আজ বিশ্ব মেট্রোলজি দিবস ২০২৪। ১৮৭৫ সালের ২০ মে ফ্রান্সের প্যারিসে পরিমাপ সম্পর্কিত ‘মিটার কনভেনশন’ স্বাক্ষরিত হয়। দিবসটিকে স্মরণীয় করে রাখতে এবং দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সঠিক ওজন ও পরিমাপের গুরুত্বের বিষয়ে জনসচেতনতা গড়ে তোলার জন্য প্রতি বছর বাংলাদেশসহ বিশ্বের ৮০টিরও বেশি দেশে একযোগে বিশ্ব মেট্রোলজি দিবস পালিত হয়ে আসছে।
নিরাপদ ও সুষম খাদ্য সুস্থ মানবদেহের জন্য অপরিহার্য। যা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে এবং পণ্য ও সেবার মান বজায় রাখতে সঠিক ওজন ও পরিমাপের গুরুত্ব অপরিসীম। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে পরিমাপ বিজ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। সঠিক পরিমাপ ছাড়া টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়।
*মেট্রোলজি: মেট্রোলজি হলো পরিমাপের বৈজ্ঞানিক অধ্যয়ন। এটি ইউনিটগুলোর একটি সাধারণ বোঝাপড়া প্রতিষ্ঠা করে, যা মানুষের ক্রিয়াকলাপকে সংযুক্ত করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। আধুনিক পরিমাপবিদ্যার শিকড় রয়েছে ফরাসি বিপ্লবের রাজনৈতিক অনুপ্রেরণায়। ফ্রান্সে একককে মানসম্মত করার জন্য প্রাকৃতিক উৎস থেকে নেয়া একটি দৈর্ঘ্যের মান প্রস্তাব করা হয়েছিল। এটি ১৭৯৫ সালে দশমিক-ভিত্তিক মেট্রিক সিস্টেম তৈরির দিকে পরিচালিত করে, অন্যান্য ধরনের পরিমাপের জন্য মানগুলোর একটি সেট প্রতিষ্ঠা করে। ১৭৯৫ এবং ১৮৭৫ সালের মধ্যে অন্যান্য বেশ কয়েকটি দেশ মেট্রিক পদ্ধতি গ্রহণ করেছিল; দেশগুলোর মধ্যে সামঞ্জস্য নিশ্চিত করার জন্য, ব্যুরো ইন্টারন্যাশনাল ডেস পয়েডস এট মেসুরস (বিআইপিএম) মিটার কনভেনশন দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ১৯৬০ সালে ওজন ও পরিমাপ সংক্রান্ত ১১তম সাধারণ সম্মেলনের (C‰PM) একটি রেজোলিউশনের ফলে এটি ইন্টারন্যাশনাল সিস্টেম অব ইউনিটস (SI)-তে বিকশিত হয়েছে।
* উদ্দেশ্য: পণ্য ও সেবার মান প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের সব ক্ষেত্রে সঠিক পরিমাপ সময়েরই দাবি। ভোক্তা সাধারণের সঠিক প্রাপ্য নিশ্চিতে ডিজিটাল প্রযুক্তির পরিমাপে গুরুত্ব দেয়া বাঞ্ছনীয়। তাই ওজন ও পরিমাপ বিষয়ে সচেতনতা তৈরিতে প্রতিবছর ২০ মে বিশ্বব্যাপী এ দিবসটি পালন করা হয়।
*মেট্রোলজি কেন প্রয়োজন: মেট্রোলজির লক্ষ্য হলো ম্যানুফ্যাকচারিং, স্বাস্থ্য এবং পরিবেশ বিজ্ঞান সহ বিভিন্ন অ্যাপ্লিকেশনে সঠিক এবং নির্ভরযোগ্য পরিমাপ প্রদান করা। উপরন্তু, মেট্রোলজি অনন্যভাবে গুরুত্বপূর্ণ কারণ এটি উৎপাদন প্রক্রিয়া এবং গবেষণা ও উন্নয়নে গুণমান নিশ্চিতকরণ প্রোগ্রামের ভিত্তি প্রদান করে।
*মেট্রোলজি তিন প্রকার: মেট্রোলজিকে তিনটি সাবফিল্ডে ভাগ করা যায়: বৈজ্ঞানিক মেট্রোলজি, অ্যাপ্লাইড মেট্রোলজি এবং লিগ্যাল মেট্রোলজি। ভোক্তাদের সুরক্ষা এবং ন্যায্য বাণিজ্যের জন্য সুপ্রতিষ্ঠিত পরিমাপ এবং পরিমাপ যন্ত্রের নিয়ন্ত্রক প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কিত আইনি পরিমাপবিদ্যা হলো লাইনের শেষ।
*পরিমাপ ও মেট্রোলজির মধ্যে পার্থক্য: মেট্রোলজি একটি পরিমাপের নির্ভুলতা, নির্ভুলতা এবং পুনরাবৃত্তিযোগ্যতা কভার করে। এটি একটি ‘স্ট্যান্ডার্ড’ বা বিভিন্ন পরিমাপ সিস্টেমের মধ্যে ট্রেসেবিলিটি বা তুলনা জড়িত। পরিমাপবিদ্যা পরিমাপের সব তাত্ত্বিক এবং ব্যবহারিক দিক অন্তর্ভুক্ত করে, পরিমাপের অনিশ্চয়তা বা প্রয়োগের ক্ষেত্র যাই হোক না কেন।
পরিশেষে বলতে চাই, চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগে কায়িক পরিশ্রমের পরিবর্তে ডিজিটাল প্রযুক্তির স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় শিল্পকারখানায় উৎপাদিত পণ্যের সঠিক পরিমাপে ডিজিটাল প্রযুক্তির প্রয়োগ এখন সময়ের দাবি। এক্ষেত্রে ওজন ও পরিমাপের আন্তর্জাতিক পদ্ধতির একক দ্য ইন্টারন্যাশনাল সিস্টেম অব ইউনিটের (এসআই) ডিজিটাল প্রয়োগ ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণ ও সেবা সহজীকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এর মাধ্যমে ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে পণ্য উৎপাদন থেকে শুরু করে বাজার ও ভোক্তা পর্যায়ে পৌঁছানো এবং অনুমোদন প্রক্রিয়ার ধাপ কমিয়ে দ্রুত সেবা প্রদান করা সম্ভব হবে। ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে শিল্প কারখানায় উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজারে দেশীয় পণ্যের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পাবে। এ ছাড়া রপ্তানি বাণিজ্যের সম্প্রসারণের সঙ্গে সঙ্গে দেশের অর্থনীতিকেও সমৃদ্ধ করবে। তাই মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সঠিক পরিমাপের গুরুত্ব অপরিসীম। কোনো পণ্যই মানসম্মত হবে না যদি তার প্রতিটি উপাদান সঠিক না হয়। আর বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন প্রকার পণ্য বা সেবা এক দেশ থেকে অন্য দেশে বা বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে লেনদেন বা কেনাবেচা করা হচ্ছে। এটা সম্ভব হচ্ছে একমাত্র পরিমাপের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক পদ্ধতির প্রচলন এবং এ পদ্ধতির প্রতি মানুষের আস্থা, নির্ভরযোগ্যতা এবং বিশ্বাসযোগ্যতার কারণে। আর বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫৬ সালে তৎকালীন কোয়ালিশন সরকারের শিল্প, বাণিজ্য, শ্রম, দুর্নীতি দমন ও গ্রাম সহায়তা দপ্তরের মন্ত্রীর দায়িত্বে থাকাকালীন দেশীয় শিল্পের বিকাশে নানামুখী পরিকল্পনা ও পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তারই ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ১৯৭৪ সালে বিএসটিআই আন্তর্জাতিক মান সংস্থা (আইএসও) এবং ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ কোডেক্স অ্যালিমেন্টারিয়াস কমিশনের সদস্য পদ লাভ করে ন্যাশনাল কোডেক্স কন্টাক্ট পয়েন্ট (এনসিসিপি) হিসেবে কাজ করে চলেছে। আইএসও ও কোডেক্সের সদস্য পদ এবং পরবর্তীতে বিআইপিএম ও বিআইএমএল এর সদস্যভুক্ত হওয়ার পর থেকে আন্তর্জাতিক মান ও পরিমাপ সংস্থা প্রণীত মান অনুযায়ী দেশের জাতীয় মান সংস্থা (এনএসবি) হিসেবে বিএসটিআই বাংলাদেশের বিভিন্ন পণ্য যেমন-খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, স্বাস্থ্য ও শিক্ষার ক্ষেত্রে ব্যবহূত সামগ্রী ও যন্ত্রপাতির মান নির্ধারণ এবং সঠিক ওজন ও পরিমাপ নিশ্চিতকরণে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। আর বর্তমান সরকার ২০১৮ সালে ওজন ও পরিমাপ মানদণ্ড আইন এবং ২০২১ সালে পণ্য মোড়কজাতকরণ বিধিমালা প্রণয়ন করছে।
আর বিএসটিআই’র কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ভোক্তার স্বার্থ রক্ষায় দেশব্যাপী বিভিন্ন স্তরের অংশীজনের সহায়তায় ভ্রাম্যমাণ আদালত ও বিশেষ অভিযান পরিচালনাসহ জনস্বার্থবিরোধী কাজ নিরসনে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। জনগণের ন্যায্য অধিকার সমুন্নত রাখা এবং সুষ্ঠু ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ তৈরির ক্ষেত্রে বিএসটিআই’র পদক্ষেপসমূহ সর্বমহলে প্রশংসিত হচ্ছে।
তাই এবারের মেট্রোলজি দিবসের গৃহীত কর্মসূচি ক্রেতা-ভোক্তা, উৎপাদক, আমদানিকারক, গবেষক ও বিএসটিআই’র কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে আরও সক্রিয় হতে উৎসাহ জোগাবে। আর আমাদের সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় পরিমাপসহ সব ক্ষেত্রে ডিজিটাল পদ্ধতি বাস্তবায়িত হবে এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত-সমৃদ্ধ স্মার্ট বাংলাদেশ রূপান্তরের মাধ্যমে জাতির জনকের স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ বিনির্মাণে শিল্পোদ্যোক্তা, ব্যবসায়ী ও বিএসটিআই আরও উদ্যোগী ভূমিকা পালন করবে। তাই বিআইপিএম ও বিআইএমএলের সদস্য হিসেবে বাংলাদেশে লিগ্যাল ও সায়েন্টিফিক মেট্রোলজির প্রচলন এবং বাস্তবায়নের দায়িত্বপ্রাপ্ত একমাত্র রেগুলেটরি সংস্থা হিসেবে বিএসটিআই এ বিষয়ে কাজ করছে। মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সঠিক পরিমাপের গুরুত্ব সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করে তোলাই বিশ্ব মেট্রোলজি দিবস পালনের মুখ্য উদ্দেশ্য।
লেখক: কলাম লেখক ও গবেষক,প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি।
নয়া শতাব্দী/এসআর
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ