনীতি, অর্থনীতি উন্নয়নের মূল স্রোতধারা সম্পৃক্ত করার লক্ষ্যে কাজ করে চলেছে। নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে আমাদের ধারাবাহিকভাবে নিরলস প্রচেষ্টা যথাযথভাবে সাফল্যের মুখ দেখাবে। যদি রাজনীতি, সমাজ, রাষ্ট্রসহ সর্বক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার মাধ্যমে গণতন্ত্র ও সুশাসন নিশ্চিত হয়।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ সব সম্প্রদায়ের মানুষের সর্বত্র সম্প্রীতি, শান্তি প্রতিষ্ঠায় সরকার, রাজনৈতিক দল, সামাজিক সংগঠনসহ সব নাগরিক যার যার অবস্থান থেকে সচেতন ও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনের আহ্বান জানায়। দেশের যেখানেই সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে মহিলা পরিষদ সেখানেই প্রতিরোধ ও সচেতন ভূমিকা পালন করেছে। একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সংগঠনের ঘোষণাপত্র গঠনতন্ত্র মেনে আদর্শিক দৃঢ়তা, দেশপ্রেম, সেচ্ছাশ্র্রম, নৈতিক মূল্যবোধ ধারণ করে আদর্শবাদী সেচ্ছাসেবী সংগঠন গড়ে তোলার মাধ্যমে শক্তিশালী, গতিশীল নারী-পুরুষের সমতাভিত্তিক সমাজ-রাষ্ট্র গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করছে।

আগামী ৩০ ও ৩১ ডিসেম্বর দুই দিনব্যাপী বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের ত্রয়োদশ জাতীয় সম্মেলন ইঞ্জিনিয়ার ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশ ঢাকায় অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। সম্মেলনের প্রাককালে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের পক্ষ থেকে সব সদস্য, কর্মী সংগঠক ও শুভানুধ্যায়ীসহ দেশবাসীকে জানাই প্রাণঢালা আন্তরিক অভিনন্দন। আপনাদের সবার সক্রিয় সহযোগিতায় সব সদস্য, কর্মী ও সংগঠকদের অক্লান্ত পরিশ্রম ত্যাগ ও ঘাম শ্রমের বিনিময়ে মহিলা পরিষদ আজ একটি স্বাধীন স্বকীয় বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন আন্দোলনমুখী গতিশীল ও সবার আস্থাভাজন সংগঠন হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পেরেছে। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে নারীর সমঅধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মহিলা পরিষদ ধারাবাহিক অব্যাহত প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। করোনাকালীন মহিলা পরিষদ সীমাবদ্ধতার মধ্য থেকে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছে। সরকারের কর্মসূচি বাস্তবায়নে সহায়তা করেছে। কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত সাধ্যানুযায়ী দরিদ্র অসহায় মানুষদের সহযোগিতা করেছে। কেন্দ্রীয় কমিটির সঙ্গে ভার্চুয়াল সভা হয়েছে। প্রযুক্তির ক্ষেত্রে নারীদের এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য মহিলা পরিষদের নিরলস প্রচেষ্টা আছে।

মহিলা পরিষদের ৫০ বছরের ইতিহাস হচ্ছে সেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে একটি আন্দোলন, মানবতা প্রতিষ্ঠার একটি সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সংগ্রামমুখর ইতিহাস। যারা এই ইতিহাস তৈরির ক্ষেত্রে সক্রিয় অংশীদার তাদের অর্থাৎ মহিলা পরিষদের প্রাথমিক সদস্য, তৃণমূল শত সহস্র কর্মী সংগঠকদের জানাই বিশেষ অভিনন্দন। এই দীর্ঘ পথচলার সহযোগী দেশবাসী ভাই-বোনদের জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা। আন্তরিক উষ্ণ অভিনন্দন জানাই দেশের বুদ্ধিজীবী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, আইনজীবী, ডাক্তার, প্রকৌশলী, রাজনীতিবিদ, রাজনৈতিক মানবাধিকার নেতাকর্মী, বিশেষ করে গণমাধ্যমে কর্মরত ভাই-বোন ও সাংবাদিকদের যারা মহিলা পরিষদের আদর্শ লক্ষ্য ও কর্মসূচি প্রচার এবং বাস্তবায়নে যার যার ক্ষেত্রে একান্ত সহযোগীর ভূমিকা পালন করছে।

মহিলা পরিষদের এই আমন্ত্রণ এই আনন্দ ও উৎসবের প্রাকমুহূর্তে স্মরণ করছি আমাদের প্রতিষ্ঠাতা সভানেত্রী কবি সুফিয়া কামালকে, গভীর শোক ও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি আমাদের সংগঠনের কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতাদের। পরম শ্রদ্ধেয় প্রাণপ্রিয় আয়শা খানম, রাখী দাশ পুরকায়স্থ, বুলা ওসমান, দিল মনোয়ারা মনু আপা।

এই সম্মেলনে আয়শা আপা, রাখীদির শূন্যতা গভীরভাবে আমাদের পীড়া দিচ্ছে। যার অণুপ্রেরণা, উদ্যম সাহস, শক্তি বাস্তবে বিপুল অভিজ্ঞতা, পরামর্শ, বিশাল জনসংযোগ, সামাজিক, নাগরিক-সাংস্কৃতিক, জাতীয় গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সঙ্গে গভীর সম্পৃক্ততা ছিল মহিলা পরিষদ তথা বাংলাদেশের নারী আন্দোলন ও নারী সংগঠনের জন্য এক বিশাল শক্তি ও ভিত। মহীয়সী বেগম রোকেয়া যথার্থ উত্তরসূরী সর্বজন শ্রদ্ধেয় কবি সুফিয়া কামালকে পথ দেখিয়েছেন। সেই পথে অগ্রসর করে ভিত গড়ে তুলেছেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের, আমাদের সংগ্রামের প্রতীক শ্রদ্ধেয় আয়শা খানম ও রাখী দাশ পুরকায়স্থ। আমরা গভীর শ্রদ্ধা ও অনিঃশেষ ভালোবাসা জানাই এই মহীয়সী সংগ্রামী নারী আয়শা আপা এবং রাখীদিকে। আমাদের আদর্শ ও সংগ্রামী প্রেরণার প্রতীক শ্রদ্ধেয় আয়শা আপা আপনি চিরজীবী হয়ে থাকবেন আমাদের মাঝে। মানবতা ও সহিষ্ণুতার প্রতীক, সাহস ও সংগ্রামের অজয় প্রেরণা আমাদের।

আজন্ম সংগ্রামী মহিলা পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সভানেত্রী কবি সুফিয়া কামাল, আয়শা খানম, রাখি দাস পুরকায়স্থ বেঁচে থাকবে এদেশের সংগ্রামী সব নারী-পুরুষের হূদয়ে, চেতনায়, আদর্শে ও সংগ্রামে। বিজয়ের সঙ্গে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে আমরা গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নিহত লাখো শহিদের প্রতি। পাকসেনা ও তাদের দোসর, রাজাকার, আলবদর বাহিনী দ্বারা নির্যাতিতা প্রায় ২ লাখ নারীর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা নিবেদন করছি। যাদের ত্যাগ ও রক্তের বিনিময়ে আমরা অর্জন করেছি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। আমরা গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি যাদের ত্যাগ, শ্রম এবং অক্লান্ত পরিশ্রমে মহিলা পরিষদ আজ সারাদেশে নারী-পুরুষের আস্থাশীল সবার গ্রহণযোগ্য চলমান আন্দোলনমুখী গণনারী সংগঠন হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। প্রতিষ্ঠাতা সভানেত্রী সুফিয়া কামাল, মনোরমা বসু, ইলামিত্র, জাহানারা ইমাম, হেনা দাস, আয়শা খানম, রাখি দাস পুরকায়স্থ, বুলা ওসমান, দিল মনোয়ারা মনুসহ মহিলা পরিষদের সারাদেশের অগণিত নারী তাদের জীবনের কর্ম প্রচেষ্টা নারী আন্দোলনের কাজে আমাদের শক্তি সাহস ও অনুপ্রেরণা জোগায়।

পরিশেষে মহিলা পরিষদের আগামী দিনের আন্দোলন, সংগ্রাম এবং সব কর্মকাণ্ডে ও কর্মসূচিতে দেশবাসীর সহযোগিতা কামনা করছি। আপনাদের সর্বাঙ্গীন সহযোগিতায় আমাদের সংগঠন আরো অধিক গতিশীল এবং ব্যাপক নারী-পুরুষ উপকৃত হবে। আমরাও অধিক উৎসাহিত হবো। আবারো আগামী ত্রয়োদশ সম্মেলনের শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাচ্ছি সব সুধীজনসহ দেশবাসীকে।

লেখক: সভাপতি, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, কাউখালী শাখা, পিরোজপুর

নয়া শতাব্দী/এসএম

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ