ঢাকা, বুধবার, ৩ জুলাই ২০২৪, ১৯ আষাঢ় ১৪৩১, ২৬ জিলহজ ১৪৪৫

গৌরবের প্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

প্রকাশনার সময়: ০১ জুলাই ২০২৪, ০৭:৪৮

গৌরবের প্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

এদেশের শিক্ষা বিস্তার, গবেষণা কার্যক্রম ও সব আন্দোলন সংগ্রামে এক গৌরবময় ইতিহাস রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের তথা পূর্ব বাংলার প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯২১ সালের ১ জুলাই এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়। ১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর বঙ্গভঙ্গে ঢাকাকে রাজধানী করে নতুন ‘পূর্ব বাংলা’ ও ‘আসাম’ প্রদেশ সৃষ্টি করা হয়। বঙ্গভঙ্গের ফলে পূর্ব বাংলায় শিক্ষার সবচেয়ে উন্নতি ঘটে। কিন্তু ১৯১১ সালের ১ নভেম্বর দিল্লির দরবারে ঘোষণার মাধ্যমে ১২ ডিসেম্বর বঙ্গভঙ্গ রদ করা হয়। বঙ্গভঙ্গের ফলে পূর্ববঙ্গে শিক্ষার যে জোয়ার এসেছিল, তাতে অচিরেই ঢাকাতে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা অবধারিত ছিল। বঙ্গভঙ্গ রদের ফলে সে সম্ভাবনা শেষ হয়ে যায়। ১৯১২ সালের ২১ জানুয়ারি ভারতের ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ ঢাকা সফরে আসেন এবং ঘোষণা করেন যে, তিনি সরকারের কাছে ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের সুপারিশ করবেন। ১৯১২ সালের মে মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ব্যারিস্টার রবার্ট নাথানের নেতৃত্বে নাথান কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটির ২৫টি সাবকমিটির রিপোর্টের ভিত্তিতে ভারত সরকার প্রস্তাবিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য রূপরেখা স্থির করে। ভারত সরকার ১৯১৩ সালে নাথান কমিটির রিপোর্ট অনুমোদন দেন।

১৯১৭ সালের মার্চ মাসে ইমপেরিয়াল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলে টাঙ্গাইলের ধনবাড়ীর নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী সরকারের কাছে অবিলম্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিল পেশের আহ্বান জানান। ১৯১৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর লর্ড চেমস্ফোর্ড কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যাগুলো তদন্তের জন্য একটি কমিটি গঠন করেন। সেই কমিশনের ওপরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে পরামর্শ দেয়ার দায়িত্ব প্রদান করা হয়। এ কমিশনের প্রধান ছিলেন মাইকেল স্যাডলার কমিশন ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করে। কিন্তু এ কমিশন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে সরকারী বা স্টেট বিশ্ববিদ্যালয় করার নাথান কমিটির প্রস্তাব সমর্থন করেনি। কিন্তু ঢাকা কলেজের আইন বিভাগের সহঅধ্যক্ষ ড. নরেশ চন্দ্র সেনগুপ্ত পূর্ণ স্বায়ত্ত্ব শাসনকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল শক্তিরূপে অভিহিত করেন। একই কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও অর্থনীতির অধ্যাপক টি সি উইলিয়ামস অর্থনৈতিক বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্ণ স্বাধীনতা দাবী করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন ঢাকা শহরের কলেজগুলোর পরিবর্তে বিভিন্ন আবাসিক হলকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউনিটরূপে গন্য করার সুপারিশ করে।

এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় কাউন্সিল হাউসের পাঁচ মাইল ব্যাসার্ধ এলাকাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতাভুক্ত এলাকায় গন্য করার কথাও বলা হয়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে ১৩টি সুপারিশ করেছিল এবং কিছু রদবদল সহ তা ১৯২০ সালের ভারতীয় আইন সভায় গৃহীত হয়। ভারতের তদানীন্তন গভর্নর জেনারেল ১৯২০ সালের ২৩ মার্চ তাতে সম্মতি প্রদান করেন। স্যাডলার কমিশনের অন্যতম সদস্য ছিলেন লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক রেজিস্টার পি. জে. হার্টস। তিনি ১৯২০ সালের ১ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। ১৯২১ সালের ১ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আনুষ্ঠানিকভাবে এর কার্যক্রম শুরু করে। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসকে কেন্দ্র করে তার পূর্ব পাশে অবস্থিত ঢাকা হল বর্তমান শহীদুল্লাহ হল, লিটন হল, কার্জন হল, বিজ্ঞান ভবনসমূহ, ঢাকা হলের পূর্ব পাশে বিরাট দীঘি, অপর পাশে ফজলুল হক মুসলিম হল। বিশ্ববিদ্যালয় মাঠে প্রধান প্রবেশপথ ছিল ঢাকা হল (বর্তমান শহীদুল্লাহ হল)- এর দিক থেকে, মাঠে ঢুকতেই ডানে জিমনেসিয়াম আর বামে একটি পুকুর, বিশ্ববিদ্যালয় মাঠটি ত্রিকোণাকৃতি এবং তাতে দু’টি ফুটবল গ্রাউন্ড ছিল। মাঠের উত্তর দক্ষিণ পূর্ব তিন দিক দিয়েই বৃক্ষশোভিত রাজপথ প্রসারিত; বিশ্ববিদ্যালয় মাঠের দক্ষিণ দিকের রাস্তাটি ইউক্যালিপ্টাস শোভিত, যে রাস্তাটি মুসলিম হল পর্যন্ত সম্প্রসারিত এবং মুসলিম হলের সামনে শিরিষ বা রেইনট্রি জাতীয় বৃক্ষ শোভিত।

১৯২১ সালের ১ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছিল ঢাকা হল পরে শহীদুল্লাহ হল, জগন্নাথ হল এবং মুসলিম হল নিয়ে। হলগুলো শুধু ছাত্রাবাস রূপেই নয় সঙ্গে সঙ্গে ছাত্রদের শিক্ষা, সমাজ ও সাংস্কৃতিক জীবনে উপযুক্তভাবে গড়ে তোলার জন্য শিক্ষা ও অনুশীলন কেন্দ্ররূপেও পরিকল্পিত হয়েছিল। পরিকল্পনায় ছিল— বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেক শিক্ষক কোনো না কোনো হলের সঙ্গে যুক্ত থাকবেন, ছাত্রদের উপদেষ্টারূপে এবং অনুশীলনী ক্লাস নেবেন। ঢাকা হলের প্রথম প্রভোস্ট ছিলেন ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ এফ. সি. সি. টার্নার। শুরুতে একমাত্র ঢাকা হলেরই নিজস্ব ভবনে ছিল; কার্জন হল মিলনায়তনটি তার অধিকারভুক্ত ছিল সে কারণে একটি আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের শিক্ষা বহির্ভূত সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে ঢাকা হল ছাত্র সংসদের ভূমিকা ছিল অগ্রগন্য। দেশ বিভাগের পর ঢাকা হলই ছিল প্রগতিশীল বামপন্থী ছাত্র আন্দোলনের সূতিকাগার, ১৯৬৯ সালের গণআন্দোলন মহান গণঅভ্যুত্থানে পরিণত হয়েছিল ঢাকা হলের প্রগতিশীল ছাত্রনেতা আসাদুজ্জামানের শহীদ হওয়ার মাধ্যমে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধু মুসলিম ছাত্রদের জন্য স্থাপিত প্রথম হল “সলিমুল্লাহ মুসলিম হল”। এ হলের প্রথম প্রভোস্ট নিযুক্ত হন ইতিহাস বিভাগের রিডার স্যার এ এফ রাহমান।

জগন্নাথ হলের নামকরণ হয় ঢাকার বলিয়াদির জমিদার কিশোরীলাল রায় চৌধুরীর দানে তাঁর পিতা জগন্নাথ রায় চৌধুরীর নামে। জগন্নাথ রায় চৌধুরীর নামেই ঢাকার জগন্নাথ কলেজের নামকরণ করা হয়েছিল। জগন্নাথ হলের প্রথম প্রভোস্ট ছিলেন আইন বিভাগের প্রথম অধ্যাপক নরেশ চন্দ্র সেনগুপ্ত।

১৯২১ সালে লীলা নাগ ইংরেজীতে এমএ ক্লাসে ভর্তি হন এবং ১৯২৩ সালে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম এমএ ডিগ্রিধারী হিসেবে বের হন যিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় ছাত্রী সুষমা সেনগুপ্তা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মুসলিম ছাত্রী ছিলেন গণিত বিভাগের ফজিলাতুন্নেসা।

১৯২৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঢাকা আসেন এবং কার্জন হলে ১০ ফেব্রুয়ারি দি মিনিং অব আর্ট এবং ১৩ ফেব্রুয়ারি দি বিগ অ্যান্ড দি কমপ্লেক্স বিষয়ে বক্তৃতা প্রদান করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম তিনটি হল থেকে রবীন্দ্রনাথকে সংবর্ধনা জানানোর আয়োজন করা হয়েছিল। কিন্তু অসুস্থতার কারণে রবীন্দ্রনাথ কেবন মুসলিম হলের সংবর্ধনা সভায় যোগদান করতে পেরেছিলেন। ১৯২৫ সালের ১৯ জানুয়ারি মুসলিম সাহিত্য সমাজ গঠিত হয়। এ প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন অধ্যাপক আবুল হোসেন। মুসলিম সাহিত্য সমাজের মুখপাত্র ছিল শিখা নামক বার্ষিকী। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম সাহিত্য সমাজের প্রথম বার্ষিক সম্মেলনের উদ্বোধন করেন ১৯২৭ সালে। ১৯৩৫-৩৬ সালে শ্রীমতী করুণা কণা গুপ্তা ইতিহাস বিভাগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মহিলা শিক্ষিকা হলেন।

১৯২১ সালের ১ জানুয়ারি থেকে প্রথম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজা ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। সেসময়ে রমনা এলাকা ছিল ঢাকার সবচেয়ে অভিজাত এবং সৌন্দর্যমণ্ডিত এলাকা। এ অঞ্চলের প্রায় ৬০০ একর জমির ওপরে বিভিন্ন ভবন এবং ঢাকা কলেজের বর্তমান কার্জন হল ভবনসমূহের সমন্বয়ে গড়ে ওঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এ দিনটি অর্থাৎ ১ জুলাই প্রতি বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিবস হিসেবে পালন করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তিনটি অনুষদ এবং ১২টা বিভাগ নিয়ে তার যাত্রা শুরু করে। ঢাকা কলেজ এবং জগন্নাথ কলেজ বর্তমান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ডিগ্রী কলেজে অধ্যয়নরত ছাত্রদের নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার শিক্ষাক্রম শুরু করে। শুধু ছাত্র নয় শিক্ষক এবং লাইব্রেরী ও অন্যান্য উপকরণ দিয়েও এ দু’টি কলেজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অগ্রগতিতে সাহায্য করে।

প্রথম শিক্ষাবর্ষে বিভিন্ন বিভাগে মোট ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ছিল ৮৭৭ জন। অপরদিকে শিক্ষক ছিল ৬০ জন। ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান নামক দু’টি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলে, তখন পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায় অবস্থিত শুধু একটি বিশ্ববিদ্যালয় ছিল আর তা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এর ফলে এদেশের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা আবার উজ্জীবিত হয়। নতুন উদ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করে। তখনকার পূর্ববাংলায় অবস্থিত ৫৫টি কলেজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হয়। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত দেশের প্রয়োজনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ অবদান।

স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণের শিকার হয়। এতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ অনেক ছাত্রছাত্রী নিহত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের গৌরবের প্রতিষ্ঠান। আমাদের সব আন্দোলন সংগ্রামের কেন্দ্রবিন্দু।

নয়া শতাব্দী/এসআর

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ