জানি না সরকার কেন এই ইস্যুটাকে এতকাল ধরে জিইয়ে রেখেছে। হিন্দু ও মুসলিম পারিবারিক আইন নিয়ে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের নেতৃত্বে ও বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার আয়োজিত অসংখ্য সভা, সমাবেশ, মিছিল, মানববন্ধন, স্মারকলিপি প্রদান করে এই আইনগুলোর প্রগতিমুখী এবং নারী অধিকারের স্বীকৃতি দাবি করে দীর্ঘকাল ধরে একদিকে আন্দোলনের মাধ্যমে অপরদিকে লেখালেখি ও প্রতিনিধি দল মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠিয়ে আসছে। সরকারও দাবিগুলো পূরণে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। অপরাপর কারণের মধ্যে বাংলাদেশের সংবিধানে ধর্মীয়, বর্ণগত এবং লৈঙ্গিক ভিন্নতার কারণে কোনো প্রকার বৈষম্যমূলক আইন প্রণয়ন ও সংরক্ষণ করতে অধিকারী নন। এসব জেনেশুনেও বিলম্ব ঘটছে কোনো এক অজানা কারণে।
এক মুহূর্তের জন্যও একথা ভুলে গেলে চলবে না যে পাকিস্তানের মতো আপস ও তয়-তদবির করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আসেনি। এই স্বাধীনতা কষ্টার্জিত লাখো হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান নারী-পুরুষের রক্তে সারাদেশ রঞ্জিত করে অর্জন করতে হয়েছে। তাই এদেশে সবার সমান অধিকার থাকতেই হবে এবং তার অঙ্গীকার ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত দশকের পর দশক ধরে জাতির সামনে প্রকাশ করা হয়েছে। পরিণতিতে মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে অত্যন্ত দ্রুততা ও আন্তরিকতা এবং নিষ্ঠার সঙ্গে বাহাত্তরের ঐতিহাসিক সংবিধান প্রণয়ন করে ওই বছরের ৪ নভেম্বরেই তা সংসদে সর্বসম্মতিক্রমে অনুমোদন লাভ করে। এই সংবিধানের মূলনীতিতে লিখিত হয় বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হবে গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদ। এগুলো পাকিস্তানের তাবৎ আদর্শ ও নীতিবিরোধী এবং দেশ-বিদেশে প্রশংসিত।
এর সঙ্গে থাকল, দেশে এমন কোনো আইন প্রণয়ন করা যাবে না যা সংবিধানে গৃহীত মূলনীতিসমূহের পরিপন্থী। আর নিশ্চয়তা দেয়া হলো আইনের শাসনের। সঙ্গে স্পষ্টাক্ষরে লিখিত থাকল, আইনের দৃষ্টিতে সবাই সমান তাই ধর্ম, গোষ্ঠী, লিঙ্গ বা বর্ণগত কারণে কোনো নাগরিকের প্রতি কোনোরূপ বৈষম্য করা যাবে না। যাবে না ধর্মের নামে কোনো রাজনৈতিক দল গড়া বা রাজনীতি করা।
হিন্দু ধর্মীয় আইন কোনো দেব-দেবতা প্রণয়ন করেননি। কোনো ধর্মগ্রন্থে, যেমন গীতা, বেদ, উপনিষদ, রামায়ণ বা মহাভারতেও হিন্দু পারিবারিক আইন বলে কোনো আইনের ন্যূনতম উল্লেখও নেই।
পূজা-পার্বণের ক্ষেত্রে দেখা যায় হিন্দু সম্প্রদায় সাধারণত ছয়টি দেব-দেবীর পূজা করে থাকেন। তার মধ্যে মহা ধুমধামে যে পূজাটি করা হয় তা হলো দুর্গাপূজা। দুর্গাকে মাতৃরূপী দেবী বলে অভিহিত করা হয়। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সমগ্র হিন্দু সমাজ বাংলাদেশে, ভারতে ও পৃথিবীর নানা দেশে সর্বাধিক আন্দোলিত হয়ে থাকেন। দুর্গাপূজা বস্তুতই একটি উৎসবের সাংস্কৃতিক দিকও উজ্জ্বল। প্রায় ৫ দিন ধরে এই পূজা বা মাতৃ আরাধনা করে থাকেন শিশু কিশোর-যুবক-বৃদ্ধ-বৃদ্ধা নির্বিশেষে। অপরাপর দেব-দেবী যাদের পূজা করা হয় তারা হলেন কালী, লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক ও নারায়ণ। শেষের দুজন পুরুষ দেবতা কিন্তু যদিও কার্তিক পূজা বছরে এক দিন অনুষ্ঠিত হয় তার খবর কোনো হিন্দুই রাখে না। তবে নারী লক্ষ্মী দেবীর পূজা মহাধুমধামে প্রায় সব বাড়িতেই অনুষ্ঠিত হয়। আর সরস্বতী পূজা-জ্ঞানদাত্রী সরস্বতী পূজাও ব্যাপকভাবে আয়োজিত হয় বিশেষ করে হিন্দু শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের অদম্য উৎসাহে।
এই বক্তব্যের দ্বারা আমি যা বুঝাতে চাইছি তা হলো হিন্দু ধর্মে নারীকে দেবীর আসনে বসানো হয়েছে, সর্বাধিক সম্মানও তাদের দেয়া হয়েছে। তাই নারীর সেই মর্যাদা সব ক্ষেত্রে সমুন্নত রাখতে হবে।
আবার হিন্দু ধর্মে যেসব কুসংস্কার ছিল যেমন স্বামীর মৃত্যু হলে বধূকেও একই চিতায় একসঙ্গে পুড়িয়ে মারা, বিধবাবিবাহ প্রথা চালু করা প্রভৃতি তো মহাজ্ঞানী ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রাজা রাম মোহন রায় কোনো কালে সেই ইংরেজ আমলে চালু করে গেছেন। এই সংস্কারের সুফল নারীরা আজও উপভোগ করছেন, ভবিষ্যতেও তা অব্যাহত থাকবে। হিন্দু ধর্মের কি এতে ক্ষতি হয়েছে? পরবর্তীতে প্রণীত হয়েছে বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন। যদিও প্রচলিত হিন্দু আইন তার অনুমোদন দিয়ে থাকে কিন্তু রাষ্ট্র প্রণীত এই আইনের বিরোধিতা তো কাউকে করতে দেখি না। কারণ নিশ্চয়ই এই যে, ওই বিরোধিতা যদি কেউ করে, সে বা তারা হালে পানি পাবে না। জেলেও যেতে হতে পারে।
কিন্তু সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে নারীসমাজ, বিশেষ করে তাদের ধর্মনিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক এবং অরাজনৈতিক সংগঠন যখন এই পুরনো এবং নারী অধিকারবিরোধী হিন্দু পারিবারিক ও হিন্দু উত্তরাধিকার আইন সংশোধনের দাবি তোলেন। মহিলা পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি বেগম সুফিয়া কামাল, তার পূর্বসূরি বেগম রোকেয়া, মানবাধিকার কর্মী সুলতানা কামাল, প্রয়াত রাখী দাস পুরকায়স্থ, নানা এনজিও এবং ব্যাপকসংখ্যক হিন্দু পুরুষ হিন্দু আইনের দ্রুত সংস্কার দাবি করে রাজপথে নেমেছেন। সরকারও এ দাবিগুলোর প্রতি সহমর্মিতা জ্ঞাপন করেছে।
কিন্তু এক শ্রেণির হিন্দু মৌলবাদী হিন্দু পারিবারিক ও উত্তরাধিকার আইনের বিরোধিতায় সর্বশক্তি নিয়োগ করেছেন। তাদের মূল আপত্তির জায়গাটা হলো হিন্দু উত্তরাধিকার আইনে পৈতৃক সম্পত্তিতে নারীদেরও সম-অধিকারের ও হিন্দুবিবাহ বাধ্যতামূলক রেজিস্ট্রেশনের দাবির প্রশ্নের। যে বিপুলসংখ্যক মানুষ এই সংস্কারের দাবিগুলোকে সমর্থন করেন তাদের তারা আওয়ামী লীগবিরোধী বলে সম্প্রতি প্রকাশ্য বক্তব্য রেখেছেন।
অথচ তারা নিশ্চয়ই জানেন, আজ থেকে প্রায় ৭০ বছর আগে হিন্দুপ্রধান দেশ উত্তরাধিকারসহ সব ক্ষেত্রে হিন্দু ও মুসলিম নারী-পুরুষের, এমন কি বয়োপ্রাপ্ত নারী-পুরুষের স্বেচ্ছায় ধর্মান্তরিত হওয়ার অধিকারের স্বীকৃতি দিয়ে ভারতের সংবিধান সংশোধন করেছেন। কী হিন্দু, কী মুসলমান কোনো ভারতীয়ই এ আইনের বিরোধিতা করে না। যত বিরোধিতা সব বাংলাদেশের অতি ক্ষুদ্র কিছুসংখ্যক হিন্দু মৌলবাদীর।
তাদের কথা হলো, এ দেশে হিন্দুরা সংখ্যায় কম-তাই অন্যায়ের প্রতিরোধ ক্ষমতাও কম। তার ওপর যদি মেয়েরা পিতার সম্পত্তির অংশ বিশেষ উত্তরাধিকার হিসেবে পায় তবে ওই মেয়েদের প্রাপ্ত সম্পত্তির লোভে মুসলিমরা ফুসলিয়ে ওই মেয়েদের বের করে নিয়ে বিয়ে করবে ও ধর্মান্তরিত করবে। অদ্ভুত যুক্তি বটে। হিন্দু মেয়েরা লেখাপড়া শিখছে, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছে, এদের মধ্যে অনেকেই বিত্তশালী পিতার সন্তান ফলে সোনার গহনা সজ্জিত এবং পার্সে অনেক টাকাও অনেক সময় থাকে।
ওই ধনীর সন্তান মেয়েরা বিয়ের আগে ও পরে দিব্যি বিশাল অঙ্কের টাকা নিয়ে দামি গাড়িতে চড়ে নয়নাভিরাম বিপণিগুলোতে প্রকাশ্যে দামি সোনা-হীরা-মুক্তার গহনা, শাড়ি, থ্রি-পিস প্রভৃতি কিনে নিরাপদেই তো ঘরে ফিরছেন। এ ধরনের উদাহরণের খুব একটা অভাব নেই। বাস্তব হলো যেহেতু হিন্দু মেয়েরা কদাপি সম্পদের মালিকানা পায় না এবং সাধারণত গৃহিণী তাই তাদের স্বামীর মৃত্যুর পরে স্বামীর বিপুল সম্পত্তি থাকা সত্ত্বেও অসহায়ত্বের শিকারে পরিণতও হন এবং তখন কেউ কেউ স্বেচ্ছায় ধর্মান্তরিতও হন সচ্ছল সংসারে বিয়ে করেন। ভারতবর্ষের সমাজে ব্রিটিশ আমলে অসংখ্য হিন্দুকে টাকার বিনিময়ে খ্রিস্টান বানানো হয়েছে। আজও যে তা আদৌ হয় না তা ঠিক না। উগ্রপন্থি হিন্দুদের তাতে তো তেমন আপত্তি দেখি না। আবার বিত্তশালী পরিবারের মেয়ের সঙ্গে হিন্দু ছেলেদেরই মেয়ে বা তার অভিভাবকদের অসম্মতিতে জোর করে বিয়ের ঘটনাও তো আছে।
যেসব হিন্দু মেয়ে লেখাপড়া শিখে চাকরি-বাকরি ব্যবসা-বাণিজ্য করে তাদের তো হিন্দু মৌলবাদীরা বন্ধ করতে বলেন না? কৈ অমন ধরনের মেয়েদের অপহরণ, জোর করে ধর্ষণ বা ধর্মান্তরিত করে বিয়ে করার ঘটনা নেই এমন দাবি কেউ করে না। তা প্রতিরোধ করতে পারে সামাজিক সচেতনতা, অসাম্প্রদায়িক আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি ও আইনের শাসন।
ওই মৌলবাদীরা নির্লজ্জের মতো বলেছেন, ‘আমরা হিন্দুরা তো আওয়ামী লীগের ভোটব্যাংক। কিন্তু যারা হিন্দু মেয়েদের উত্তরাধিকার আইন সংস্কার করে সম্পত্তির মালিকানা দেয়ার পক্ষে হিন্দু আইনের সংস্কার দাবি করেন, তারা হিন্দু সম্প্রদায়কে আওয়ামী লীগবিরোধী ভূমিকায় নিয়ে যেতে চায়। অদ্ভুত যুক্তিই বটে। এ দাবির সঙ্গে ভোটের আদৌ কোনো সম্পর্ক নেই বরং দাবিগুলো মেনে নিতে সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং তা যত দ্রুত কার্যকর করবে সরকার তত বেশি জনপ্রিয় হবে।
প্রাচীনকালের অনেক পুরনো এবং অধুনা পরিত্যাজ্য বহু বিধিবিধান হিন্দু অধ্যুষিত ভারতই শুধু নয়, পোলও সংস্কার করে নারীর সমানাধিকারের স্বীকৃতি দিয়ে নারী সমাজকে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর সুযোগ করে দিয়েছে।
বিদেশে অবস্থানকারী এক শ্রেণির হিন্দু মৌলবাদীরাও বাংলাদেশের হিন্দু পারিবারিক আইন পরিবর্তনের তীব্র বিরোধিতা করছেন। তারা তো আমেরিকা বা ওইসব উন্নত দেশের নাগরিকত্ব সপরিবারে নিয়ে দীর্ঘকাল বসবাস করছেন। সেখানে কিন্তু হিন্দু নারীর তাবৎ অধিকার স্বীকৃত মৃত পিতার সম্পত্তিতে স্ত্রীর আধিকার সর্বাগ্রে এবং তা হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান নির্বিশেষে। স্ত্রীর মৃত্যুর পরেই কেবল সন্তানেরা উত্তরাধিকার পেয়ে থাকে। ওখানে তো তারা কেউ ওই আইনের সংস্কার দাবি করেন না। দাবি করলে ঘর ভাঙবে এমন আশঙ্কা আর কী? অথবা ওইসব দেশে কি হিন্দু ধর্মকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে_যার জন্যে তার সংস্কার দাবি করা বিপজ্জনক।
আশা করব, সংসদের আগামী অধিবেশন দীর্ঘতর হবে এবং সেখানে হিন্দু পারিবারিক ও উত্তরাধিকার আইনের প্রগতিমুখী সংশোধনী পাস করে পিতার সম্পত্তিতে নারীত্ব সম-অধিকার বিবাহ রেজিস্ট্রেশন বাধ্যতামূলক ও যুক্তিযুক্ত কারণে স্ত্রী স্বামীকে এবং স্বামী স্ত্রীকে তালাক দানের অধিকারের সপক্ষে আইন প্রণয়ন করবেন।
লেখক : একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক ও কলামিস্ট
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ