বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি (বিইআরসি) আইন ২০০৩-এর ৪২ ধারামতে বিইআরসির আইনলঙ্ঘন একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। সে অপরাধের শাস্তির দায়ে অর্থদণ্ড কিংবা কারাদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) প্রস্তাবে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ ডিজেল ও কেরোসিনের মূল্য লিটারপ্রতি ১৫ টাকা বৃদ্ধি করেছে।
বিইআরসি আইনের ৩৪(৪) উপধারা মতে, পেট্রোলিয়াম পণ্যসহ সব জ্বালানির মূল্য পক্ষগণের শুনানির ভিত্তিতে নির্ধারণের একক এখতিয়ার বিইআরসির। বিপিসি বিইআরসির লাইসেন্সি। লাইসেন্সি হিসেবে মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব বিপিসিকে ওই আইনের ৩৪(৬) ধারামতে, বিইআরসির কাছে পেশ করতে হবে। কিন্তু বিপিসি বিইআরসির পরিবর্তে ডিজেল ও কেরোসিনের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগে পাঠায় এবং কারচুপির আশ্রয় নিয়ে জ্বালানি বিভাগকে দিয়ে মূল্যবৃদ্ধি ও কার্যকর করায়।
তাতে প্রতিভাত হয়, বিপিসি ওই আইনের ৩৪(৬) উপধারা লঙ্ঘন করে এখতিয়ারবহির্ভূতভাবে ওই মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব জ্বালানি বিভাগে পাঠায় এবং জ্বালানি বিভাগ ৩৪(৪) উপধারা লঙ্ঘন করে সে প্রস্তাবে মূল্যবৃদ্ধি করে বিইআরসির আইন সুনির্দিষ্টভাবে লঙ্ঘন করেছে। সুতরাং এ অপরাধের দায়ে বিপিসি এবং জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যায়। এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেয়ার এখতিয়ার আইনের ৪৭ ধারায় বিইআরসির। ক্যাব বিইআরসির কাছে এ ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছে।
সব কাজ সরকার করে জনস্বার্থে এবং তার কৃতকর্ম দ্বারা জনগণের কল্যাণ নিশ্চিত হয়। ওই মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব জ্বালানি বিভাগে পাঠানো এবং ওই বিভাগ কর্তৃক মূল্যবৃদ্ধি করা বিইআরসি আইনের পরিপন্থী। এই বিষয়টি সরকারের উচ্চ পর্যায়ে অবহিত করা হলে এলপিজির মতো ডিজেল ও কেরোসিনের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব বিইআরসিতে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হতো। কিন্তু বাস্তবে বিপিসি এবং জ্বালানি বিভাগ বিষয়টি উপস্থাপনে বিরত থেকে স্বীয় বিবেচনায় মূল্যবৃদ্ধি করেছে। এর ফলে সরকারের ভাবমূর্তি বিপন্ন এবং ভোক্তাদের কাছে সরকার অপ্রিয় হবে। এমন পরিস্থিতির দায় বিপিসি ও জ্বালানি বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের।
সম্প্রতি উচ্চ আদালতের নির্দেশে এলপিজির মূল্যহার নির্ধারণ করেছে বিইআরসি। সরকারি মালিকানাধীন এলপিজিসিএলের এলপিজির মূল্য বিপিসির প্রস্তাব সূত্রে নির্ধারণ হবে এই অজুহাতে জ্বালানি বিভাগ এলপিজির মূল্য নির্ধারণ বিইআরসির আওতাবহির্ভূত রাখার জন্য তাকে চিঠি দেয়। সেই চিঠির সূত্রে আদালত অবমাননার অভিযোগ এনে ক্যাবের পক্ষ থেকে লিগ্যাল নোটিশ দেয়া হয়। ওই নোটিশের পরিপ্রেক্ষিতে চিঠিটি স্থগিত করে জ্বালানি বিভাগ ক্যাব ও ক্যাবের আইন উপদেষ্টাকে লিখিতপত্রে অবহিত করে। এতে আদালত অবমাননার মামলা করার প্রক্রিয়া থেমে যায়। এই উভয় ঘটনা বিপিসি এবং জ্বালানি বিভাগ যথাযথভাবে অবহিত থাকা সত্ত্বেও তারা কেরোসিন ও ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধি করেছে। তাদের এমন কাজ সরল বিশ্বাসে হয়েছে- এমন বিবেচনায় সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে তাদের দায়মুক্তি দেয়া যায় না।
সুতরাং সরকারের পক্ষে, সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে, সরকারের আদর্শ জনকল্যাণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে জনস্বার্থে তারা এ কাজ করেননি। গণস্বার্থবিরোধী কাজ করে সরকারকে বিতর্কিত করা এবং সরকার ও ভোক্তাদের মুখোমুখি দাঁড় করানোর দায়ে ক্যাব তাদের অভিযুক্ত করেছে।
মূল্যবৃদ্ধির প্রতিক্রিয়ায় ক্যাব জানিয়েছে, করোনা পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হয়েছে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড মোটামুটিভাবে স্বাভাবিক গতি পাচ্ছে। তা সত্ত্বেও বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সেবা ও পণ্যের মূল্য অস্বাভাবিক বৃদ্ধির কারণে ভোক্তারা চাপের মধ্যে আছে। জ্বালানি একটি কৌশলগত পণ্য। যার মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব জীবনযাত্রাকে নানাভাবে প্রভাবিত করে। মানুষ ব্যয় সংকোচন করে সে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে বাধ্য হয়। অর্থাৎ মানুষের ভোগ ব্যয় হ্রাস পায়।
বলার অপেক্ষা রাখে না, ডিজেল ও কেরোসিনের মূল্যবৃদ্ধিতে ভোক্তার ক্রয়ক্ষমতা কমে গেল। ইতোমধ্যে পরিবহন ভাড়া বেড়ে গেছে। পণ্য পরিবহন ব্যয় বাড়ায় পণ্যের মূল্য বেড়ে গেছে। বিদ্যুতের মূল্য বাড়বে। কারণ বিদ্যুতে ব্যবহৃত ডিজেলের পরিমাণ ২৬ শতাংশ। কৃষিতে ব্যবহৃত ডিজেলের পরিমাণ ১৬ শতাংশ। সে ক্ষেত্রে কৃষি উৎপাদন ব্যয় বাড়বে। যদি এসব ক্ষেত্রে ব্যবহৃত ডিজেলের মূল্য না বাড়ে, তাহলে যে ভর্তুকি সমন্বয়ের অজুহাতে তেলের মূল্য বাড়ানো হলো, সে উদ্দেশ্য সফল হবে না।
অন্যদিকে, ভোগব্যয় হ্রাস পাওয়ায় বাজারে ক্রয়-বিক্রয় কমে যাবে। এতে ব্যবসা-বাণিজ্য সংকটে পড়বে এবং সরকারের ভ্যাট-ট্যাক্স আদায় কম হবে। বাজেটে ভ্যাট-ট্যাক্স থেকে যে পরিমাণ রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে তা অনেকখানি পূরণ হবে না, অর্থাৎ বাজেট ঘাটতির শিকার হবে। সে ঘাটতি পূরণের জন্য সরকার ব্যাংক থেকে ঋণ নেবে। ফলে ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্প খাতে ঋণপ্রবাহ কমে যাবে। তারা বিনিয়োগ সংকটে ভুগবে। সরকার সেখান থেকেও ভ্যাট-ট্যাক্স বঞ্চিত হবে। এ অবস্থায় আগামী বছরে এই ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি যথেষ্ট পরিমাণে হ্রাস পাবে বলে আশঙ্কা করা যায়। এই মূল্যবৃদ্ধির কারণে যে পরিমাণ অর্থ সমন্বয় হবে, আর এর ফলে সরকার যে পরিমাণ ভ্যাট-ট্যাক্স থেকে বঞ্চিত হবে সেই বিষয়টি যদি বিবেচনা করা সম্ভব হতো, তাহলে জ্বালানি বিভাগ কখনই মূল্যবৃদ্ধির ঝুঁকি নিত না। কিন্তু তাদের কাছে কখনই এ ধরনের বিচার-বিশ্লেষণ ছিল না, এখনো নেই। তারা সর্বক্ষেত্রে মনগড়া কাজ করে। এসব বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের দক্ষতা ও সক্ষমতা নিয়ে বরাবরই প্রশ্ন ছিল। এখন তাদের স্বচ্ছতা ও সততা নিয়ে প্রশ্ন তোলার সময় এসেছে।
করোনাকালে আমরা হার মানিনি। আমাদের অর্থনীতি ঈর্ষণীয় সমৃদ্ধ হয়েছে। আমাদের প্রবৃদ্ধি অব্যাহত আছে। অথচ আমাদের প্রতিবেশী দেশের অর্থনীতি প্রচ-ভাবে বিপর্যস্ত। সেখানকার অর্থনীতি বিপর্যস্ত হওয়ার পেছনে করোনা পরিস্থিতি যতটা না দায়ী, তার চেয়ে বেশি দায়ী করা হয়েছে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিকে। এমন ঝুঁকি সত্ত্বেও যারা মূল্যবৃদ্ধি করলেন তাদের বিচার-বিবেচনাবোধ কতখানি মানসম্মত তা নিয়ে এখন সংশয় দেখা দিয়েছে। অর্থনীতির এমন বিপর্যস্ত পরিস্থিতি সৃষ্টি করার জন্য ক্যাব বিপিসি ও জ্বালানি বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের অভিযুক্ত করেছে। এই পরিস্থিতিতে সরকারের কাছে বিশেষভাবে অনুরোধ, বিপিসি এবং জ্বালানি বিভাগ প্রাতিষ্ঠানিকভাবে অবৈধ উপায়ে ডিজেল ও কেরোসিনের মূল্যবৃদ্ধি করে যেভাবে সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করেছে, তাদের এ অপরাধ অক্ষমনীয়।
এর পেছনে অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে কিনা, তা অনুসন্ধান জরুরি।
যেসব ভোক্তা শতভাগ বিদ্যুৎসুবিধার আওতায় আসেননি এবং যেসব ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী রাস্তায় কেরোসিন তেল পুড়িয়ে খাদ্য তৈরি করেন, দরিদ্র পথচারীদের কম মূল্যে আহার জোগান, এই মূল্যবৃদ্ধির কারণে সেসব হতদরিদ্র মানুষের সঙ্গে যে অমানবিক আচরণ করা হলো, ভোক্তারা সেই আচরণকে সরকারের আচরণ হিসেবে অনুভব করে হতভম্ব। এ রকম পরিস্থিতি উন্নয়নকামী সরকারের কাছে প্রত্যাশিত নয়। কারণ, আমরা ২০২১ সালের অনেক আগেই নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করেছি। এখন আমাদের মাথাপিছু আয় ২২৪৫ ডলার। ২০৩১ সালে মাথাপিছু আয় ৪০০০ ডলারের ওপরে উন্নীত হবে, তা এখন আর কল্পনার বিষয় নয়। অথচ সে লক্ষ্য অর্জনে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি এক ধরনের অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করেছে। সুতরাং যারা এই পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছেন, তাদের কোনোভাবেই দায়মুক্তির সুযোগ নেই।
ইতোমধ্যে পরিবহন মালিক ও শ্রমিক সমিতি সমন্বিতভাবে ধর্মঘট ডেকেছে। কিন্তু তারা অবৈধ উপায়ে ভাড়া বৃদ্ধিও করেছে। বিআরটিএ ভাড়া বৃদ্ধির জন্য আইনানুগ কর্তৃপক্ষ, রোববার ভাড়া বৃদ্ধির ব্যাপারে সভা আহ্বান করেছে। সেই সভায় নিঃসন্দেহে ভাড়া বৃদ্ধি হবে। করোনার অজুহাতে তারা এক দফায় ভাড়া বৃদ্ধি করেছে, যদিও তা বৃদ্ধির কোনো যৌক্তিক কারণ নেই। করোনার কারণে তারা ধারণক্ষমতার অর্ধেক যাত্রী পরিবহন করবে, স্বাস্থ্যসম্মত পরিবহনসেবা দেবে- সেই অজুহাতে ভাড়া বৃদ্ধি করেছে। কিন্তু তারা সেই শর্ত মানেনি। এখন আরেক দফায় ভাড়া বাড়বে।
পরিবহন মালিকরা বেআইনিভাবে ভাড়া বৃদ্ধি করেছেন। তবে তার প্রতিকার ও প্রতিরোধের নৈতিক সামর্থ্য জাতির বা সরকারের আর নেই। কারণ, সরকারের শাসন বিভাগের শীর্ষ কর্মকর্তারা জোটবদ্ধ হয়ে অবৈধভাবে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি করেছেন একদিকে, অন্যদিকে অবৈধভাবে ভাড়াও বাড়ানো হয়েছে। সর্বোপরি আইন লঙ্ঘনের উৎসব চলছে। সমাজ প্রতিরোধ ও প্রতিকারের ক্ষমতা হারিয়েছে।
লেখক : জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও ক্যাবের উপদেষ্টা
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ