যানবাহন ব্যবস্থার উন্নতি ও যানজট বিষয়ে প্রায় প্রতিদিনই সংবাদপত্রে প্রতিবেদন ছাপা হতে দেখা যায়। কোনোটা হয়তো কিছুটা আশার কথা বলে, কোনোটা আবার হতাশার। সড়ক দুর্ঘটনার খবরও বেশ ফলাও করে বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রতিনিয়ত ছাপা হয়। সংগত কারণেই প্রত্যেকের মনেই একটি ভীতির জন্ম নেয়, ঠিকমতো ঘরে ফেরা হবে তো!
কারণ যতই সমস্যা থাকুক, প্রতিদিন ঘর ছেড়ে তো বাইরে পা রাখতে হবেই। প্রতিদিন খেয়াল করি ঠিক কাঁটায় কাঁটায় ৫টা বাজার সঙ্গে সঙ্গেই অফিস ফাঁকা। অর্থাৎ ৫টা বাজার ১০-১৫ মিনিট আগে থেকেই প্রস্ততি বাড়ির পথে রওনা হওয়ার। কারণ প্রতি সেকেন্ডে ভিড় বাড়তে থাকবে অফিস ছুটির পর থেকে। কাজেই কিছুটা পেন্ডিং কাজ থাকলেও তা পরে দেখা যাবে, এখন তো বাড়ি ফিরি।
এটা তো ঠিক, বাড়িতেও তো কিছু কাজ রয়েছে। আবার অফিসে ঢুকতে কিছুটা দেরি হবেই। কারণ একই, যানজট। অর্থাৎ প্রতিদিন ৮ কর্মঘণ্টার মধ্যে প্রায় ১ ঘণ্টা করে কম কাজ আমরা করতে বাধ্য হচ্ছি। এটি নিঃসন্দেহে একটি জাতীয় ক্ষতি। এ ক্ষতির পরিমাণ ব্যাপক। এমনিতেই কোভিড আমাদের যথেষ্ট ক্ষতি করেছে, সেই সঙ্গে যানজটের পরিমাণ দুর্বিষহ মাত্রায় পৌঁছে গেছে।
ফলে ক্ষতিও বাড়ছে। এখন যেসব মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন সেগুলো চালু হলে মেট্রোরেলে চড়ে খুব দ্রুত মিরপুরের বাসিন্দা চলে যেতে পারবে মতিঝিল বা অন্য কোনো জায়গায়। তাই আপাত কিছুটা কষ্ট মেনেই নেয়া যায়। তবে এখন যে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে শহরের বাসিন্দাদের, তার সুরাহা কবে হবে- এ নিয়ে সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে। প্রকল্প বাস্তবায়নে কেনইবা এত ধীরগতি! এমনিতেই সরু রাস্তা, তার মধ্যে এখানে-ওখানে দেওয়াল তুলে রাখা হয়েছে দীর্ঘদিন থেকে। একটু আশ্বাস শহরবাসী আশা করতে পারে- এ অবস্থা কবে নিরসন হবে। ভারি পিলারগুলোর সঙ্গে খুব বড় করে বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠানের নাম, প্রকল্প শুরুর তারিখ, শেষ হওয়ার তারিখ লেখা থাকে কিন্তু বাস্তবায়নে কেন এত দেরি তার তথ্য নেই।
অপেক্ষার শেষ কবে, শহরবাসী তা জানে না। ওভারব্রিজ রয়েছে, বড় বড় পিলার তৈরি করতে হয়েছে, রাস্তা আরো সরু হয়েছে। বেশিরভাগ মানুষ যারা ওভারব্রিজ ব্যবহার করতে পারছেন না, তাদের জন্য তেমন কোনো সুখবর নেই। অর্থাৎ নির্মাণের কারণে মূল রাস্তার যে ক্ষতি হয়েছে, তার মেরামত তেমনভাবে গুরুত্ব পায়নি বা করা হলেও কিছুটা বৃষ্টির কারণে তা আবার নষ্ট হয়ে গেছে। চরম ভোগান্তি। শহরেই এ অবস্থা, শহরের বাইরের অবস্থা সহজেই অনুমেয়।
গত বৃহস্পতিবার। স্বভাবতই এই দিনে ঘরে ফেরা মানুষের তাড়া অনেক বেশি, তাই অফিস ফেরত মানুষের সংখ্যাও বেশি। যে কোনো যানবাহনে গাদাগাদি করে মানুষ ছুটছে বাড়ির পানে, কেউ কেউ হয়তো ঢাকার বাইরেও যাবে। আমিও অফিস ফেরত, ধরেই নিয়েছি মতঝিল থেকে মিরপুর মোটামুটি আড়াই থেকে ৩ ঘণ্টার পথ। দুঃসহ ট্রাফিক অনেকটা গা-সওয়া হয়ে গেছে, গত প্রায় ৪০ বছর থেকে এ অভিজ্ঞতা। তবে আগে এত খারাপ ছিল না, দিন দিন পরিস্থিতির অবনতিই হয়েছে। সুফল এখনো কিছু পাইনি, তবে আশায় রয়েছি। সরকারের যথেষ্ট সদিচ্ছা আছে, অনেক প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। এগুলো শেষ হলে অবস্থার উন্নতি হবে। এরই মধ্যে ঢাকা-কুমিল্লা রোডের যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে বলে জানতে পেরেছি।
তবে রাস্তাগুলো তৈরির সঙ্গে সঙ্গে এর রক্ষণাবেক্ষণের প্রতিও যত্নবান হওয়া দরকার। প্রায়ই দেখা যায়, নতুন রাস্তা অথচ এত বড় খাদের সৃষ্টি হয়েছে যে, জনজীবন অরক্ষিত হয়েছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে যানজট। শহরের রোজকার অভিজ্ঞতা, প্রচণ্ড গরমে বাসভর্তি মানুষ, ড্রাইভারের তীব্র মেজাজ, দরকষাকষি, চিৎকার, স্বাস্থ্যবিধি মানার বিফল প্রচেষ্টা, বিকট শব্দে হর্ন। কোনোমতে পাশ কাটিয়ে বের হয়ে যাওয়া মোটরসাইকেল, কে একটু আগে বের হবে তা নিয়ে বাকবিতণ্ডা আছেই। অনেকটা যুদ্ধ করেই বাড়িফেরা।
বিভিন্ন যানের একেকরকম শব্দ। একটি শব্দ কিছুটা অন্যরকম মনে হলো। উঁকি মেরে দেখার চেষ্টা করছি। সাদা গাড়ি, মাথার ওপরে লাল রঙের বাতি ক্রমে জ্বলছে আর নিভছে। আপ্রাণ চেষ্টা ড্রাইভারের, একটু তাড়াতাড়ি যদি কোনো হাসপাতাল পাওয়া যায়। অসহায় যে মানুষটি বিছানায় শুয়ে, মনে মনে নিজেকে সে জায়গায় নিয়ে চিন্তা করছিলাম। রোগাক্রান্ত মানুষটি কতটা অসহায় এ যানজটের কাছে। কিছুক্ষণ বাদে ঠিক আমার পাশেই এক ভদ্রলোক নেমে এসে আমার ড্রাইভারকে কিছু বলার চেষ্টা করলেন। কোনো একটা হাসপাতালের নাম জিজ্ঞসা করলেন হয়তো, বয়স্ক ভদ্রলোক, চোখে-মুখে স্পষ্ট চিন্তার ছাপ। অ্যাম্বুলেন্সে শুয়ে তার প্রিয় কন্যা, কোভিডের রোগী, দ্রুত চিকিৎসার প্রয়োজন, হয়তো সময়মতো চিকিৎসা পেলে সুস্থ হয়ে যাবে। কিন্তু কীভাবে? যেখানে প্রতিটি সেকেন্ড এখানে কাউন্ট হচ্ছে, সেখানে পথেই প্রায় আধঘণ্টা থেকে ১ ঘণ্টা লেগে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর যানজট কিছুটা হালকা হলে অ্যাম্বুলেন্সটিকে আর দেখতে পেলাম না। মনে মনে খুব দোয়া করছিলাম ভদ্রলোকের সন্তানটি যাতে সুস্থ হয়ে যায়। দ্রুত যাতে তিনি তার গন্তব্যে পৌঁছাতে পারেন। যানজটে ভিক্ষুকের কিছুটা সুবিধা হয়। এদের সংখ্যাও বেড়েছে বলে মনে হয়। যেখানে সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী আমাদের এখন মাথাপিছু আয় ভারতের চেয়েও কিছুটা বেশি, তাহলে এদের সংখ্যা বাড়ছে কেন? কেউ কেউ প্রচণ্ড ঝুঁকির মধ্যে ভিক্ষা করছে, যে কোনো সময় কোনো দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। আমাদের বিন্দুমাত্র পরিকল্পনা নেই এদের নিরাপত্তার জন্য। শিশু ভিক্ষুক, মায়ের কোলে চড়েও ভিক্ষা করছে। অসংখ্য ফেরিওয়ালা এবং তাদের রকমারি পণ্য, কোভিডের কারণে নতুন সংযোজন হয়েছে মাস্ক, হাতের গ্লাভস ইত্যাদি। এছাড়া কী নেই এদের কাছে। শুনেছি এদের আয়ও নাকি খারাপ নয়। এদের সংখ্যা ক্রমে বাড়ছে। এসব ‘মোবাইল হকার’ আমাদের অর্থনীতির কোন জায়গায় আছে। ধরে নেয়া যায়, সব খারাপ জিনিসের একটা ভালো দিকও আছে।
কারণ দীর্ঘ সময় পথে অপেক্ষা করায়, বিশেষভাবে নারীদের কাছে এগুলোর কিছু বিক্রিও হয়। প্রায় দীর্ঘ দুই বছর পর সব অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজ খুলতে শুরু করেছে। আরো জট বাড়বে, কবে আমাদের এসব নতুন সড়কব্যবস্থার উন্নতি হবে। এমআরটি চালু হবে। রাস্তার পাশের হকারদের একটা স্থায়ী জায়গা হবে, ক্রমাগত সড়ক দুর্ঘটনা কমবে। রাস্তায় অত্যন্ত নিন্মমানের এসব যান আর চলবে না। আমাদের সড়কের চেহারা, যানবাহনের চেহারা একটি উন্নয়নশীল দেশের মতো হবে সে আশায় বুক বেঁধে আছি।
এত স্বল্প আয়তনের একটি দেশে আমরা এত অধিক লোক বসবাস করছি। একটি পরিসংখ্যানে দেখলাম পৃথিবীর প্রায় ২ দশমিক ১১ শতাংশ লোক এখানে বাস করে, অথচ এর আয়তন মাত্র ১ লাখ ৪৮ হাজার ৫৬০ কিলোমিটার বা ৫৭ হাজার ৩৬০ স্কয়ার মাইলস। জনবসতির ঘনত্ব প্রতি স্কয়ার কিলোমিটারে প্রায় ১ হাজার ২৬৫। আমাদের প্রতিবেশী দেশে যার পরিমাণ ৪৬৪। অন্যদিকে দক্ষিণ কোরিয়ায় এর পরিমাণ ৫২৮, নেদারল্যান্ডসে ৫০৮, চীনে ১৫৩ প্রতি স্কয়ার কিলোমিটারে। এগুলো মেনেই পরিকল্পনা করতে হবে। অতীতে অবশ্য পরিকল্পনা হয়েছে, আমরা ডিসেন্ট্রালাইজেশনের কথা শুনেছিলাম কিন্তু তেমন বাস্তবায়ন হয়নি।
সেদিন এক ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তিনি মালদোভা থেকে এসেছেন। তার দেশের জনসংখ্যা মাত্র চার মিলিয়ন। দেশটিও ছোট, মাত্র ১৩ হাজার ৫০ স্কয়ার মাইলস। অর্থাৎ বাংলাদেশ ৪ দশমিক ৪ টাইমস বড়। কিন্তু জনসংখ্যার দিক থেকে ৪০ গুণ বেশি। রাস্তার ঘনত্ব সিঙ্গাপুরে সবচেয়ে বেশি। এরপর রয়েছে সুইজারল্যান্ড ও নেদারল্যান্ডস। বলাবাহুল্য, সড়ক অবকাঠামো একটি দেশের উন্নয়নের মাত্রানির্দেশক এবং জনগণের সুরক্ষা ও সন্তুষ্টিতে ভূমিকা রাখে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক সার্ভের মতে, এশিয়ান দেশগুলোর তুলনামূলক আলোচনায় দেখা যায়, সিঙ্গাপুর এশিয়ার মধ্যে সবার ওপরে রয়েছে এবং বিশ্বের দ্বিতীয় অবস্থানে।
এর পরে রয়েছে জাপান (৫), তাইওয়ান (১১)। দক্ষিণ কোরিয়ার অবস্থান ১৪, মালয়েশিয়া ২০ এবং চীনের অবস্থান ৩৯তম। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শ্রীলঙ্কার অবস্থান ৪৩, ভারত ৫১ এবং পাকিস্তান ৭৭। অপেক্ষাকৃত দুর্বল অবস্থায় রয়েছে ভুটান, ভিয়েতনাম ও বাংলাদেশ (১১৩)। শুধু নেপালের (১১৮) আগে। এগুলো অবশ্য ২০১৮ সালের পরিসংখ্যান। বাংলাদেশে এরই মধ্যে সড়ক পরিবহনব্যবস্থায় যথেষ্ট পরিবর্তন নিয়ে আসার ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। আশা করা যায়, আগামী দু-তিন বছরে পরিস্থিতি অনেক উন্নত হবে। সড়কব্যবস্থার উন্নতি হলে যানজটের পরিবর্তন হবে কিনা, সেটা নিশ্চিত করে আমরা জানি না। শহরবাসী বিশেষভাবে আকুল হয়ে আছে বিষয়টি সরকারের প্রাধিকার তালিকায় আসবে।
যাতায়াতব্যবস্থা এবং দেশের ভেতরে ও বাইরের কানেক্টিভিটি ব্যবসা প্রসারে প্রতিযোগিতা বাড়াতে অন্যতম সহায়ক। গত জুনে প্রকাশিত আইএফসির লজিস্টিকস খরচ হ্রাস এবং বাংলাদেশের ট্রেড লজিস্টিকস ও গ্রোথ শীর্ষক একটি গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা যায়, ন্যাশনাল হাইওয়েগুলোয় যদি ঘণ্টায় অন্তত ৪০ কিলোমিটার গতি নিশ্চিত করা যায় তাহলে রফতানি ৩ দশমিক ৭ শতাংশ বাড়তে পারে।
সড়কব্যবস্থায় উন্নয়ন আমাদের একটি অগ্রাধিকার এলাকা। দেশের অভ্যন্তরের যানজট নিরসনে যেমন সমন্বিত পরিকল্পনা দরকার, যে বিপুল পরিমাণ জনশক্তি, জ্বালানি খরচ আমাদের হচ্ছে, তা নিরসনে এবং একইসঙ্গে ব্যবসার ক্ষেত্রে বিনিয়োগ আকর্ষণে একটি পরিকল্পিত সড়ক ব্যবস্থাপনা আমাদের অগ্রাধিকার। এর বাস্তবায়নে আরো মনোযোগী হওয়া এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া অতি জরুরি। ট্রান্সপোর্ট খাতটি দেখাশোনার জন্য সরকারের পাঁচটি মন্ত্রণালয় এবং ২১টি এজেন্সি কাজ করছে। এদের রেগুলেটরি রেসপনসিবিলিটিগুলো সঠিকভাবে পরিকল্পিত বণ্টন দরকার, সঠিক সমন্বয় ও প্রকল্প সঠিক সময়ে বাস্তবায়ন এবং খরচ নিয়ন্ত্রণে সর্বোপরি সরকারি খরচের স্বচ্ছতা বিশেষভাবে জরুরি। এটা বুঝতে হবে আমাদের অপেক্ষা করার সময় নেই।
লেখক : প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, বিজনেস ইনিশিয়েটিভ লিডিং ডেভেলপমেন্ট (বিল্ড)
নয়া শতাব্দী/এসএস
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ