পৃথিবীর উষ্ণতম বছর হলো ২০২৪ সাল। এটা বললে তাহলে মনে হয় ভুল হবে না। বছরটি উষ্ণতার দিক থেকে আগের সব রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে। এতে বিজ্ঞানীদের পূর্বাভাস সত্য প্রমাণ করে নিশ্চিত হওয়া গেল ২০২৪ ছিল এ গ্রহের এ যাবৎকালের উষ্ণতম বছর। ২০২৪ সালের ২২ এপ্রিল বিশ্ব ধরিত্রী দিবসে ‘নিজেদের বাঁচাতে ধরিত্রী রক্ষা করতে হবে’- এ শিরোনামে প্রবন্ধে লিখেছিলাম ‘পৃথিবীর অস্তিত্ব সংকটের জন্য দায়ী মানুষ’। ২০২৩ সালে বিজ্ঞানীরা সতর্ক করে দিয়ে আরও বলেছিলেন, পৃথিবীর এ অবস্থা মানুষেরই সৃষ্টি। এ গ্রহ গরম হয়ে ওঠার পেছনে জীবাশ্ম জ্বালানির বহুল ব্যবহারই দায়ী। তাই আর সময়ক্ষেপণ নয়, দ্রুত নবায়নযোগ্য জ্বালানির পথে আমাদের হাঁটতে হবে। তা না হলে বর্তমান পরিস্থিতির আরও অবনতি হবে বলে বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) ক্লাইমেট সার্ভিসের তথ্যমতে, জীবাশ্ম জ্বালানির বহুল ব্যবহার শুরুর দীর্ঘ সময়ের গড় উষ্ণতা বাড়ার তুলনায় ২০২২ সালে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বেড়ে দাঁড়ায় ১ দশমিক ৪৮ ডিগ্রি। গত বছরের জুলাই মাস থেকে প্রতিদিনই বৈশ্বিক তাপমাত্রা বাড়ার রেকর্ড সৃষ্টি হয়। অথচ বৈশ্বিক উষ্ণতা রোধের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন এখন সত্যিই ব্যর্থতার দ্বারপ্রান্তে গিয়ে পৌঁছেছে। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন রোধে তাই দরকার গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন ও জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারের রাশ শক্ত হাতে টেনে ধরা। ২০২৩-এর নভেম্বর মাসও তার আগের বছরের নভেম্বর মাসের উষ্ণতার চেয়ে উষ্ণতর মাস হিসেবে রেকর্ড গড়ে। গত বছরের সেপ্টেম্বর, অক্টোবর ও নভেম্বর মাসের তাপমাত্রা বৃদ্ধি ছিল শিল্পায়ন যুগের আগের চেয়ে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি। এক্ষেত্রেও সৃষ্টি হয় নতুন রেকর্ড। ইউরোপভিত্তিক জলবায়ুবিষয়ক পর্যবেক্ষক সংস্থা কোপারনিকাস ক্লাইমেট চেঞ্জ সার্ভিসের (সিথ্রিএস) এক প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়েছে। সেখানে আরও বলা হয়, শিল্পপূর্ব অক্টোবর মাসের গড় তাপমাত্রার চেয়ে ২০২৩ সালের অক্টোবর মাস ছিল অনেক বেশি উষ্ণ। এর তাপমাত্রা ছিল ১ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
কোপারনিকাস সার্ভিসের উপপ্রধান সামান্তা বারগেসের মতে, ২০২৩ সালের ছয়টি মাস এবং দুটি মৌসুম উষ্ণতার বেলায় নতুন রেকর্ড গড়ে। তাই ২০২৩ সাল হলো স্মরণকালের উষ্ণতম বছর। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে জোরদার হয় বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমাবদ্ধ রেখে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার পর্যায়ক্রমে বন্ধ করার দাবি। ২০২৪ সালে এসে আগের রেকর্ড ছাড়িয়ে গত ২৯ বছরের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড হয় ৪৩ দশমিক ৮ ডিগ্রি। এর আগে, ১৯৯৫ সালের পহেলা মে দেশটির সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল ৪৩ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ওই বছরের ২৫ এপ্রিল তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৪৩ ডিগ্রি। ১৯৮৯ সালেও একবার ৪৩ ডিগ্রি ছাড়িয়েছিল জেলাটির তাপমাত্রা। ওই বছরের ৪ মে তাপমাত্রা ৪৩ দশমিক ৩ ডিগ্রি রেকর্ড করা হয়, এ নিয়ে ৪০ বছরে চারবার থার্মোমিটারের পারদ এই মাত্রা স্পর্শ করেছে।
ঢাকা শহরে বাষ্প তৈরি হচ্ছে কিন্তু বের হওয়ার কোনো পথ নেই; অর্থাৎ ঢাকা শহরে কোনো গাছ নেই, আশপাশে কোনো জলাধার বা জলাশয় নেই। খুব সহজে বোঝা গেল গাছের অভাবের কারণেই দাবদাহ, তাপমাত্রা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব রিমোট সেন্সিং অ্যান্ড জিআইএসের একটি চলমান গবেষণার তথ্য অনুযায়ী দেখা গেছে, ২০২০ থেকে ২০২৪- এই চার বছরে ১ মার্চ থেকে ২০ এপ্রিল পর্যন্ত দেড় মাসের তাপমাত্রা তুলনা করা হয়েছে। বছরের এ সময়টায় তাপমাত্রা বেশি থাকে। দেখা গেছে, এ সময় জাহাঙ্গীরনগরের চেয়ে ঢাকায় তাপমাত্রা ২ থেকে ৩ ডিগ্রি বেশি থাকে। জাহাঙ্গীরনগরের তাপমাত্রা কম থাকার কারণ, এখানকার গাছপালা, ওয়েট ল্যান্ডস (জলাভূমি), লতাগুল্মের সবুজ আচ্ছাদন। স্বাভাবিক জীবনযাপনের জন্য ঢাকা শহরে ২০ শতাংশ স্থানে গাছপালায় আচ্ছাদিত রাখা উচিত ছিল, সেখানে আছে মাত্র ২ শতাংশ। অপর একটি পরিসংখ্যানের তথ্যমতে, ১৯৯৫ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ২৯ বছরে ঢাকা নগরাঞ্চলের সবুজ ও ফাঁকা জায়গা ৫২ দশমিক ৪৮ বর্গকিলোমিটার থেকে কমে ২৯ দশমিক ৮৫ বর্গকিলোমিটার হয়েছে।
গত ২৮ বছরে রাজধানী থেকে ২৪ বর্গকিলোমিটার আয়তনের জলাধার উধাও হয়ে গেছে। এ সময়ে প্রায় ১০ বর্গকিলোমিটার সবুজের মৃত্যু হয়েছে। ১৯৯৫ সালে রাজধানীতে জলাধার ও জলাভূমি ছিল ৩০ দশমিক ২৫ বর্গকিলোমিটার। ২০২৩ সালে সেটা মাত্র ৪ দশমিক ২৮ বর্গকিলোমিটারে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে রাজধানীর মাত্র ২ দশমিক ৯১ শতাংশ জলাধার ও ৭ দশমিক ০৯ শতাংশ সবুজ রয়েছে। অথচ একটি আদর্শ শহরে ১২ শতাংশ জলাভূমি ও ১৫ শতাংশ এলাকায় সবুজ থাকা প্রয়োজন। এখন বলতে হচ্ছে রাইস কুকারের মতো যদি বাষ্প বের হতে না পারে ভিতরের তরকারি উপযোগী হবে অথবা নষ্ট হয়ে যাবে ঠিক তেমনি রাজধানীর দাপদাহ বের হওয়ার মাধ্যম যে গাছ, তা পর্যাপ্ত নেই। ফলে একটা সময় ঢাকা শহর অস্তিত্ব হারানোর পাশাপাশি বসবাস অযোগ্য হবে। মানুষের শ্বাসকষ্টসহ নানাবিধ রোগের সৃষ্টি হবে এবং যার শেষ প্রাণহানিও হতে পারে। হাস্যকর হলেও দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, পরিবেশ উপযোগী নয়, এমন গাছে ভরে আছে রাজধানী ঢাকা শহরে। মাটির গঠন মূলত লাল মাটির। এই মাটিতে শালগাছ ভালো হয়। কিন্তু বিভিন্ন প্রকল্পের আওতায় বনসাই, চাইনিজ টগরসহ নানা দামি বিদেশি গাছ লাগানো হচ্ছে, যা পরিবেশ এবং মানুষের উপকারে নেই।
উপকূলবাসীদের প্রতিনিয়তই প্রতিকূল পরিবেশের সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকতে হয়। বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় আমাদের উপকূলীয় এলাকার প্রতিবেশ ব্যবস্থা অনেক সমৃদ্ধ। সেখানে লোনা ও মিঠাপানির মিশ্রণ আছে, বন তৈরির জন্য অনুকূল জলবায়ু আছে। বৃষ্টিপাতও ভালো। বেড়িবাঁধ এবং নদীর পাড়ে বনাঞ্চল হলো উপকূলের রক্ষাকবজ। কিন্তু এসব এলাকায় আমরা বনভূমি টিকিয়ে রাখতে পারিনি। বিগত সময়ে যতগুলো ঘূর্ণিঝড় হয়েছে সব ঘূর্ণিঝড়েই কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। প্রাকৃতিকভাবে যে বন গড়ে উঠছে, তাকে রক্ষা করতে হবে। উপকূলের চর ও নতুন জমি ছাড়াও অনেক ব্যক্তিগত জমি আছে, সেখানে বনায়ন সম্ভব। উপকূলের রক্ষাকবজ বনাঞ্চলের সঠিক পরিসংখ্যান সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে আছে বলে মনে হচ্ছে না। অথচ দিন দিন বনভূমি ধ্বংস করা হচ্ছে। আর বন বা বনাঞ্চল ধ্বংস হয়েছে তারও সুনির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান নেই। অথচ এ বিষয়ে ভুরি ভুরি আইন বিধি রয়েছে।
নদী-নালা, বিল, হাওড়-বাঁওড়ের মতো বহু জলাভূমি রয়েছে বাংলাদেশে। দেশের ৭ থেকে ৮ লাখ হেক্টর ভূমি কোনো না কোনোভাবে জলাভূমির অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু এসব ভরাটের মাত্রা দিন দিন বেড়েই চলেছে। এতে প্রকৃতি, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও নগরের ভারসাম্য ব্যাহত হচ্ছে। ২০২৩ সালের ‘আমাদের কৃষি, প্রকৃতি, জলাভূমির সুরক্ষা এবং নদী দখলদারি প্রতিরোধে করণীয়’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় জলাধার সংরক্ষণ বিষয়টি নতুন করে উঠে এসেছে। বক্তারা বলেন, রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালীরাই নদী, বন, জলাভূমি দখল করে। এগুলোর আইন আছে, কিন্তু প্রয়োগ নেই। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) তথ্য বলছে, সারা দেশে প্রতি বছর ৪২ হাজার একর কৃষি জমি ও জলাশয় ভরাট হচ্ছে।
১৯৯৯ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর গড়ে পাঁচ হাজার ৭৫৭ একর জলাভূমি ভরাট হয়েছে। এর ফলে জলাভূমির ওপর নির্ভরশীল মানুষ ও জীববৈচিত্র্যের ওপর দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। নদী, খাল, বিল, পুকুর ইত্যাদি পরিবেশের ভারসাম্য ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় ব্যাপক ভূমিকা পালন করে থাকে। এ ছাড়া চারপাশের বাতাসকে শীতল রাখা, বর্ষা মৌসুমে বন্যা প্রতিরোধ, শহরে জলাবদ্ধতা নিরসন, পানির চাহিদা পূরণ ও আবর্জনা পরিশোধনে জলাভূমিগুলোর গুরুত্ব অনেক। কিন্তু পৌরসভার কি কাজ, প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন-২০০০-এর ধারা ৫ অনুযায়ী, খেলার মাঠ, উন্মুক্ত স্থান, উদ্যান এবং প্রাকৃতিক জলাধার হিসেবে চিহ্নিত জায়গার শ্রেণি পরিবর্তন করা যাবে না।
পৃথিবী বাসযোগ্য করতে আমাদের করণীয় রয়েছে। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগের মাধ্যমে সব মানুষকে পরিবেশ সচেতন করে তুলতে হবে। বৃক্ষ কর্তন রোধ, বৃক্ষরোপণ ও বনসৃজনের দিকে নজর দিতে হবে।
আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বনাঞ্চল, জলাশয়, নদ-নদী, খাল-বিল সংরক্ষণ করতে হবে। নদী সাগরে প্লাস্টিক ফেলা বন্ধ করতে হবে, প্লাস্টিকের ব্যবহার নিষিদ্ধ করতে হবে। জীবাশ্ম জ্বালানি যথাসম্ভব কম ব্যবহার করতে হবে। জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের দিকে সব মানব জাতিকে নজর দিতে হবে। রি-সাইকেল পদ্ধতির মাধ্যমে দ্রব্যের পুনর্ব্যবহার করতে হবে। পরিবেশ রক্ষার জন্য মাঠ পর্যায়ে সচেতনতামূলক কর্মসূচি করতে হবে, তরুণদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে, বিভিন্ন গবেষণামূলক কাজে প্রশাসনকে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। উপহার হিসেবে কাছের মানুষদের এক হাতে বৃক্ষ, আরেক হাতে বই দিতে হবে। প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরিবেশ রক্ষা এবং জলবায়ু পরিবর্তন বিষয় বাধ্যতামূলক পাঠদানে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, একটি নিরাপদ, টেকসই ও সুন্দর ধরিত্রীর জন্য বাসযোগ্য পৃথিবী করতে নিজেদের এগিয়ে আসতে হবে।
লেখক: সাংবাদিক কলামিস্ট ও গবেষক
নয়া শতাব্দী/এসআর
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ