ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৪ আশ্বিন ১৪৩১, ১৫ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

যে মালাটি গাঁথা হলে আরো ভালো হতো

প্রকাশনার সময়: ২২ ডিসেম্বর ২০২১, ১০:১৫

বাংলাদেশের বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী পালিত হয়ে গেল মহাসমারোহে— এই সময়কালে জীবিত ছিলাম এই আনন্দ ভোলার নয়। যদিও বিদেশে থাকি, দেশের ভালোমন্দ, সুখ-দুঃখ প্রবাসীদের ঘিরে থাকে। বরং দেশের তুলনায় হয়তো বেশি মানসিক সম্পৃক্তি থাকে আমাদের। অদর্শনের প্রেম সাংঘাতিক। আর একটা কারণ হচ্ছে, রাজনৈতিক ও সামাজিক অসুবিধা, ঘুষ দুর্নীতির গল্প শুনি বটে আমরা তা চোখে দেখি না। এই যে সকালে চোখ খুললেই ধর্ষণ, বলাৎকার, অপরাধ, অনিয়মসহ নানা কুঘটনা।

এগুলো আমরা শুনে বিরক্ত বা দুঃখিত হই, কখনো রাগে অপমানে জ্বলে উঠি; কিন্তু বাস্তবে তার ভেতরে বাস করি না। এই দূরবর্তী অবস্থান এক ধরনের নির্মোহ দৃষ্টি তৈরি করে দেয়। সে কারণেই বিজয়ের ৫০ বছর উদযাপন একদিকে যেমন আনন্দ বন্যার ঢেউ বইয়ে দিয়েছে আরেক দিকে আছে প্রশ্ন।

একথা মানতেই হবে দেশের চেহারা আমূল পাল্টে গেছে। শেখ হাসিনার আমলে বাংলাদেশের অর্জন আর ইমেজ তাকে নিয়ে গেছে অন্য উচ্চতায়। যে গল্প আমরা শুনি বা যেসব দেখি তার প্রতি বিশ্বাস আর আস্থা রেখেই বলি অতটা না হলেও দেশ এগোচ্ছে। দুনিয়ায় মানুষ বাংলাদেশকে চিনতে শিখছে। একের পর এক সূচকে এগিয়ে থেকে বাংলাদেশ তার জন্ম দুশমন পাকিস্তানকে ফেলে এগিয়ে চলেছে দুর্বার গতিতে।

৫০ বছর পর পাকিস্তানের নতুন জেনারেশান বা সাধারণ মানুষের সঙ্গে বৈরিতার কারণ আছে কী নাই সে কথা থাক। পাকিস্তানের নাম উঠল এই কারণে তারা বলে দিয়েছিল স্বাধীন হয়ে নাকি বড় ভুল করেছে বাঙালি।

চিরকাল অশ্রদ্ধা আর খাটো করে দেখা বাঙালিকে কাঁধের সমান ভাবতে পারেনি তারা। বঙ্গবন্ধু দেশ স্বাধীনের পরই বলে দিয়েছিলেন বাংলাদেশ চিরকাল থাকার জন্য জন্ম নেয়া এক দেশ। তার ভাষায়, দাবায়ে রাখতে পারবে না কেউ।

এটা সত্য হয়েছে। তার কন্যার শাসনামলে পাকিস্তানের নাক উঁচু বুদ্ধিজীবীরাও ইমরান খানকে অনুরোধ জানিয়ে বলেন, আমাদের সুইজারল্যান্ডের স্বপ্ন দেখিয়ে লাভ নেই বাংলাদেশের সমান করে দেখাও। এসব কথাতেই স্পষ্ট আমাদের অগ্রযাত্রা। ভারতের মতো বিশাল প্রতিবেশীও টাস্কি খায় আমাদের অর্জনে। পাশের বাংলা থেকে অনেক দূর এগিয়ে বলিষ্ঠতায় তাদের পেছনে ফেলে এগিয়ে যাওয়া দেশের বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানও কি তেমন আকাশের মতো বড় আর উদার হওয়ার দরকার ছিল না? আর কোনোকালে কি ৫০ বছরের বিজয় দিবস ফিরে আসবে? আসবে না বলেই দু’-একটা কথা বলা জরুরি।

বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ ৭ মার্চের ভাষণ, তার সুদূরপ্রসারী দৃষ্টিভঙ্গির ফসল বাংলাদেশ। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস তো তিনি ছিলেন না। তাকে বন্দি করে পাকিস্তানের কারাগারে আটকে রেখেছিল পাকিরা। সে সময়কালে তার অনুগামী নেতৃত্ব যে সাহস আর প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছিলেন তার কি কোনো তুলনা হয়?

যখন সূর্যবিহীন আমাদের মাথার ওপরে আকাশ সম শেখ মুজিব নাই তখন দিশেহারা জাতিকে কারা শক্তি দিয়েছিলেন? প্রবাসী সরকার না হলে সৈয়দ নজরুল, তাজউদ্দীন আহমদ না থাকলে মুক্তিযুদ্ধের হাল ধরত কারা? এই যে হাজার হাজার মুক্তিসেনা, সেক্টর কমান্ডার, সর্বাধিনায়ক ওসমানী সবাই তখন একযোগে কাজ না করলে, ভারত পাশে না দাঁড়ালে ১৬ ডিসেম্বর কি আসত বাঙালির জীবনে? আসুন একবার ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকাই:

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধু সিরাজুল আলম খান ও তাজউদ্দীনের পরামর্শক্রমে স্বাধীনতা ঘোষণা দিতে সম্মত হন। এ সময় তাজউদ্দীন স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পরিমার্জন করে দেন। ২৫ মার্চ রাতে তিনি বঙ্গবন্ধুর পরামর্শক্রমে আত্মগোপন করেন নিজের পরিবারকে অরক্ষিত অবস্থায় রেখে। ২৭ মার্চ তিনি ভারতের উদ্দেশে রওনা হন। এর পরের গল্পটা তাজউদ্দীনের বঙ্গবন্ধুহীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা মোতাবেক সশস্ত্র সংগ্রামের নেতৃত্ব দেয়া। ২৮ মার্চ তিনি মেহেরপুর সীমান্ত দিয়ে ভারত যান আমির-উল ইসলামসহ। সেখানে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ তাদের পরিচয় নিশ্চিত হওয়াপূর্বক তাদের ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে ৪ এপ্রিল যোগাযোগের ব্যবস্থা করে দেন।

ইন্দিরা গান্ধী তাজউদ্দীনের সঙ্গে দেখা হওয়ার শুরুতেই প্রশ্ন করেন ‘মুজিব কেমন আছে? সে ঠিক আছে?’ জবাবে তাজউদ্দীন বলেন, ‘২৫ মার্চের পরে তার সঙ্গে আমার কোনো যোগাযোগ হয়নি, বঙ্গবন্ধু আমাদের দায়িত্ব দিয়ে এখানে পাঠিয়েছেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হয়েছে। যে কোনো মূল্যে আমাদের স্বাধীনতা অর্জন করতে হবে। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। শরণার্থীদের জন্য প্রয়োজন আশ্রয় ও খাদ্য।’

ওই বৈঠকে তাজউদ্দীন ইন্দিরা গান্ধীকে বাংলাদেশকে স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য অনুরোধ করেন। ইন্দিরা গান্ধী তাকে আশ্বস্ত করেন যথাসময়ে স্বীকৃতি দেয়ার ব্যাপারে। ওই বৈঠকে তিনি নিজেকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পরিচয় দেন। ৫ এপ্রিল তিনি আবার ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে আলোচনায় বসেন। স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারকে ভারতে অবস্থানের অনুমতি, সরকার পরিচালনায় সহায়তা, আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ে সহায়তা, শরণার্থীদের জন্য আশ্রয় ও খাদ্যে সহায়তা প্রদান, বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা ও মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র সহায়তা প্রদান, মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য বিমান প্রদানসহ অনেক সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

ভারত, রাশিয়া, পাকিস্তান, চীন, আমেরিকা এসব দ্বন্দ্ব সহজ কিছু ছিল না। সেগুলো সামাল দিয়েছিলেন কে? কাদের নেতৃত্বে শত অন্তর্কোন্দল বা ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটিয়ে আমরা স্বাধীন হতে পেরেছিলাম? এবারের বিজয় দিবসের বড় অনুষ্ঠান বিশেষত সরকারি আয়োজনে তাদের নাম কি উচ্চারিত হয়েছিল? আর যদি হয়েও থাকে তার কি কোনো গুরুত্ব ছিল? আবারো বলছি, বঙ্গবন্ধু যে আকাশের সূর্য বা আকাশের চাঁদ, সে আকাশের তারাদের ভুলে থাকা কি কাজের কথা?

কথায় কথায় রাজনীতি মনে করিয়ে দেয় আমাদের ইতিহাস বিকৃতির দায় জামায়াত-বিএনপির। কথা সত্য। এরশাদ আমলেও তাই হতো। বঙ্গবন্ধুর নাম পর্যন্ত বলা যেত না। মুক্তিযুদ্ধের দুশমনদের নাম-পরিচয় বলাও ছিল অপরাধ। সে কাল গত হয়েছে। তারা আজ বিপাকে। এখন একচ্ছত্র আধিপত্যের পরও সঠিক ইতিহাস সবাইকে নিয়ে বলার বাধা কোথায়? কিসের ভয়? কেন এই বিস্মরণ?

বিজয়ের অনুষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদসহ সবার অবদান স্বীকার করলে ইতিহাসই গর্বিত হতো। বলশালী হতো আমাদের দেশের ইমেজ। এত বড় আর বিশাল একটা অনুষ্ঠানে বানান ভুল নিয়ে যারা সামাজিক মিডিয়া গরম করে তুলছেন তাদের জন্য বলি, তার চেয়ে জরুরি ছিল সবাইকে নিয়ে, সবাইকে স্মরণ করে অতীতের প্রতি সম্মান জানানো। কেন আওয়ামী লীগের আমলে এটা হবে না?

এক ফুলে আর যা-ই হোক মালা তো গাঁথা হয় না। সে বরমালা গলায় দিতে না পারলে বাংলা মাকে কি অসাধারণ মনে হতে পারে। কুর্নিশ বঙ্গবন্ধু ও তার অনুগামী যোদ্ধা নেতা সহকর্মীদের। যাদের অবদানে আজ আকাশের সমান হতে চাইছে স্বদেশ।

লেখক: সিডনি প্রবাসী, সিনিয়র সাংবাদিক

নয়া শতাব্দী/এসএম

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ