মঙ্গলবার, ০২ জুলাই ২০২৪, ১৮ আষাঢ় ১৪৩১

আতঙ্কের নাম ‘রাসেলস ভাইপার’ প্রয়োজন জনসচেতনতা

প্রকাশনার সময়: ২৪ জুন ২০২৪, ০৮:৩২

সম্প্রতি দেশে বিষাক্ত ও হিংস্র চন্দ্রবোড়া বা রাসেলস ভাইপার সাপের উপদ্রব বেড়েছে উদ্বেগজনক হারে। এ সাপের আক্রমণে আতঙ্কে দিন পার করছেন জনসাধারণ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতি বছর অন্তত ৫ লাখ ৮০ হাজার মানুষ সাপের কামড়ের শিকার হন এবং এদের মধ্যে ছয় হাজার মানুষ মারা যান।

রাসেলস ভাইপারের বাংলা নাম চন্দ্রবোড়া বা উলুবোড়া। বাংলাদেশে অল্প যে কয়েকটি সাপ অত্যন্ত বিষধর, তার মধ্যে এটি একটি। রাসেলস ভাইপার সাপের বৈজ্ঞানিক নাম ডাবোয়ইয়া রাসেলি, যা ভাইপারিডি গোত্রের একটি ভয়ঙ্কর বিষাক্ত সাপ। বিশেষ করে ভারতীয় উপমহাদেশে এ সাপ বেশী দেখা যায় এবং এটি ভারতের সবচেয়ে বড় চারটি সাপের মধ্যে একটি। রাসেলস ভাইপারের শরীরে ছোপ ছোপ চিহ্ন থাকে। আর অজগরের শরীরজুড়ে লম্বা রেখার মাঝে গোল গোল চিহ্ন থাকে।

১৭৯৬ সালে স্কটিশ সার্জন ও ন্যাচারালিস্ট প্যাট্রিক রাসেল তার বই ‘অ্যান অ্যাকাউন্ট অব ইন্ডিয়ান সার্পেন্টস, কালেক্টেড অন দ্য কোস্ট অব করোমান্ডেল’-এ এই সাপের বিশদ বিবরণ দেন। পরবর্তীতে তারই নামে সাপটির নামকরণ করা হয় রাসেলস ভাইপার।

অন্যান্য সাপ মানুষ দেখে দূরে সরে থাকলেও রাসেলস ভাইপার সাপ উল্টো অতর্কিতে এসে মানুষকে আক্রমণ করে। সাধারণত দিনের বেলা এ সাপ বেশী সক্রিয় আচরণ করে। রাসেলস ভাইপার সাপ ঘন জঙ্গল এড়িয়ে চলে এবং ঘাসে ভর্তি খোলা মাঠ, ঝোপঝাড়ে আস্তানা গাঁড়ে।

বাংলাদেশে রাসেলস ভাইপারের দংশনের হার খুব বেশী না হলেও বিবিসি সূত্রে জানা যায়, ভারতে প্রতি বছর অন্তত ৪৩% এবং শ্রীলঙ্কায় ৩০-৪০% সাপে কাটার ঘটনা রাসেলস ভাইপারের কারণে হয়ে থাকে।

দেশে একটা সময় বিলুপ্ত বলা হলেও দেশজুড়ে এখন মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠেছে এ রাসেলস ভাইপার। বরেন্দ্র অঞ্চলের বাসিন্দা হলেও সাপটির রাজত্ব এখন দেশের অন্তত ২৫টি জেলায়। পৌঁছে গেছে চাঁদপুর, বরিশাল, পটুয়াখালী পর্যন্ত। সবচেয়ে বেশী আনাগোনা মানিকগঞ্জ, ফরিদপুর, শরীয়তপুরসহ পদ্মা, মেঘনা ও যমুনার অববাহিকায়, যার ছোবলে চলতি বছর এরই মধ্যে মারা গেছেন অন্তত ১০ জন, যাদের অধিকাংশই কৃষক এবং জেলে। এমনকি ঢাকার পাশের জেলা মানিকগঞ্জে রাসেলস ভাইপারের কামড়ে গত তিন মাসে পাঁচ জনের মৃত্যু হয়েছে।

রাসেলস ভাইপার দেখতে অনেকটা অজগরের বাচ্চার মতো। ছোট ও সরু লেজের সরীসৃপটি দৈর্ঘ্যে তিন থেকে পাঁচ ফুট পর্যন্ত হয়ে থাকে। মাথা চ্যাপ্টা, ত্রিভুজাকার এবং ঘাড় থেকে আলাদা। শরীরজুড়ে অনেকটা চাঁদের মতো গাঢ় বাদামী গোল গোল দাগ। দৈহিক এ বৈশিষ্ট্যের কারণে শুকনো পাতা বা ধান ক্ষেতের মধ্যে খুব সহজেই নিজেকে লুকিয়ে রাখতে পারে রাসেলস ভাইপার। এটি চন্দ্রবোড়া বা উলুবোড়া নামেও পরিচিত।

বিষধর সাপ হিসেবে পৃথিবীতে রাসেলস ভাইপারের অবস্থান পঞ্চম। কিন্তু হিংস্রতা আর আক্রমণের দিক থেকে এর অবস্থান প্রথম। আক্রমণের ক্ষেত্রে এ সাপ এতটাই ক্ষিপ্র যে, ১ সেকেন্ডের ১৬ ভাগেরও ১ ভাগ সময়ে কামড়ের সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে পারে এটি। ক্ষেপে গেলে শব্দ করে প্রচণ্ড জোরে। ঠিক যেন প্রেসার কুকারের মতো।

রাসেলস ভাইপারের বিষ হেমাটোটক্সিক, যার কারণে ছোবল দিলে আক্রান্ত স্থানে পচন ধরে। ছোবলের পাঁচ মিনিটের মধ্যে ফুলে যায় ক্ষত স্থান। এ সাপের কামড়ে শরীরের দংশিত অংশে বিষ ছড়িয়ে অঙ্গহানি, ক্রমাগত রক্তপাত, রক্তজমাট বাঁধা, স্নায়ু বৈকল্য, চোখ ভারী হয়ে যাওয়া, পক্ষাঘাত, কিডনী ও ফুসফুসের সংক্রমণসহ বিভিন্ন ধরনের শারীরিক জটিলতা দেখা দিতে পারে।

তবে আশ্চর্যের বিষয় হলো, সাপের এ প্রজাতিটি বাংলাদেশ থেকে বহু বছর আগেই বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল বলে ধারণা করা হচ্ছিল। কিন্তু গত ১০-১২ বছর আগে থেকে আবারো এ সাপের কামড়ের ঘটনার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। এ প্রজাতির সাপ এই অঞ্চলে আবার কীভাবে ফিরে আসছে, তা নিয়ে বাংলাদেশে গবেষণা চলছে।

বেশীর ভাগ সাপ ডিম পাড়লেও রাসেলস ভাইপার বাচ্চা দেয়। গর্ভধারণ শেষে স্ত্রী রাসেলস ভাইপার সাধারণত ২০ থেকে ৪০টি বাচ্চা দেয়। তবে ৮০টি পর্যন্ত বাচ্চা দেয়ার রেকর্ডও আছে। একদিকে উচ্চ প্রজনন ক্ষমতা, সেইসঙ্গে ইঁদুর, ব্যাঙসহ সাপের পর্যাপ্ত খাবারের উপস্থিতি থাকায় বাড়ছে রাসেলস ভাইপার। অন্যদিকে এ সাপের শত্রু শিয়াল, বেজি, গুইসাপের সংখ্যা প্রকৃতিতে কমে যাওয়ায় এর বিস্তারে সহায়ক হচ্ছে।

চিকিৎসকের মতে, গোখরো সাপের দংশনের গড় ৮ ঘণ্টা পর, কেউটে সাপের দংশনের গড় ১৮ ঘণ্টা পর ও চন্দ্রবোড়া (রাসেলস ভাইপার) সাপের দংশনের গড় ৭২ ঘণ্টা বা তিন দিন পর রোগীর মৃত্যু হতে পারে। বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে এ সময়সীমার মধ্যে অ্যান্টিভেনম প্রয়োগ করা জরুরী। সাপের কামড় বা দংশনের পরে, দ্রুত অ্যান্টিভেনম ইনজেকশন দিলে, অ্যান্টিভেনমের অ্যান্টিবডিগুলো বিষকে নিষ্ক্রিয় করে। যার ফলে আক্রান্ত ব্যক্তির জীবন বা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বেঁচে যায়।

> সাপে কামড়ালে যা করবেন:

* শান্ত থাকুন এবং অতি দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা করুন।

* শুধু রাসেলস ভাইপার নয়, যে কোনো সাপের কামড়ের শিকার হলেই ওঝার কাছে যাওয়া যাবে না। ওঝার কাছে না গিয়ে যত দ্রুত সম্ভব নিকটস্থ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, জেলা সদর হাসপাতাল বা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যেতে হবে এবং চিকিৎসকের পরামর্শে নির্দিষ্ট অ্যান্টিভেনম প্রয়োগ করতে হবে। এক্ষেত্রে সম্ভব হলে যে সাপ দংশন করেছে, তা চিহ্নিত করার জন্য সেই সাপের ছবি তুলে স্থানীয় বন কর্মকর্তা ও চিকিৎসককে দেখাতে হবে।

* শরীরের যে স্থানে সাপ কামড়েছে সেটি যতটা সম্ভব কম নড়াচড়া করুন। ঘড়ি বা অলঙ্কার পড়ে থাকলে তা খুলে ফেলুন।

* কাপড়ের গিঁট ঢিলা করুন, তবে খুলবেন না।

> সাপে কামড়ালে যা করবেন না:

* কামড়ের স্থান থেকে চুষে বিষ বের করে আনার চেষ্টা করা।

* কামড়ের স্থান আরো কেটে বা সেখান থেকে রক্তক্ষরণ ঘটিয়ে বিষ বের করে আনার চেষ্টা করা।

* বরফ, তাপ বা কোনো ধরনের রাসায়নিক ক্ষত স্থানে প্রয়োগ করা।

* আক্রান্ত ব্যক্তিকে একা ফেলে যাওয়া।

* কামড়ের স্থানে শক্ত করে বাঁধা। এর ফলে বিষ ছড়ানো বন্ধ হবে না এবং আক্রান্ত ব্যক্তি পঙ্গুও হতে পারেন।

* বিষধর সাপ ধরা থেকেও বিরত থাকা উচিৎ। এমনকি মৃত সাপও সাবধানতার সঙ্গে ধরা উচিৎ, কারণ সদ্যমৃত সাপের স্নায়ু মারা যাওয়ার কিছুক্ষণ পরও সতেজ থাকতে পারে এবং তখন তা দংশন করতে পারে।

> রাসেলস ভাইপার থেকে নিরাপদ থাকার জন্য নিচের পরামর্শগুলো অনুসরণ করতে পারেন:

* সচেতনতা বৃদ্ধি: রাসেলস ভাইপারের জীবনচক্র এবং আবাসস্থল সম্পর্কে ভালোভাবে জানুন। কোথায় কিভাবে থাকতে পারে, সেটা জেনে নিলে বিপদ এড়ানো সম্ভব। যেহেতু কৃষি কাজের মাঠে এর উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায় তাই কৃষক ভাইদের সচেতন করুন। তারা অনলাইনমুখী না তাই তাদের সচেতন করা আপনাদের দায়িত্ব।

* পোষাক পরা: যদি এমন এলাকায় যান যেখানে রাসেলস ভাইপারের উপস্থিতির সম্ভাবনা আছে, তাহলে উচ্চ বুট জুতা এবং মোটা প্যান্ট পরিধান করুন।

* পরিষ্কার রাখা: বসতবাড়ির আশপাশে ঝোপঝাড় পরিষ্কার রাখুন এবং আবর্জনা না ফেলে রাখুন। এভাবে সাপের লুকানোর জায়গা কমে আসে।

* আলো ব্যবহার করা: রাতের বেলা বাইরে গেলে টর্চ ব্যবহার করুন। রাসেলস ভাইপার সাধারণত রাতে সক্রিয় থাকে, তাই রাতের বেলায় আলোর সাহায্যে পথ চলুন।

* স্থানীয় স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রের তথ্য জানা: স্থানীয় কোন স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোতে অ্যান্টিভেনম পাওয়া যায়, তা জানুন। বিপদের সময় দ্রুত চিকিৎসা নেয়ার জন্য এটি গুরুত্বপূর্ণ। তাদের যোগাযোগ নম্বর সঙ্গে রাখুন।

রাসেলস ভাইপার একটি মারাত্মক বিষধর সাপ এবং এর কামড়ের ফলে জীবন হুমকীর সম্মুখীন হতে পারে। সঠিক সচেতনতা, সতর্কতা এবং প্রাথমিক চিকিৎসার জ্ঞান থাকলে এ সাপের বিপদ থেকে নিজেকে এবং অন্যদের রক্ষা করা সম্ভব। সাপকে কোনোভাবেই বিরক্ত না করে, দূর থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখাই উত্তম। সচেতন এবং সতর্ক থাকলেই রাসেলস ভাইপারের মতো ভয়ানক সাপের কামড়ের হাত থেকে মুক্ত থাকতে প্রয়োজন আমাদের জনসচেতনতা।

লেখক: কলাম লেখক ও গবেষক

নয়া শতাব্দী/এসআর

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ