হঠাৎ করে টাকার বিপরীতে ডলারের মান বেড়ে গেল। ডলারের দাম ১১০ টাকা থেকে বেড়ে হয়ে গেল ১১৭ টাকা। ডলারের দাম বাড়ায় বাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। যদিও অনেকের মতে, ডলারের দাম বাড়ায় ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুই প্রভাবই পড়তে পারে। বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রেক্ষাপটে ডলারের দাম বাড়ায় নেতিবাচক প্রভাব পড়াটার সম্ভাবনাটাই বেশি। ব্যাংক সুদের হার বাজারভিত্তিক করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তাই সব ধরনের ঋণের সুদের হার বাড়বে। বাংলাদেশ ব্যাংক ক্রলিং পদ্ধতিতে ডলারের দাম ধরে রাখার ব্যবস্থা করেছে। তাই অর্থনীতিবিদরা মনে করেন এতে মূল্যস্ফীতি কমার সম্ভাবনা কম। যখন ডলারের দাম ১১০ টাকা নির্ধারিত ছিল তখন ব্যাংকগুলো ১২০-১২৩ টাকা দরে ডলার ক্রয় করেছে।
বর্তমানে ডলারের দাম ১১৭ টাকা সরকার নির্ধারণ করেছে তাই এর ক্রয়মূল্য ১৩০ টাকা বা তার অধিক হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। খোলা বাজারে ডলার কেনাবেচা নিয়ে চলবে নানা ধরনের ভেলকিবাজি। যার ফলে ধারণা করা হচ্ছে যে বৈধপথে ডলার আসার বিষয়টি কমে যাবে। দেখা যাবে প্রবাসীরা তাদের অর্জিত রেমিট্যান্স হুন্ডির মাধ্যমে দেশে পাঠাচ্ছে। কারণ হুন্ডির মাধ্যমে আসলে ডলারের দাম বেশি পাবে। আর এর ফলে রিজার্ভে ডলারের টান পড়ার সম্ভাবনাটাই বেশি হয়ে পড়বে। যার জন্য ধারণা করা হচ্ছে যে, মূল্যস্ফীতি লাগামহীন হয়ে পড়ার সম্ভাবনাটাই বেশি। এ ছাড়াও বাজারে আবারও ডলারের অস্থিরতা দেখা দিতে পারে। ডলারের দাম সাত টাকা বাড়ায় টাকার মান কমেছে ৬ দশমিক ৩ শতাংশ।
ডলারের দাম বাড়িয়ে টাকাকে অবমূল্যায়ন করা হয়েছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ডলারের দাম বাড়ায় আমদানিকারকরা বিপাকে পড়েছে কারণ আমদানি খরচ বেড়ে যাবে। এটা ঠিক তবে, আমদানিকৃত পণ্যের বাজারমূল্য বাড়িয়ে দিয়ে আমদানিকারকরা বিপাক মুক্ত হবেন, আর এই চাপটা এসে পড়বে সাধারণ ভোক্তার ওপর। আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ডলার একটি অন্যতম মাধ্যম। এই মাধ্যমটি হলো আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের মূল্য পরিশোধ করার মুদ্রা। যদি কোনো দেশের আমদানি ও রপ্তানির ভারসাম্য থাকে, অর্থাৎ রপ্তানির বিপরীতে আমদানি যদি সমান সমান হয়, তাহলে ডলারের মূল্যমান নির্ধারণে বাজারে তেমন একটা প্রভাব পড়ে না। বাংলাদেশ মূলত আমদানি নির্ভরশীল একটি দেশ।
আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে আমদানি-রপ্তানির তুলনা করলে দেখা যাবে যে বাংলাদেশের ঘাটতির পরিমাণ অনেক বেশি। যার জন্য দেখা যায়, রিজার্ভ থেকে অধিক অর্থ ব্যয় হয় আমদানি খাতে। ফলে রিজার্ভ স্থিতিশীল থাকে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের বড় জোগানদার হলো প্রবাসী শ্রমিকরা। আমদানি-রপ্তানির সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ তাই প্রবাসী শ্রমিকের পাঠানো ডলারটাই জমে রিজার্ভে। বর্তমানে আমদানি ব্যয় বাড়ার কারণে রিজার্ভ কমছে। বাংলাদেশের বর্তমানে আমদানি করা পণ্যের মধ্যে অন্যতম হলো- পেঁয়াজ, রসুন ,আদা, চাল, গম, তুলা, ডিজেল, পেট্রোলসহ জ্বালানি পণ্য, এলপি গ্যাস, ফার্নেস ওয়েল, পাম ওয়েল, সিমেন্ট ক্লিংকার, সয়াবিন তেল, হট রোল্ড ইস্পাত, মসুর ডাল, লোহা ও ইস্পাত কাঠামো, ভাঙা পাথর, মটরসহ নানাবিধ পণ্য।
দেশের গমের চাহিদার মাত্র ১৫ শতাংশ দেশে উৎপাদিত হয়। বাকিটা বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। তাই হিসাব কষলে দেখা যায়, প্রতিটি দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার সাতটি দেশের মধ্যে প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি সবচেয়ে বেশি। বেশ কয়েক বছর আগের একটি পরিসংখ্যান থেকে জানা যায় যে, ভারত থেকে বাংলাদেশ আমদানি করে ৫ হাজার ৮১১ দশমিক ৯০ মিলিয়ন ডলারের পণ্য। এর বিপরীতে বাংলাদেশ ভারতে রপ্তানি করেছে মাত্র ৫৭৭ দশমিক ১৬ মিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ বাংলাদেশের ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়াল ৫ হাজার ২৮৪ দশমিক ৭৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের পণ্য।
অথচ ২০০৫-২০০৬ সালে ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি ছিল মাত্র ১৬০ কোটি ডলার। পাকিস্তানের কাছ থেকে বাংলাদেশ বিপুল পরিমাণে পণ্য আমদানি করে। ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশে পাকিস্তান যে পরিমাণ পণ্য রপ্তানি করেছে তার মূল্যমান প্রায় ৬১ কোটি ৬২ লাখ ২ হাজার ডলার। এক বছরের ব্যবধানে পাকিস্তানের বাংলাদেশে রপ্তানির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় অর্থাৎ ২০২১-২২ অর্থবছরে ৮৭ কোটি ৬ লাখ ৪ হাজার ডলার। যা চলতি অর্থবছরের শেষে দাঁড়াবে এক বিলিয়ন ডলারে। শুধু ভারত পাকিস্তান নয় পৃথিবীর প্রতিটি দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানির এমন বৈষম্যমূলক চিত্রটা রয়েছে। বাংলাদেশের আমদানিকারকরা বিদেশ থেকে ডলার দিয়ে পণ্য কিনে আনবেন এটাই নিয়ম। আর এ ডলারের দেশীয় টাকার মান অনুসারে আমদানিকারকরা কেনা পণ্য বাজারে বিক্রি করবেন। তাহলে ডলারের দাম বাড়ায় পণ্যের দাম বাড়াটা স্বাভাবিক। ধরা যাক, একজন আমদানিকারক ১০০০ কেজি গম বিদেশ থেকে কিনলেন ৫০০ ডলার দিয়ে। তার প্রতি কেজি গমের ক্রয়মূল্য দাঁড়াল দশমিক ৫ ডলার। এই দশমিক পাঁচ ডলার ছিল ৫৫ টাকা (যখন ডলারের মূল্য ১১০ টাকা) অর্থাৎ এককেজি গমের ক্রয়মূল্য। বর্তমানে তা দাঁড়াবে ৬০ টাকায় (এখন এক ডলার প্রায় ১২০ টাকা) সুতরাং এই সরল হিসাবে দেখা যায় যে, দ্রব্যমূল্য বাড়ার হার প্রায় ২০ শতাংশ। প্রতিটি পণ্যের ওপর ডলারের দাম বাড়ার প্রভাব পড়বে। বাংলাদেশ একমাত্র বিদেশ থেকে ডলার আয় করে শ্রমশক্তির মাধ্যমে। আর পণ্য বাণিজ্যে বাংলাদেশের আয়-ব্যয়ের হিসাব কষলে দেখা যায়, বড় ধরনের ঘাটতি রয়েছে। সুতরাং বিদেশের সঙ্গে বাংলাদেশের পণ্য আমদানির হিসাবটা একটু গুরুত্ব সহকারে দেখা দরকার। বাংলাদেশের কৃষিপণ্য গুলোও এখন আমদানি করতে হচ্ছে। এটা বন্ধ করাটা জরুরি। বাংলাদেশে দিন দিন কৃষি উৎপাদন বাড়ছে কিন্তু তারপরও চাহিদা পূরণ হচ্ছে না।
চাহিদা পূরণ না হওয়ার মূল কারণ- চাষাবাদযোগ্য জমির পরিমাণ কমছে তাই ভূমি অনুপাতে উৎপাদন কমছে। চাষের জমি কমার অন্যতম কারণ হলো অপরিকল্পিত শিল্পায়ন ও নগরায়ন। বাংলাদেশের তিন ফসলি জমিতে কলকারখানা গড়ে উঠছে। কলকারখানা স্থাপনের জন্য কোন ধরনের ভূমি ব্যবহার করা যাবে তার একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকা দরকার। এ নীতিমালাটার অভাবেই অপরিকল্পিত শিল্প গড়ে উঠছে। অপরিকল্পিত শিল্পের কারণে বিপন্ন হচ্ছে পরিবেশ। অপরদিকে, চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদিত হচ্ছে না খাদ্যজাত পণ্য, তাই খাদ্যজাত পণ্যটি বিদেশ থেকে আমদানি করতে হচ্ছে। বিদেশ থেকে খাদ্যজাত পণ্য আমদানি করায় রিজার্ভ কমছে। বাংলাদেশে অপরিকল্পিত শিল্পায়নের ফলে সাদা চোখে যে আয় দেখা যায়, তার চেয়ে বেশি ব্যয় হয় খাদ্যজাত পণ্য আমদানি করায়। আমদানি নির্ভরতা কমানো পথ বাংলাদেশকে বেছে নিতে হবে। আর আমদানি কমাতে হলে কৃষি উৎপাদন বাড়াতে হবে। খাদ্যজাত পণ্য আমদানি বন্ধ করার জন্য উদ্যোগ নেয়া দরকার। বাংলাদেশ ডিম, মুরগি, মাছও ভারত থেকে আমদানি করে। পরিকল্পনা নিয়ে বাংলাদেশে কৃষি উৎপাদন বাড়ালে বিদেশের সঙ্গে আমদানি-রপ্তানির ভারসাম্যটা হয়তো হয়ে যেতে পারে। এ রকম পর্যায়ে আমদানি-রপ্তানি নিয়ে যেতে পারলে হঠাৎ হঠাৎ দ্রব্যমূল্য বাড়ার বিষয়টি বন্ধ হয়ে যাবে।
লেখক: কলামিস্ট
নয়াশতাব্দী/ডিএ
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ