সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ বাংলাদেশ। হাজার হাজার বছর ধরে এদেশের ভূখণ্ডে নানা জাতির মানুষ মিলেমিশে বসবাস করছে। এদেশের সবুজ-শ্যামল প্রকৃতির মতো মানুষের অন্তরও অত্যন্ত কোমল ও পরমতসহিষ্ণু। যুগে যুগে ধর্মীয় গোড়ামি কিছু সময়ের জন্য মাথাচাড়া দিয়ে ওঠলেও বাঙালির সম্মিলিত প্রতিবাদের মুখে ধর্মীয় মৌলবাদ নিস্তেজ হয়ে পড়ে।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন মুহূর্তে শারদীয় দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে কুমিল্লাসহ দেশের কয়েকটি জেলায় মণ্ডপ-মন্দির ভাঙচুর ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর যে নজিরবিহীন হামলা সংঘটিত হয় তাতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে বিশ্বাসী মানুষরা দারুণভাবে ক্ষুব্ধ হয়েছেন। সাম্প্রদায়িক উগ্রবাদ বারবার বাংলার মাটিতে অপরাজনৈতিক কৌশল হিসেবে ব্যবহার করেছে কিছু সুবিধাবাদী, সুযোগসন্ধানী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ।
এরা চিরকালই বাঙালির সম্মিলিত প্রগতিকে স্তব্ধ করার জন্য মৌলবাদকে উসকে দিয়েছে। আজও রাজনৈতিকভাবে দেউলিয়াগ্রস্ত জনবিচ্ছিন্ন দলগুলো মৌলবাদীদের কাঁধে ভর করে বাংলাদেশকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে ওঠে-পড়ে লেগেছে। অতীতেও এরা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ছিল, বর্তমানেও এরা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে গিয়ে নানারকম অনৈতিক পন্থা অবলম্বন করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধূলিসাৎ করার ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত আছে।
১৯৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে যখন ভারত-পাকিস্তান বিভক্ত হয়, তখন থেকেই সাম্প্রদায়িক বিষবৃক্ষ রোপিত হয় বাংলার মাটিতে। সে সময়ের কিছু ধর্মান্ধ মানুষ পবিত্র ইসলাম ধর্মের দোহাই দিয়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর নির্মম অত্যাচার চালায়। দেশ ভাগের পর ভারত-পাকিস্তানে যে অস্থিরতা তৈরি হয় তার রেশ এখনো তীব্রভাবে অনুভূত হচ্ছে। সাম্প্রদায়িক সহিংসতা বাংলাদেশে বহুবার আঘাত হানলেও কখনই তা স্থায়ী হতে পারেনি। বাংলার শান্তিপ্রিয় মানুষ সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধিকে পাশ কাটিয়ে উদার মানবিকতার পথে দৃপ্ত পায়ে পথ চলেছে।
দীর্ঘদিন ধরে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশকে অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত করার পাঁয়তারা করছে একটি স্বার্থলোভী মহল। এদের পেছনে প্রচুর অর্থলগ্নি করছে বাংলাদেশবিরোধী চক্র। শুধু অর্থ নয়, অস্ত্র দিয়েও এই মৌলবাদী গোষ্ঠীকে সহায়তা করছে পর্দার আড়ালের অপশক্তি। এদের খুঁজে বের করে উপযুক্ত শাস্তি দেয়া এখন সময়ের দাবি। বর্তমান সরকারের কাছে এদেশের মানুষ মৌলবাদীদের উসকানিদাতাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রত্যাশা করে। এদের শাস্তি না দিলে এদেশের মাটি থেকে কিছুতেই এসব হার্মাদদের দমন করা সম্ভব নয়।
১৯৫২ সালে ধর্মের দোহাই দিয়ে বাংলার মাটিতে প্রথম রক্ত ঝরে ভাষা আন্দোলনের অগ্নিঝরা মুহূর্তে। বাঙালি ঐক্যবদ্ধ হয়ে সে সময়ের বিরূপ পরিবেশে জয়ী হয় অসংখ্য প্রাণের বিনিময়ে। স্বাধিকার আদায়ের লক্ষ্যে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু যখন বাঙালির বাঁচার দাবি ৬-দফা ঘোষণা করল পাকিস্তানি মদদে আবার সক্রিয় হয়ে ওঠে মৌলবাদীচক্র। ১৯৬৬ সালেও বাঙালির সম্মিলিত প্রচেষ্টায় তারা পরাজিত হয়। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের সময়েও বাংলাদেশকে উত্তপ্ত করা হয়েছিল ধর্মের দোহাই দিয়ে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বাঙালি জাতি যেন কিছুতেই নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করতে না পারে সে জন্যও পাকিস্তানি স্বৈরাচারী সরকার মৌলবাদী গোষ্ঠীকে পেছন থেকে ইন্ধন জুগিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর লৌহকঠিন নেতৃত্বে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে ঐতিহাসিক বিজয় লাভ করে সংগ্রামী, ঐক্যবদ্ধ বাঙালি।
বাঙালিদের সেই নিরঙ্কুশ বিজয়ে হতাশ হয়ে পড়ে পাকিস্তানি সরকার ও তাদের পোষ্য মৌলবাদী গোষ্ঠী। এরপর ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলার মাটিতে উগ্র সাম্প্রদায়িক শক্তি যে নজিরবিহীন নির্যাতন চালায়, ইতিহাসে সেসব বিবরণ লিপিবব্ধ আছে। মুক্তিযুদ্ধকে বানচাল করার জন্য ইসলাম ধর্মের দোহাই দিয়ে অনেক অপপ্রচার চালিয়েছে সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী। স্বাধীনতাকামী বাঙালি জনগোষ্ঠীর অনমনীয় মনোবলের কাছে পরাজিত হয় পাকিস্তানি সরকার ও তাদের এদেশীয় দোসররা। তারা এখনো সুযোগ খুঁজছে বাংলাদেশকে মৌলবাদী রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য। বাংলাদেশকে যদি প্রকৃত অর্থেই বাঙালি একটি শান্তিপ্রিয়, অসাম্প্রদায়িক জনপদে পরিণত করতে চায় তাহলে অবশ্যই ১৯৭১ সালের চেতনায় আবার নতুন করে জেগে ওঠতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাই পারে ক্ষুধামুক্ত, ধর্মনিরপেক্ষ, উন্নত বাংলাদেশ গড়তে। পৃথিবীর নানা দেশেই ধর্মীয় মৌলবাদী গোষ্ঠী যেমন- আল কায়েদা, আইএস, বোকোহারাম, জেএমবি, তালেবান মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল, সেগুলো কিছুদিন শান্তিশৃঙ্খলা নষ্ট করে আস্তে আস্তে শেষ হয়ে যাচ্ছে। বর্তমান পৃথিবীর মানুষ ধর্মে বিশ্বাস করলেও ধর্মীয় উগ্রবাদকে কিছুতেই মেনে নিতে চাচ্ছে নাÑ এটা মৌলবাদী গোষ্ঠীকে বুঝতে হবে। ধর্মের আবরণে পৃথিবীতে যারা অধর্মকে প্রতিষ্ঠিত করে গোষ্ঠীগত ফায়দা লুটতে চায়, আজ সময় এসেছে তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর। এদের বিষদাঁত ভেঙে দিয়ে সুন্দর দেশ ও বিশ্ব গড়ার দায়িত্ব নিতে হবে মুক্তমনের প্রগতিশীল মানুষদের। ধর্মীয় বিদ্বেষ, সাম্প্রদায়িক হানাহানি, সন্ত্রাস ও যুদ্ধ পরিহার করে শান্তির পথে এগিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার করতে হবে সবাইকে। সামাজিক সম্প্রীতি রক্ষা করতে হলে শান্তির পথেই অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে হবে।
বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নজিরবিহীন উন্নয়ন হয়েছে। ভারতীয় উপমহাদেশের অনেক রাষ্ট্রের চেয়ে বাংলাদেশ বিভিন্ন সূচকে এগিয়ে আছে। দেশের এই অগ্রগতি দেশবিরোধীচক্র কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। তারা একটি অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করে উগ্রধর্মীয় অনুশাসন প্রবর্তন করে বাংলাদেশকে পিছিয়ে দিতে চাচ্ছে। এদেশের মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিতে চাচ্ছে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প। কারা এসব অপকর্মের সঙ্গে যুক্ত আছে তাদের খুঁজে বের করতে হবে। আমরা দেখেছি বিভিন্ন সময়ে একটি মহল অপরাজনীতিকে স্বাগত জানাতে চেষ্টা করেছে। চিহ্নিত এসব দেশদ্রোহীরা উপযুক্ত শাস্তি না পেয়ে বহাল তবিয়তে আছে। কেন তাদের শাস্তির মুখোমুখি দাঁড় করানো হচ্ছে না- এ নিয়ে জনমনে অসন্তোষ বৃদ্ধি পাচ্ছে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করে যারা ঘোলা জলে মাছ শিকার করতে চায়, তারা দেশ ও জাতির শত্রু। এসব দেশদ্রোহী, উন্নয়নবিমুখ শত্রুদের সমূলে উৎপাটন করার জন্য এখনই সরকার ও জনগণের ঐক্যবদ্ধ কর্মপরিকল্পনা দরকার।
একটি রাষ্ট্র যখন গঠিত হয় তখন সেখানে নানা সম্প্রদায়ের লোক এসে ভিড় জমায়। এই নানা সম্প্রদায়ের ভাব-ভাষা-সংস্কৃতিও হয় নানারকমের। আর এই জন্যই পৃথিবীর প্রায় সব রাষ্ট্রেই দেখা যায় বর্ণিল সংস্কৃতি। এই বহুবর্ণতাই রাষ্ট্রের প্রাণ। এই বহুবর্ণতা চাই বলেই আমরা ক্রসেড কিংবা জেহাদ চাই না, আল কায়েদা কিংবা বোকো হারাম চাই না, চাই না তালেবান কিংবা আইএস-আনসারউল্লাহ বাংলা টিমের মতো ভয়ঙ্কর জঙ্গি সংগঠন। ধর্মনিরপেক্ষতা এই বহুবর্ণ সংস্কৃতিকে টিকিয়ে রেখে রাষ্ট্রীয় ঐক্য বা ভৌগোলিক ঐক্য স্থিতিশীল রাখে। এ কথাটি রাজনীতির কবি বঙ্গবন্ধু বুঝতে পেরেছিলেন বলেই সংবিধানে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ সন্নিবেশিত করেন। দেশ তখন ভালোই চলছিল। দেশে আর যাই থাকুক, কোনো ধর্মীয় সন্ত্রাস ছিল না, ওই পরিস্থিতিতে যা ছিল একান্তই স্বাভাবিক। কারণ তখন কম-বেশি সবার হাতেই অস্ত্র ছিল। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে সবাই ধর্মীয় পরিচয় মুছে ফেলে বাঙালি জাতির ঐক্য তৈরি করে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সবকিছু তছনছ করে দেয়। দেশ চলে যায় ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে আসা জেনারেল বা স্বঘোষিত জেনারেলদের বুটের তলায়। যেমনটি হয়েছিল আইয়ুব ও ইয়াহিয়ার আমলে। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পরে বাংলাদেশে একাত্তরের পরাজিত শক্তি গোপনে গোপনে সুযোগ খুঁজতে থাকে, তাদের এই সুযোগকে বাস্তবায়ন করেন জেনারেল জিয়াউর রহমান। জেনারেল জিয়া বাংলাদেশকে পাকিস্তানি ভাবধারায় নিয়ে যাওয়ার জন্য মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের ক্ষমতার ভাগ দেন এবং সংবিধানের মূলনীতিতে পরিবর্তন আনেন। জিয়াউর রহমান ছিলেন বাংলাদেশকে পাকিস্তানি ধারায় নিয়ে যাওয়ার প্রধান প্রভাবক।
মানুষের ধর্মবিশ্বাস থাকে কিন্তু রাষ্ট্রের কোনো ধর্ম থাকে না। থাকা উচিতও নয়। কারণ সব ধর্মের লোকই রাষ্ট্রে বসবাস করে। কোনো ধর্মকে বেশি প্রাধান্য দিলে রাষ্ট্রের অন্য ধর্মাবলম্বীগণ হীনতা বোধ করেন এবং বঞ্চিত হন। তাই উন্নত বিশ্বের দিকে তাকালে দেখা যায় সেসব রাষ্ট্রের রাষ্ট্রধর্ম বলে কিছুই নেই। সাম্প্রতিক সময়ে আফগানিস্তানে তালেবানদের উত্থানে এদেশের উগ্র মৌলবাদী গোষ্ঠী নতুন করে জেগে উঠেছে, ভারতেও বিজেপি সরকারের এক অংশের মদদে হিন্দুত্ববাদ উগ্রতা ছড়াচ্ছে। এসব কারণে ধর্মান্ধ গোষ্ঠী ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’কে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানোর স্পর্ধা দেখাচ্ছে। ধর্মীয় মৌলবাদ চিরতরে বিনষ্ট করতে না পারলে মানব সভ্যতা হুমকির মুখে পড়বে।
১৯৭২ সালে রচিত বাংলাদেশের সংবিধান অত্যন্ত সুন্দর একটি সংবিধান। ওই সংবিধানে জেনে বুঝেই বাংলাদেশকে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র বলা হয়েছিল। কিন্তু ১৯৭৫ পরবর্তী কালপর্বে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত ও ৩ নভেম্বর জেলহত্যাকা- সংঘটিত হওয়ার পর কেটে-ছিঁড়ে বিকলাঙ্গ করা হয় বাংলাদেশের সংবিধান। তাতে সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান ‘বিসমিল্লাহ’ যুক্ত করেন ও স্বৈরাচারী এরশাদ ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম বলে ঘোষণা করেন। এটা তারা ধর্মকে ভালোবেসে করেননি, করেছিলেন ধর্মকে ব্যবহার করে সাধারণ মানুষকে প্রতারিত করতে। আজ সময় এসেছে ১৯৭২ সালের সংবিধানে ফিরে যাওয়ার। যেই সংবিধানে বঙ্গবন্ধু, জাতীয় চার নেতাসহ সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্যদের স্বাক্ষর ছিল যেই সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতাসহ চার মূলনীতি ছিল সেই সংবিধানই পারে আমাদের সার্বিক মুক্তি নিশ্চিত করতে। আমরা বিশ্বাস করি, বাঙালির ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা মৌলবাদকে রুখে দেবে।
লেখক : রাজনীতিবিদ, কলামিস্ট, প্রাবন্ধিক, গীতিকার ও মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ