ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

প্রধান উপদেষ্টার ভাষণ বিশ্লেষণ ও জনগনের প্রত্যাশা 

প্রকাশনার সময়: ২৬ আগস্ট ২০২৪, ২১:০৪ | আপডেট: ২৬ আগস্ট ২০২৪, ২১:০৭

৮ আগস্ট রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নেয়ার ১৮ দিনের মাথায় জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিলেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তার এই ভাষণটি দেশবাসীর কাছে সরকারের ভবিষ্যত কর্মসূচির এক ‘দিক নির্দেশনা’ বলে বিবেচিত হচ্ছে। বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার জনগন মনে করছেন, এই ভাষণের মধ্য দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার তার বর্তমান ও ভবিষ্যত পরিকল্পনার একটি ‘সময়োপযোগী খসড়া’ জাতির সামনে তুলে ধরেছেন। ভাষণের প্রতিটি অংশে যে উদ্যোগ ও স্বপ্নের কথা তুলে ধরেছেন প্রধান উপদেষ্টা; তা অবশ্যই ধন্যবাদযোগ্য। ভাষণটিতে যেমন আশা জাগানিয়া কিছু উদ্যোগের কথা রয়েছে, তেমনি বেশ কিছু বিষয়ে খুব কৌশলী ছিলেন প্রধান উপদেষ্টা। ভাষণটিতে প্রধান উপদেষ্টা খুব কোমল স্বরে কঠোর অনেক বার্তা দিয়েছেন বলে মনে হয়েছে। নোবেল জয়ী এই বাংলাদেশী শাসনকর্তার ভাষণ নিয়ে এখন চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। তবে জনগণ চায়, ভাষণটিতে থাকা প্রতিটি বিষয়ের যথাযথ পদক্ষেপ নেবেন ড. ইউনূস। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করে যে পরিবর্তনের আশা জাগিয়েছে, জনগণ চায় কর্মপদ্ধতির মাধ্যমে সে আশার বাস্তবায়ন ঘটাবে এ সরকার।

প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস তার বক্তব্যে বিচার বিভাগ, পুলিশ, প্রশাসন, নির্বাচন কমিশন, অর্থনীতি, শিক্ষা-স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন খাতে সংস্কারের যে উদ্যোগের কথা তুলে ধরেছেন, তেমন সংস্কার দেশের প্রতিটি জনগন চায়। ভাষণে তিনি দুর্নীতি ও দুর্নীতির শ্বেতপত্র প্রকাশ ও ব্যাংক কমিশন গঠন নিয়ে যে উদ্যোগের বিষয়টি উল্লেখ করেছেন, সেটাও সাধুবাদযোগ্য। জনগণ এক্ষেত্রে নিরপেক্ষতা-স্বচ্ছতা ও সম্পূর্ণ রাজনৈতিক লক্ষ্যমুক্ত পদক্ষেপ কামনা করে। কারো জন্য সুযোগ সৃষ্টি বা কারো প্রতি বিদ্বেষ এমনটি চায় না জনগণ। তেমনটি যদি হয়, তাহলে বৈষম্য কিন্তু থেকেই যাবে।

ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা সবাইকে ধৈর্য্য ধারণের আহবান জানিয়ে বলেছেন, ‘এখনই সব দাবি পূরণ করার জন্য জোর করা, প্রতিষ্ঠানে ঢুকে ব্যক্তিবিশেষকে হুমকির মধ্যে ফেলা, মামলা গ্রহণের জন্য চাপ সৃষ্টি করা, বিচারের জন্য গ্রেপ্তারকৃত ব্যাক্তিকে আদালতে হামলা করে আগেই এক ধরনের বিচার করে ফেলার যে প্রবণতা তা থেকে বের হতে হবে।’- প্রধান উপদেষ্টাকে ধন্যবাদ বিষয়গুলো আমলে নেয়ার জন্য। অবশ্যই সব দাবি এতো অল্প সময়ে পূরণ করা সম্ভব নয়। কিছুটা সময় প্রয়োজন দাবির যৌক্তিকতা পর্যালোচনার জন্য। কিন্তু প্রতিষ্ঠানে ঢুকে ব্যক্তি বিশেষকে হুমকির মধ্যে ফেলা, মামলা গ্রহণের জন্য চাপ সৃষ্টি এবং আদালত প্রাঙ্গণে যারা হামলা-হেনস্থা ও নাজেহালের শিকার হয়েছেন; সেসব ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে সরকার কি করছে তা দেখার অপেক্ষায় জনগণ।

ড. ইউনূস তার ভাষণে গত ১৫ বছরের দুর্নীতি, অর্থ পাচার ও জনস্বার্থ বিরোধী চুক্তি স্বাক্ষর প্রকল্পের নামে লুটপাট ইত্যাদি তথ্য নিয়ে শ্বেতপত্র প্রকাশের যে কথা বলেছেন জনগণের এতে দ্বিমত থাকার কথা নয়। তবে জনগণ সবচেয়ে বেশী খুশী হবে অন্তর্বর্তী সরকারের সব উপদেষ্টার সম্পদের হিসাব বিবরণী যথাযথভাবে পেলে। পাশাপাশি সব সরকারি কর্মকর্তার সম্পদের হিসাব বিবরণী নিয়মিত ও বাধ্যতামুলক করার যে প্রতিশ্রুতি ভাষণে পাওয়া গেছে, তারও বাস্তবায়ন চায় জনগণ।

ভাষণের একটি অংশে প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, ‘গণরোষের মুখে ফ্যাসিবাদী সরকার দেশত্যাগ করার পর আমরা এমন একটি দেশ গড়তে চাই, যেখানে প্রতিটি নাগরিকের মানবাধিকার থাকবে পুরোপুরি সুরক্ষিত। আমাদের লক্ষ্য একটিই। উদার, গণতান্ত্রিক বৈষম্যহীন, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ। আমরা এক পরিবার। আমাদের এক লক্ষ্য। কোনো ভেদাভেদ যেন আমাদের স্বপ্নকে ব্যাহত করতে না পারে, সে জন্য আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।’- এই অংশে ড. ইউনূস যে দেশ গঠনের স্বপ্নের কথা বলেছেন, তা বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিকের স্বপ্ন। তিনি বাস্তব অর্থে এ পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে গেলে জনগণ অবশ্যই তাকে সহায়তা করবে বলে বিশ্বাস করি। তবে ‘আমরা এক পরিবার। আমাদের লক্ষ্য এক।’- বলতে, তিনি দল-মত নির্বিশেষে বিজয়ী-পরাজিত সবার প্রতি ইঙ্গিত করেছেন কি-না সেটি স্পষ্ট নয়।

জাতির উদ্দেশে ভাষণে ড. ইউনূস বলেছেন, ‘আমরা কেউ দেশ শাসনের মানুষ নই। আমাদের নিজ নিজ পেশায় আমরা আনন্দ পাই।’- ভাষণের এই অংশটি ইঙ্গিত দেয়, হয়তো সত্যিকার অর্থে লক্ষ্য পূরণের কাজটি শেষ করে অন্তর্বর্তী সরকার একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি করে বিদায় নেবে। এমনটি যদি তিনি প্রকৃত অর্থে মন থেকে বলেন, তাহলে রাষ্ট্র এবং সমাজে নতুন এক আলো ছড়িয়ে পড়ার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।

তবে প্রধান উপদেষ্টার এ ভাষণের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অংশটি হলো- ‘একটা বিষয়ে সবাই জানতে আগ্রহী, কখন আমাদের সরকার বিদায় নেবে। এটার জবাব আপনাদের হাতে, কখন আপনারা আমাদের বিদায় দেবেন।’ অর্থাৎ এ বিষয়ে তিনি জনগনের ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে গুরুত্ব দিয়েছেন। অন্তর্বর্তী সরকার তাদের কর্মকাণ্ডের যে প্রতিশ্রুতি প্রকাশ করেছে, তা সম্পন্ন হতে কিছুটা যে সময় প্রয়োজন সেটা এরই মধ্যে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

এ প্রসঙ্গে ড. ইউনূস আরো বলেছেন, ‘কখন নির্বাচন হবে, সেটা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত; আমাদের সিদ্ধান্ত নয়। দেশবাসীকে ঠিক করতে হবে আপনারা কখন আমাদের ছেড়ে দেবেন। আমরা ছাত্রদের আহ্বানে এসেছি। তারা আমাদের প্রাথমিক নিয়োগকর্তা। দেশের আপামর জনসাধারণ আমাদের নিয়োগ সমর্থন করেছে। আমরা ক্রমাগতভাবে বিষয়টি স্মরণ করিয়ে যাবো, যাতে হঠাৎ করে এই প্রশ্ন উত্থাপিত না হয়, আমরা কখন যাবো। তারা যখন বলবে, আমরা চলে যাবো।’

এই অংশটিতে প্রধান উপদেষ্টা ছাত্র-জনতার উপর সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভার দিয়েছেন। আবার তিনি রাজনৈতিক পক্ষকেও বিবেচনায় রেখেছেন। এখানে খুব চমৎকারভাবে সরকারের লক্ষ্য অর্জনের জন্য প্রয়োজনীয় সময় গ্রহণের বিষয়টির মাহাত্ম খুঁজে পাওয়া যায়। ‘আমরা ক্রমাগতভাবে বিষয়টি স্মরণ করিয়ে যাবো, যাতে হঠাৎ করে এই প্রশ্ন উত্থাপিত না হয়, আমরা কখন যাবো। তারা যখন বলবেন, আমরা চলে যাবো।’- বক্তব্যের এ অংশটিতে প্রধান উপদেষ্টা তাদের থাকা বা চলে যাওয়ার বিষয়ে সম্ভবত ছাত্র ও জনগণের ম্যান্ডেটের কথা বুঝিয়েছেন। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক পক্ষের ইচ্ছা-অনিচ্ছার উপর নির্ভর করছে না অন্তর্বর্তী সরকারের সময়কাল। যেটি সরকারের যাত্রা শুরুর দিকে একাধিক উপদেষ্টাও উল্লেখ করেছেন। ফলে যারা খুব দ্রুত বা যৌক্তিক সময়ে অথবা সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনের দাবি তুলে চলেছেন, তারা হয়তো সে দাবি নিয়ে আপাততঃ আর বেশীদূর এগোনোর সুযোগ পাবেন না।

লেখক: উপ-সম্পাদক, দৈনিক নয়া শতাব্দী

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ