‘ভাই বানের পানি সব ভাসাইয়া নিছে। দুই দিন ধরে কিছু খাই না। আশ্রয়কেন্দ্রে খাবার যায় নাই। কিছু খেতে দিন, পেটে খিদা।’- ফেনী জেলার ছাগলনাইয়া উপজেলার বাসিন্দা মো. কাইয়ুম এভাবেই বন্যা ও তার অবস্থার কথা প্রকাশ করে। শুধু কাইয়ুম নন, ফেনী জেলার বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দাদের এখন এই অবস্থা। বিশেষ করে যেসব পরিবার মহসড়ক বা সড়ক এলাকা থেকে একটু দূরে অবস্থান করছে, তাদের জীবনধারণ খুব কঠিন হয়ে উঠেছে। ফেনীর কিছু প্রত্যন্ত এলাকায় এখনো ত্রাণ পৌঁছেনি বলে জানা গেছে। ফেনীর ছাগলনাইয়া, ফুলগাজী, পরশুরাম, ফেনী সদর, দাগনভূঞা ও সোনাগাজী এলাকাজুড়ে এখনও বন্যার পানিতে ডুবে আছে বিভিন্ন এলাকা। বৃষ্টি না থাকায় পানি কমছে, তবে মানুষের খাদ্য, পানি ও ওষুধের হাহাকার বাড়ছে।
শুধু ফেনী নয়, ফেনীসহ বন্যাকবলিত ১১ জেলা কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ব্রাক্ষণবাড়িয়া, সিলেট, লক্ষীপুর ও কক্সবাজারের বিভিন্ন এলাকায় কমবেশী এ পরিস্থিতির দেখা মিলবে। এসব এলাকার অনেকাংশেই রয়েছে বিশুদ্ধ খাবার পানির সঙ্কট, ক্ষুধা লাগলেও খাবার মিলছে না অনেকের, একদিকে বিদ্যুৎ নেই; অন্যদিকে আলো জ্বালানোর জন্য মোমবাতি মিলছে না। নেই মোবাইল যোগাযোগ ব্যবস্থা। তার উপর ত্রাণের অপ্রতুলতা। বিশেষ করে ফেনী ও নোয়াখালীর অবস্থা খুবই সঙ্গীন। এসব এলাকার প্রত্যন্ত অনেক স্থানে মানুষ মহাবিপদে আছে।
জানা গেছে, সাত জেলায় বন্যায় শনিবার পর্যন্ত ১৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। এসব এলাকায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় ৫১ লাখ মানুষ, প্রায় ১০ লাখ পরিবার পানিবন্দী। বন্যা কবলিত এলাকায় ৩ হাজার ৫শ’১৩টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এসব আশ্রয়কেন্দ্রে রয়েছে প্রায় সাড়ে তিন লাখ মানুষ। অর্থাৎ বিপুল পরিমাণ মানুষ এখনো আশ্রয়কেন্দ্রের বাইরে রয়েছেন। আর সবচেয়ে বেশী সঙ্কটে রয়েছেন আশ্রয়কেন্দ্রের বাইরে থাকা এই মানুষগুলো। এদিকে বন্যা কবলিত এলাকায় চিকিৎসা সেবায় ৭৬৯টি মেডিকেল টিম কাজ করলেও তার পরিমাণ যথেষ্ট নয়। মোটকথা, বন্যার যে ভয়াবহতা, তার সঙ্গে সহায়তা বা অন্যান্য কর্মকাণ্ড অপ্রতুল। বিষয়গুলো আমলে নিয়ে এর সামাধান করা খুব প্রয়োজন।
দেশজুড়ে ভয়াবহ বন্যায় সৃষ্ট পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের সব চেষ্টাই চলছে যথেষ্ট পরিমাণে। বন্যা কবলিত এলাকাগুলোতে চলছে ত্রাণ ও উদ্ধার কার্যক্রমসহ সব ধরণের কর্মকাণ্ড। অন্তর্বর্তী সরকার দ্রুততার সঙ্গে এ পরিস্থিতির উত্তরণে কাজ করছে। মাঠে আছে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীসহ সব বাহিনীর সদস্যরা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত শিক্ষার্থীরাসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার নানা মতপথের মানুষও একাট্টা হয়ে বন্যা কবলিতদের সহায়তায় সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাচ্ছে। মানুষ এগিয়ে আসছে সহায়তার জন্য। সবারই লক্ষ্য এক-বন্যাদুর্গতদের সহযোগিতা করা। তবে, লক্ষ্যস্থির করা গেলেও লক্ষ্যপূরণ যেন অনেকটাই কঠিন। এরই মধ্যে ত্রাণ বিতরণসহ উদ্ধার তৎপরতায় সমন্বয়হীনতার কথা শোনা যাচ্ছে। সে কারণেই বোধ হয়, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ত্রাণ ও উদ্ধার কার্যক্রমসহ বন্যাদুর্গত এলাকায় সামগ্রিক কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্রে সমন্বয়ের উপর জোর দিয়েছেন।
এখন সবচেয়ে আগে যেটা প্রয়োজন, তা হলো সমন্বিতভাবে ত্রাণ বিতরণ কর্মকাণ্ড চালানো। ত্রাণ বিতরণ বা উদ্ধার প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্তদের একটি ছাতার নিচে নিয়ে আসা এখন খুব জরুরি। যাতে করে খাদ্য বিতরণ সুষ্ঠুভাবে করা যায় এবং খাদ্য সহায়তা থেকে কেউ বাদ না যায় সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। দুর্গতদের খাদ্য সহায়তা দেয়ার পাশাপাশি পোশাকও খুব দরকার। এরই মধ্যে অনেকেই পোশাক সংগ্রহের কাজ শুরু করেছেন। সে পোশাক যেন সুষ্ঠুভাবে বিতরণ করা যায়, সেদিকে নজর দিতে হবে। যতটুকু জানা যায়, বন্যা দুর্গত এলাকাগুলোতে বিশুদ্ধ পানির সঙ্কট সবচেয়ে বেশী। পাওয়া যাচ্ছে না ওরস্যালাইন বা প্রয়োজনীয় ওষুধও। শিশু খাদ্যের সঙ্কটও ব্যাপক। গর্ভবতী নারী ও বয়স্করা যথেষ্ট ভোগান্তিতে রয়েছেন। অনেকে বঞ্চিত হচ্ছেন চিকিৎসা সেবা থেকে। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির কথাও শোনা যাচ্ছে কোন কোনো এলাকায়। অতি সম্প্রতি ফেনী ও আশেপাশের কিছু স্থানে ডাকাতির কথা শোনা গেছে।
এ পরিস্থিতিতে সরকারি-বেসরকারি-এনজিও-ব্যক্তিগত সব পক্ষের সমন্বিত উদ্যোগ ও পদক্ষেপই পারে সঙ্কটের মাত্রা কমিয়ে আনতে। বিচ্ছিন্ন কোনো পদক্ষেপ খুব বেশী কাজে দেবে বলে মনে হয় না। শুধুমাত্র এবং শুধুমাত্র সবার সমন্বিত পদক্ষেপ ও একতাবদ্ধ উদ্যোগই বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের প্রাণশক্তি জাগিয়ে দিতে পারে আবার।
লেখক : উপ-সম্পাদক, দৈনিক নয়া শতাব্দী
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ