পরম মমতা, নিরাপত্তা ও নির্ভরতার আশ্রয়স্থল মা। ‘মা’ এক অক্ষরের শব্দ। কিন্তু কী বিশাল তার ব্যাপ্তি। মায়ের অনুগ্রহ ছাড়া পৃথিবীর কোনো প্রাণীরই অনিন্দ্য জীবনের সুবর্ণ আলোয় আলোকিত হওয়ার সাধ্য নেই। সেই গর্ভধারিণী জননীর মহিমা অথবা গৌরবগাঁথা গাওয়ার জন্য একটি বিশেষ দিনের হয়তো প্রয়োজন নেই। কিন্তু একটা দিন যদি মায়ের স্নেহধন্য সন্তান ও তার স্বজনরা মাকে অধিক ভালোবেসে মায়ের যত্নে একটু বেশি মনোযোগী হয়, তাকে নিরুৎসাহিত করার কিছু নেই। মায়ের প্রতি ভালোবাসায় প্রথমত, দ্বিতীয়ত বলে কিছু নেই; শেষ পর্যন্ত তোমায় ভালোবাসি মা।
প্রতিবছর মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের রোববার বিশ্ব মা দিবস পালিত হয়। প্রাচীন গ্রিসে প্রথম মা দিবস উদযাপনের সূচনা হয়। গ্রিকরা তাদের মাতা-দেবী ‘রেয়া’র নামে পূজা দিত। ১৮১৩ সালে আমেরিকান কংগ্রেস মা দিবসকে সরকারিভাবে পালনের অনুমতি দেয়। মা দিবস উদযাপনের প্রথম ভাবনাটি আসে মার্কিন সমাজকর্মী জুলিয়া ওয়ার্ডের মাথা থেকে।
সন্তান দুর্বিপাকে পড়লেই সবার আগে জানে মা। সেই মাকে মানুষ হিসেবে, আত্মার আত্মীয় হিসেবে কোথায় স্থান দিতে হবে, তা কেউ কাউকে শিখিয়ে দিতে পারে না। মা দিবস পালনের নামে ভিনদেশি সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের কথাটি মাতৃপ্রেমের ক্ষেত্রে একদম খাটে না। বরং রোজকার ভালোবাসাকে আরেকটু শাণিত করে আজকের দিনে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে যদি বলা যায়, মাগো তোমায় কত্ত ভালোবাসি, তার হিসাব জানি না। সে সময় মায়ের নিমীলিত চক্ষু থেকে স্নেহের অশ্রুজল দেখার ভাগ্যবঞ্চিত হওয়া কি কারও সাজে? মা উদরে না রাখলে, মায়ের বুকের নির্যাস না খাওয়ালে, হাতে ধরে না হাঁটালে, ঘুমপাড়ানি গান গাইতে গাইতে মুখে বুলি না ফোটালে এই সুন্দর অথচ সংগ্রামমুখর পৃথিবীর কোথাও কি আমাদের ঠাঁই হতো। মা হাজার কষ্ট মুখ বুঁজে সয়েছিলেন বলেই আমরা সন্তানরা খিলখিলিয়ে হাসতে পেরেছিলাম। মা নিজে না খেয়ে আমাদের মুখে অন্ন জুটিয়েছিলেন বলেই উদরপূর্তি করে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পেরেছিলাম। সন্তানের সব দুঃখের বিষ গ্রহণ করে সব মা যে নীলকণ্ঠী। সনাতন ধর্মপুস্তক উপনিষদে যথার্থই লেখা হয়েছে, মাতৃ দেব ভব, অর্থাৎ মা দেবী স্বরূপিণী, জীবন্ত ঈশ্বরী। আব্রাহামিক পুরাণগুলোতেও মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের স্বর্গ থাকার নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে।
তারপরও সম্মান ও মর্যাদায় আমরা কেন মাকে মাথায় করে রাখি না? বুকের ঘরে চিরস্থায়ী মজবুত আসন দিই না? এই আধুনিক সভ্যতার কালেও কেন সন্তানের স্নেহবঞ্চিত মাকে বৃদ্ধাশ্রমের নিঃসঙ্গতায় শেষ জীবন পার করতে হয়? মাকে কেন রাস্তায় শিয়াল-কুকুরের নাকের ডগায় ফেলে রেখে যাওয়ার মতো নিষ্ঠুরতা দেখাতে পারে সমাজের তথাকথিত অভিজাত বর্বরতম সন্তানরা?
খুব স্বাভাবিকভাবেই মানবসত্তার চিরায়ত আপন সেই ‘মা’কে নিয়ে রচিত হয়েছে প্রভাববিস্তারী শিল্প-সাহিত্য, গল্প, উপন্যাস, নাটক বা চলচ্চিত্র।
ম্যাক্সিম গোর্কির ‘দ্য মাদার’-এ শ্রমিকদের অধিকার রক্ষায় সোচ্চার কল্যাণকামী, ধৈর্যের প্রতীক ও সর্বংসহা এক মাকে দেখতে পাই। মায়ের অসীম ও অতুল্য ত্যাগ উপস্থাপিত হয়েছে আনিসুল হকের লেখা বহুল পঠিত ‘মা’ উপন্যাসে। সম্প্রতি এই উপন্যাসটির শততম সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে। উপন্যাসটিতে শহিদ আজাদের মায়ের চরিত্রটি মর্মস্পর্শী ও হূদয়বিদারক আখ্যান হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। শহিদ আজাদ মায়ের কাছে ভাত খেতে চেয়েছিলেন, কিন্তু মাকে ছেলের কাছে পৌঁছতে দেয়নি হানাদাররা। সেই থেকে মা কোনোদিন ভাত ছুঁয়ে দেখেননি। ছেলের শোকে কোনোদিন বিছানায় পিঠ পাতেননি মা। ইলিয়াড মহাকাব্যের হেলেন, মহাভারতের কুন্তী, বের্টল্ট ব্রেখটের মাদার কারেজ, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পথের পাঁচালির সর্বজয়া, একাত্তরের দিনগুলোর জাহানারা ইমাম, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘গোরা’ উপন্যাসের আনন্দময়ী, মানিক বন্দোপাধ্যায় কিংবা শওকত ওসমানের ‘জননী’, হুমায়ূন আহমেদের ‘জোৎস্না ও জননীর গল্পে’র মায়েরা আমাদেরকে মাতৃপ্রেম ও মহত্তম জীবনবোধে উদ্দীপ্ত করে।
জার্মানিতে ‘মা’ দিবসে মাকে কোনো কাজ করতে দেয়া হয় না। বাবাসহ বাচ্চারা সকালের নাশতা তৈরি করে মায়ের জন্য ফুলেল উপহারসহ টেবিলে সাজিয়ে রাখে। পরে মাকে নিয়ে যাওয়া হয় কোনো রেস্তোরাঁয়। একেবারে কিন্ডারগার্টেনের বাচ্চাদেরও তাদের মায়েদের জন্য উপহার তৈরি করা এবং ছবি আঁকতে হয়। বড় বাচ্চারাও নিজেদের হাত খরচের পয়সা থেকে মায়ের জন্য উপহার কিনতে পয়সা জমিয়ে রাখে। মাতৃপ্রেমের এমন মূল্যবোধ বাল্যকালেই শিক্ষা দেয়া হয় সেখানকার শিশুদের। ভবিষ্যতে তারা কি মায়ের মতো দেখতে মানুষদের আর অসম্মান করতে পারবে? নারীকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতে শিখবে? মা তো সর্বশ্রেষ্ঠ নারীই। আমরা কি কোনোদিনই মাকে আঁকড়ে ধরে অমন করে বাঁচতে শিখব না?
বর্তমান সময়কালে নারী তথা মায়ের অমর্যাদার অভিশাপ দেখা দিয়েছে পিতৃ ও পুরুষতান্ত্রিক বাঙালি সমাজজুড়ে। পথে-প্রান্তরে, গণপরিবহনে, কর্মস্থলে এমনকি ধর্মালয়ে পর্যন্ত নারীরা চরমভাবে নিগৃহীত হয়ে চলেছে। বাদ যাচ্ছে না দেড়-দুই বছরের শিশু পর্যন্ত। এমন বাস্তবতায় মায়ের প্রতি ভক্তি ও শ্রদ্ধা ফেরানোর মতো নৈতিক শিক্ষার আর কোনো বিকল্প নেই। মানুষকে মানুষ হয়ে উঠতে হলে সমস্যাসংকুল ও বিপদগ্রস্ত সব শিশুকে পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়স্থল মায়ের নিশ্চিত কোল ফিরিয়ে দিতে হবে। তারপর মানুষকে শেখাতে হবে মায়ের তথা নারীর অপমান মানে নিজেরই অপমান। মায়ের অধিকার বঞ্চনা মানে মানবিকতারই চরম সর্বনাশ।
দিন ফুরোলে আর মাকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। বুক ভাসিয়ে হাজার কেঁদে আকুল হলেও মায়ের শোকের নিদান হবে না। মাকে যারা আপন করে পাননি, তারাই জানেন মায়ের বিচ্ছেদ-বেদনা কেমনতর। মাতৃপ্রেমের কাঙাল অভিমানী রবিঠাকুর সারা জীবন মায়ের জন্য কেঁদেছেন। বড়বেলায়ও মায়ের স্নেহ-বঞ্চনার জন্য বিষণ্ন সময় পার করেছেন। সেকালের সমাজ বাস্তবতায় বনেদি পরিবারের অন্তঃপুরবাসিনী মায়ের সঙ্গে সখ্যের সুযোগ ছিল না কবির। ‘মা তার সাহিত্যে স্থান পেলেন না’ বলে অভিমানে সজল কবি আজীবন তাই আক্ষেপ জিইয়ে রেখেছিলেন। তেমনি অভিমানী কবি কাজী নজরুল ইসলামও মায়ের স্নেহবঞ্চিত ছিলেন। তারপরও তিনি ‘মা’-এর মতো এমন করে একটি কথায় সুধা মেশা আর কিছুই পাননি। মায়ের মতোন এত আদর-সোহাগ কোথাও খুঁজে পাননি। সোৎসাহে তাই ‘মা’ কবিতায় কবি প্রিয় জননীর প্রশস্তি করেছেন:
আয় তবে ভাই বোন,/আয় সবে আয় শোন/গাই গান, পদধূলি শিরে লয়ে মা’র;/মা’র বড় কেহ নাই-/কেউ নাই কেউ নাই! /নত করি বল সবে ‘মা আমার! মা আমার!’
হাজার কষ্টে মায়ের নামটি হূদয়ে স্মরণ করলেই সান্ত্বনা মেলে। এই মায়ের চেয়ে মধুর নাম তিন ভুবনে নাই। মাথার ওপরে সত্য ন্যায়ের ধর্ম হয়ে থাকুক, হূদয়ে বসত করে মা স্নেহরাজি ঝরাক। কেবল আজকের দিন নয়, প্রতিটি ক্ষণ যেন আমরা মাকে স্মরণ করি কবি কাজী কাদের নেওয়াজের ‘মা’ কবিতার পঙক্তিমালায়:
তোমায় স্মরি চোখ ফেটে মোর/অশ্রু যে আজ ঝরে,/প্রাণ যে কেমন করে আমার/মন যে কেমন করে।
লেখক: সাংবাদিক
নয়াশতাব্দী/ডিএ
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ