মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২ আশ্বিন ১৪৩১

দুধের মাছি অনেকের ভোল পাল্টে গেছে

প্রকাশনার সময়: ২৬ আগস্ট ২০২৪, ০৭:২১

গত ১৫ বছরে দেখা গেছে ১৫ আগস্ট ছিল একটি মাতম করার দিন। যেমন করে মহরমের দিন মাতম করে শিয়া মুসলিমরা ঠিক তেমনভাবে কিছু কথিত সুশীলের মাতমে দেশের রাজপথ ভরে যেত। কথিত বঙ্গবন্ধু প্রেমীদের হায় বঙ্গবন্ধু হায় মুজিব মাতমে দেশের আকাশ বাতাস কেপে উঠত। গত ১৫ আগস্টে তাদের টিকিটার নাগালও পাওয়া যায়নি। এদেরকে কোনো রাস্তাঘাটে দেখা যায়নি। গত ১৫ বছরে ধরে এ মাতমী কাতারে থাকা একজনের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, কেন এবার তারা ১৫ আগস্টে রাস্তায় আসেনি তার কারণ কী? তিনি উত্তর দিলেন, একজনকে নাকি ৩২ নম্বরে দিগম্বর করা হয়েছে, ১৫ আগস্ট পালন করতে গিয়েছিল বলে, তাই সেই ভয়ে তিনিও ঘর থেকে বের হননি। আমি বললাম ফেসবুকেও তো একটা পোস্ট দিতে পারতেন, তখন আর কোনো উত্তর তিনি দেননি।

এই হচ্ছে তাদের বঙ্গবন্ধু প্রেম। এই মাতমকারীরা গত ১৫ বছর মাতম করে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি আবু আহসান মোহাম্মাদ সামসুল আরেফিন সিদ্দিক যাকে সবাই আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক নামে চেনে। তিনি হলেন বঙ্গবন্ধু পরিষদের কেন্দ্রীয় সভাপতি। এবারের ১৫ আগস্টে তাকে দেখা যায়নি এবং তিনি ফেসবুকেও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে একটি কথা বলেননি। তিনি একজন জ্ঞানী ও বিদ্যান মানুষ। শেখ হাসিনা সরকারের তিনি ছিলেন হাসিনার অন্যতম পরামর্শদাতা। বৈষম্য নিরোধ ছাত্র আন্দোলন দমন করতে র‍্যাব হেলিকপ্টার থেকে আকাশপথে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি ছোড়ে।

এ বিষয়টি কি তার নজরে আসেনি। এ ধরনের একজন শিক্ষাবিদ হয়ে কেন শেখ হাসিনাকে হেলিকপ্টার থেকে গুলি বর্ষণ না করার জন্য পরামর্শ দিলেন না। ১৫ আগস্ট জাতির কাছে একটি শোকাবহ দিন। তাই জাতি চায় এমন দিন যেন জাতির ভাগ্যে আর না আসে। হেলিকপ্টার থেকে গুলি বর্ষণ করাটাও যে একটি গণহত্যা, এ হত্যাকাণ্ড প্রেক্ষিতে সারা জাতি শোকে শোকাতুর। এ হত্যাকাণ্ড ঘটানোটি যে ন্যক্কারজনক তা কি আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বুঝতে পারছেন। যদি তিনি বিষয়টি বুঝে থাকতেন তাহলে তার তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ করে বঙ্গবন্ধু পরিষদ থেকে পদত্যাগ করা উচিত ছিল। যেহেতু তিনি তা করেন নাই তাহলে বুঝতে হবে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তার শোকে মাতম করার বিষয়টি ছিল লোক দেখানো এবং পদ ভাগানোর জন্য। তার শোকের আবহে কখনো কোনো বঙ্গবন্ধু প্রেম ছিল না।

তার শোক ছিল ক্ষমতায় যাওয়ার এক ধরনের অভিনয়। এ রকম বহু শিক্ষক বাংলাদেশে আছেন। বাংলাদেশে দেশপ্রেমিক শিক্ষককের খুবই অভাব রয়েছে। আবার একটি নেই বললে বড় ধরনের ভুল হবে না। পদ পদবির জন্য শিক্ষকরা ছুটেন সরকারের পা চাটতে, আর অপরদিকে প্রহর গোনেন বিরোধী রাজনৈতিক দলের শিক্ষকরা কবে দল ক্ষমতায় আসবে। দেশে কি হচ্ছে বা হবে তা নিয়ে তাদের মাথা ব্যথা নেই। এই হলো দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার নির্দেশকদের হাল। আরেক বঙ্গবন্ধুপ্রেমী সাদেকুল মাতিন, তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের শিক্ষক ছিলেন। তার বঙ্গবন্ধু প্রেম এতটাই ছিল যে, বঙ্গবন্ধুর প্রতি শোক দেখাতে দেখাতে জনপ্রিয় নেতায় পরিণত হয়ে যান অল্প সময়ের মধ্যে। এবং প্রতিদান হিসেবে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি তাকে বানায় হাসিনা সরকার। বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি থাকাকালীন সময়ে তার কর্মকাণ্ড এতটাই কলঙ্কময় ছিল যে, ভবিষ্যতে এ রেকর্ড কেউ ভাঙতে পারে কি না এ বিষয়ে সন্দেহ রয়েছে। তার গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়া জেলায়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীন সময় তার এলাকার একজনকে বঙ্গবন্ধু পরিষদ রাজশাহী মহানগরীর নেতা বানান। জানা গেছে, মাতিনের বানানো নেতা ব্যাংক থেকে পাঁচ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছিল। তাই তিনি নিজেকে জেলের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য কিছু অর্থ ব্যয় করে বঙ্গবন্ধু পরিষদের নেতৃত্বটা কিনে নেয় মাতিনের কাছ থেকে। আর বঙ্গবন্ধু পরিষদের নেতা হওয়ার ফলে তার সাত খুন মাফ হয়ে যায়। ব্যাংক থেকে পাঁচ কোটি টাকা হাতানোর দায়ে দুদক তাকে গ্রেপ্তার করেছিল। তারপর যখন সে বঙ্গবন্ধু পরিষদের দাপুটে নেতা হয়ে যান, তখন তার ওপর দুদকের দায়ের করা সব কিছুই বাতিল হয়ে যায়। কবিকুঞ্জ নামে একটি সাহিত্য সংস্কৃতি সংগঠন খুলে রাতারাতি দেশসেরা কবি বনে যান। বঙ্গবন্ধু পরিষদের নামে রাজশাহী নগরীর মিয়া পাড়া এলাকায় একটি বাড়িও তিনি দখল করেন। সেই বাড়িতেই বঙ্গবন্ধু পরিষদের সাইন বোর্ড টানান। সেই সঙ্গে স্থাপন করে তার কবি কুঞ্জের কার্যালয়। এভাবেই বঙ্গবন্ধুর নামে দখলদারিত্বটা জায়েজ করেন কবিকুঞ্জের নেতা। রাজশাহী অ্যাসোসিয়েশন, পাবলিক লাইব্রেরিসহ সাহিত্য সংস্কৃতির যেসব সরকারি বা জেলা প্রশাসকের আওতাধীন প্রতিষ্ঠান রয়েছে প্রতিটিতে তার কর্তৃত্ব স্থাপন করেন অল্প সময়ের মধ্যে। রাজশাহী অ্যাসোসিয়েশনের বেশ কয়েকটি দোকান তিনি নিজের মালিকানায় নিয়ে নেন। আরেক বঙ্গবন্ধুপ্রেমী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক। তিনি ইমিরেটস অধ্যাপক খেতাব এবং পদটি পেয়েছেন। বঙ্গবন্ধু নাম ভাঙিয়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট মেম্বারসহ নানা পদ লাভ করেন। তিনি শিক্ষক নিয়োগ বাণিজ্যের বড় কারবারিও ছিলেন। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে কামিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। তবে ২০২৪ সালের ১৫ আগস্ট তিনি ছিলেন গর্তের মধ্যে, তার টিকিটাও কোথাও দেখা যায়নি। তার ফেসবুক পেইজেও বঙ্গবন্ধুকে উদ্দেশ্য করে কোনো স্ট্যাটাসও দেননি। তার বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায়। যত দূর জানা যায় পৈতৃক সূত্রে তিনি পাকিস্তানি প্রেমী, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাবশালী হওয়ার জন্য তিনি হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুপ্রেমী। শুধু ক্ষমতা আর পদটির জন্য বঙ্গবন্ধু মুজিব মুজিব মাতম করতেন।

জাফর ইকবাল সাবিপ্রবির শিক্ষক ছিলেন এখন অবসরপ্রাপ্ত। ১৯৭১ সালে তিনি তার নানাদের সঙ্গে পাকিস্তানি সেনা বাহিনীদের সঙ্গে ছিলেন। এক কথায় বলা যায় রাজাকার। শেখ হাসিনার ১৫ বছর শাসনামলে তিনি উৎকৃষ্ট বঙ্গবন্ধুপ্রেমী হয়ে গিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস লিখতে লিখতে তিনি উচ্চাসনে ্অধিষ্ঠিত হন। বর্তমানে কানাঘুষায় শোনা যাচ্ছে যে, তার জনৈক আত্মীয় ড. ইউনূস সরকারের প্রভাবশালী ব্যক্তি, তার পরশে হয়তো তিনিও আবার প্রদীপের শীর্ষে চলে আসতে পারেন।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি মীজানুর রহমান, তিনি যুবলীগের সভাপতি হতে পারলে চাকরি ছেড়ে দেবেন, এমন কথাটি ঘোষণা দিয়েছিলেন। যুবলীগ একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠান সেখানে তিনি যেতে পারলে বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে বেশি আয় করতে পারবেন। তাই তিনি শিক্ষকতা তথা ভিসির পদটিও ছাড়তে রাজি হয়ে যান। দেশের দুর্নীতি কোন পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল একটু ভেবে দেখুন। যারা এ দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলত তাদেরকে এই কথিত বঙ্গবন্ধুপ্রেমী শিক্ষকরা রাজাকার বলে গালাগাল দিত। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নৈতিক চরিত্র এমন এক নিম্নপর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল যে, তাদের পচনে সারা জাতি পচতে শুরু করেছিল, এ পচনের হাত থেকে দেশকে রক্ষা করতে ছাত্র জনতা গর্জে ওঠে। যার ফলে ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার বিপ্লবে শেখ হাসিনার পতন হয়। রাজশাহীর কিছু সাংবাদিক গত সরকারের তল্পী বাহক হয়ে বিপুল সম্পদের মালিক হন। তাদের একজনকে এখন দেখা যায়, বৈষম্য নিরোধকারী আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের পক্ষে কাজ করতে।

ড. ইউনূস সরকারের উচিত সব ধরনের চামচাকে উপযুক্ত শিক্ষা দেয়া, যাতে করে ভবিষ্যতে এ ধরনের চামচা সৃষ্টি হতে না পারে।

লেখক: কলামিস্ট

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ