ঢাকা, শনিবার, ২৯ জুন ২০২৪, ১৫ আষাঢ় ১৪৩১, ২২ জিলহজ ১৪৪৫

সংস্কৃতি এবং অনুভূতি

প্রকাশনার সময়: ১১ মে ২০২৪, ১১:০২

বাংলা জনপদের সমাজ সংস্কৃতিতে পহেলা বৈশাখ বা নববর্ষ তাৎপর্যপূর্ণ একটি দিন। বাংলা জনপদটি হাজার বছর ধরে পরাধীন ছিল। এই জনপদটির স্বাধীনতা লাভ করেছিল জাতীয়তাবাদের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে। তাই এ জনপদের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে বাংলার সংস্কৃতি। ১৯৪৭ সালে তথাকথিত দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে বাংলা জনপদটি দুই ভাগে বিভক্ত হয়। এই বিভক্তকরণ প্রক্রিয়াটা সম্পন্ন হয়েছিল ধর্মপালন মানুষের আনুপাতিক হারে। পূর্ব বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ পালন করত ইসলাম ধর্ম। তাই পূর্বাংশ যা বর্তমান বাংলাদেশ এই ভূখণ্ডটি মিশে যায় পাকিস্তানের সঙ্গে। তবে নিজস্ব সংস্কৃতির বলয়টি ছিল তখনো অক্ষুণ্ন। তাই তৎকালীন পাকিস্তান সরকার বিভিন্নভাবে বাংলা জনপদের সংস্কৃতিটা নির্মূল করতে নানা ধরনের উদ্যোগ নেয়। পাকিস্তান সরকার রাষ্ট্রভাষা করতে চায় উর্দু। বাংলা সংস্কৃতির কণ্ঠ রোধ করতে পাকিস্তান সরকার প্রথম যে উদ্যোগটি নিয়েছিল তা ছিল মারাত্মক। পাকিস্তান সরকার বাংলা বর্ণমালাকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার জন্য কিছু কার্যক্রম গ্রহণ করে। যেমন তৎকালীন পাকিস্তান সরকার বাংলা শব্দগুলো বাংলা অক্ষরে না লেখে আরবি হরফে লেখার জন্য উদ্যোগী হয়। এই জনপদের মানুষের অস্থিমজ্জার সঙ্গে মিশে আছে বাঙালি সংস্কৃতি, বাংলার মানুষ প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। তাই জনগণের প্রতিরোধের মুখে পাকিস্তানি সরকার আর বাংলা বর্ণমালা নিশ্চিহ্ন করতে পারেনি। বাংলা নববর্ষ বাঙলা জনপদের সংস্কৃতির সবচেয়ে বড় একটি প্রথা। এ প্রথাটি এই জনপদের মানুষ নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে পালন করে। বাংলা নববর্ষ উৎসবটি এই জনপদের ধর্ম বর্ণ সবাই একত্রিত হয়ে পালন করে। তাই বাংলা জনপদে পহেলা বৈশাখের চেয়ে বড় কোনো উৎসব আর নেই। পাকিস্তানি সরকার পহেলা বৈশাখকে উদযাপনকে বিধর্মীয় কালচার হিসেবে আখ্যা দেয়। বাঙালিরা চিরকালই ধর্ম নিরপেক্ষ। তাই এই আখ্যার প্রতিবাদে ফুসে ওঠে বাংলার মানুষ, তাছাড়া পাকিস্তানিরা নববর্ষ ও রবীন্দ্র চর্চার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। কিন্তু বাংলার মানুষ তা মানেনি। ১৯৬১ সালে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটের মিলনায়তনে ছায়ানটের প্রথম গানের অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। এ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে রবীন্দ্র চর্চার ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞার প্রতিবাদ জানায় বাংলা জনপদের মানুষ, সেই সঙ্গে ১৯৬১ সাল, বাংলা ১৩৭১ সালের ১ বৈশাখ উদযাপনের সূচনা করে ছায়ানট। বাংলা নববর্ষে দিনটি উদযাপনের জন্য ছায়ানট স্থানটি নির্বাচন করেছিল রমনা বটমূল। আবহমান বাংলার ঐতিহ্য রক্ষায় ছায়ানটের নববর্ষ উদযাপন এখনো রমনার বটমূলে অনুষ্ঠিত হয়। সংস্কৃতি হলো মনস্তাত্ত্ব্বিক বিশ্বাস। যা মানুষ বংশ পরম্পরায় লালন ও চর্চা করে আসছে।

সংস্কৃতি শব্দটির আভিধানিক অর্থ মানবীয় বৈশিষ্ট্যের উৎকর্ষ সাধন। সংস্কৃতি বা কৃষ্টি হলো সেই জটিল সামগ্রিকতা যাতে অন্তর্গত আছে জ্ঞান, বিশ্বাস, নৈতিকতা, শিল্প, আইন, রাজনীতি, আচার এবং সমাজের একজন সদস্য হিসেবে মানুষ দ্বারা অর্জিত সম্ভাব্য সামর্থ্য বা অভ্যাস। ওয়ারউইক বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত ভাষা তত্ত্বের অধ্যাপক হেলেন স্পেনসার-ওয়েটেইয়ের মতে, “সংস্কৃতি হলো কিছু বুনিয়াদি অনুমান, মূল্যবোধ ও জীবনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির বিশ্বাস, নীতিমালা, প্রক্রিয়া এবং আচরণিক প্রথার অস্পষ্ট সমষ্টি, যা একদল মানুষ ভাগ করে নেয় এবং সেই সমষ্টি দলের প্রত্যেক সদস্যের আচরণকে এবং তার কাছে অন্য সদস্যদের আচরণের অর্থ বা সংজ্ঞায়নকে প্রভাবিত করে কিন্তু নির্ধারিত করে না।” সংস্কৃতি শব্দটা এসেছে মারাঠী থেকে। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় বাংলায় কালচার অর্থে সংস্কৃতি শব্দটা প্রস্তাব করলে রবীন্দ্রনাথ অনুমোদন দেয়। এর আগে বাংলায় কৃষ্টি শব্দটা চালু ছিল সংস্কৃতি অর্থে। রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন কৃষ্টি শব্দটা কৃষি থেকে সম্পর্কিত তাই কালচার অর্থে সংস্কৃতিটাই উপযুক্ত। যাই কৃষ্টি এবং কালচার সম্পূরকার্থে ব্যবহূত হতে পারে। তাই সংস্কৃতি শুধুমাত্র গান, কবিতা, নাটক, উপন্যাস বা সাহিত্য সম্পর্কিত বিষয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ না। এটা একটি জনপদের সামগ্রিক প্রথাগুলোকে বুঝায়। তবে সময় এবং পরিবেশ পরিস্থিতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সংস্কৃতির পরির্বতন হয়। তবে কোনো অঞ্চলের সংস্কৃতি তার বুনিয়াদি ধারা থেকে বিচ্যুত হলে তা আর সেই অঞ্চলের সংস্কৃতি হিসেবে বিবেচিত হয় না। বাংলা জনপদের সংস্কৃতিগত প্রথাগুলোর পরির্বতন ঘটাতে বারবার উপনিবেশিক শাসকরা আঘাত হেনেছে। উপনিবেশিক শাসকদের সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ ঘটানোর চেষ্টা করেছে। কিন্তু বাংলা জনপদের মানুষ সেই পরিবর্তন ঘটানো প্রক্রিয়াকে বাধা দিয়ে থামিয়ে দিয়েছে। বাংলা সংস্কৃতির বিশাল অংশজুড়ে আছে মরমী সাধক লালন শাহ। লালনের রচনাগুলো এই পৃথিবীর ধর্ম নিরপেক্ষতার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। লালন বাংলা সংস্কৃতিজুড়ে বিরাজ করছে। বাংলা সংস্কৃতি অনুশীলন করতে গিয়ে আজকে বাঙালিদেরকে নানাভাবে নাজেহাল হতে হয়। সঞ্জয় নামে এক বাঙালি তার ফেসবুকে লালনের গানের কয়েকটা লাইন লিখেন। লালন বাঙালি সঞ্জয়ের অনুভূতিজুড়ে বিরাজ করছে, তাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে লালনের গানের কলিগুলো লিখে তিনি তার অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ ঘটান। এটা নাকি কারও কারও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করেছে, সেই জন্য সঞ্জয়কে পোহাতে হয় নানা আইনি জটিলতা। সঞ্জয় লালনের যে কথাগুলো লিখেছিলেন তা ছিল বাংলা জনপদের মানুষের হূদয়ের কথা। বাঙালিকে যদি তার সংস্কৃতিকে অনুশীলন করতে না দেয়া হয় তা বাঙালির অনুভূতিকে আঘাত করার শামিল। যারা বাঙালি অনুভূতিতে আঘাত করে বা বাঙালিকে তার সংস্কৃতিময় অনুভূতিকে প্রকাশ করতে দেয় না, কেন তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হয় না। মহান মুক্তিযুদ্ধটা ছিল বাংলা জনপদের সংস্কৃতি রক্ষার একটি সংগ্রাম। বাঙালিরা তার সংস্কৃতির অনুপ্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে তার সংস্কৃতির ভৌগোলিক সীমানাকে মুক্ত করেছে। যার ফলে বাংলাদেশ হয়েছে স্বাধীন। লাখ লাখ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত সংস্কৃতি পালনের ক্ষেত্রে কেন বাধা আসে। বাংলা জনপদের মানুষের অনুভূতিজুড়ে বিরাজ করছিল এই জনপদের সংস্কৃতি ধারা ও প্রথাগুলো। পাকিস্তানি ও উপনিবেশিক সরকার এই প্রথাগুলো রদ করতে চেয়েছিল, আর উপনিবেশিকদের এই চাওয়াটা ছিল বাংলা জনপদের মানুষের অনুভূতির ওপর চরম আঘাত। এই আঘাতের প্রতিঘাত দিতে বাংলা জনপদের মানুষ উপনিবেশিক শাসকদের বিতাড়ন করে। সুতরাং বাংলার মানুষের মনস্তাত্ত্বিক অনুভুতির বড় অংশজুড়ে আছে বাংলার সংস্কৃতির কিছু প্রথা। যা তারা নিবিড়ভাবে পালন করে। বর্তমানে দেখা যায়, আবহমান বাংলার সংস্কৃতি পালন করতে গিয়ে আইনি বেড়াজালে নাজেহাল হতে হয় এদেশের মানুষকে। উদীচীকে বাংলা নববর্ষ পালনে বেঁধে দেয়া হয় সময়। ময়মনসিংহ জেলার ভালুকা উপজেলার গ্যাস লাইনের মোড়ে বৈশাখী মেলার আয়োজন বন্ধ করে দেয় প্রশাসন। প্রশাসনের দাবি- আয়োজকরা প্রশাসনের অনুমতি নেয়নি। ভালুকা কলেজ মাঠে প্রতি বছর পহেলা বৈশাখে বৈশাখী মেলার আয়োজন করা হতো। এবার নাকি জেলা প্রশাসকের অনুমতি না থাকায় তা হয়নি। বাংলা জনপদের মানুষ যদি বাংলা নববর্ষসহ তার সংস্কৃতি পালন করতে না পারে তাহলে আগামী প্রজন্ম কী সংস্কৃতি অনুশীলন করবে। অথচ আমরা দেখি জলসা ওয়াজের নামে লাউড স্পিকারে উচ্চ শব্দ করে নানা ধর্মীয় প্রলেপে মৌলবাদ প্রচার করা হয়। মৌলবাদ চর্চাকারীদের অনুমতির প্রয়োজন হয় না।

বাংলা সংস্কৃতির অনুশীলন বাঙালির অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ। অনুভূতির বহিঃপ্রকাশের ক্ষেত্রে বাধা দেয়া অনুভূতিতে আঘাতের শামিল। আর যারা বাঙালি সংস্কৃতির অনুশীলনে বাধা দেয় তাদেরকে অনুভূতিতে আঘাত দেয়ায় আইনের আওতায় এনে সাজা দেয়ার ব্যবস্থা করা উচিত সরকারের।

লেখক: কলামিস্ট

নয়াশতাব্দী/ডিএ

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ