রাষ্ট্র স্বধর্মেই বলীয়ান, তাই আরোপিত রাষ্ট্রধর্ম তার লাগে না। কেন? ইসলামি শরিয়তের পরিভাষায় ‘রাষ্ট্রধর্ম’ বলে কোনো টার্ম নাই। আর যদি বলেন আছে, তাহলে কোরআন ও হাদিসের আলোকে রেফারেন্স দিন। সসম্মানে আমি আমার ভুল শুধরে নেব। তাহলে ইসলামে যেটা নাই, মনগড়াভাবে সেটা উদ্ভাবন করাকে বলে ‘বিদআত’- যা মুসলমানের জন্য অবশ্য পরিত্যাজ্য। রাষ্ট্রকে নিরপেক্ষ থাকতে হয় তার মৌলিক কাঠামো সুসংহত রাখার জন্য। একটা রাষ্ট্রে শুধুমাত্র মুসলিম বাস করে না এবং কেবলমাত্র মুসলিমের সঙ্গে সম্পর্ক রাখলেও তার চলে না, মুসলমানের জন্য, মুসলমানের দ্বারা এবং মুসলমান কর্তৃক চিন্তাধারা বাস্তবায়ন করে কোনো রাষ্ট্রই টিকে থাকতে পারবে না। পৃথিবীর ৪৩০০ ধর্মমতকে সমান সম্মান দিয়েই রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব টিকিয়ে রাখতে হয়। ইহুদি ইসরায়েলের ইন্টারনেট ছাড়া বা আমেরিকার অস্ত্র ছাড়া সৌদি আরবের চলে না, তেমনি সৌদি আরবের তেল ছাড়া আমেরিকা বা ইসরায়েলেরও চলে না।
সর্বোপরি স্রষ্টা একটা বহুমাত্রিক ফুলের বাগান থেকে বিচিত্র সুবাস ও নানাবিধ সুরকাকলি শুনতে চান বলেই সৃজনের পর থেকে এ পর্যন্ত বহুমতের মানুষে ভরা পৃথিবী নামের মনুষ্য তীর্থস্থান। তিনি তো চাইলেই পারেন নিমিষে তাঁর পছন্দের একদেশদর্শী মানুষে ভরিয়ে দিতে, তিনি তা দেন না।
কোনো নির্দিষ্ট ধর্মের প্রতি একটা রাষ্ট্রের ঈমান আনার সক্ষমতা নাই। রাষ্ট্র হজ করতে যাবে না, কোরবানি দেবে না, জাকাত দেবে না, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়বে না, তার মৃত্যুর পর জানাজা বা কবরও হবে না। হাশরের ময়দানে রাষ্ট্রের বিচার হবে এমন কথাও পবিত্রগ্রন্থের কোথাও বলা নাই। তাহলে রাষ্ট্রকে মুসলমানিত্ব বরণ করতে হবে এমন কথারও কোনো যুক্তি বা গ্রাহ্যতা নাই। ধর্ম এসেছে মানুষের মুক্তির জন্য। আর রাষ্ট্র চলে মানুষের গড়া সংবিধানের নিয়ম মেনে। রাষ্ট্র সব ধর্মকে সমান সম্মান দেয়, নির্দিষ্ট ধর্মের অন্তর্ভুক্তি তার লাগে না।
বাংলাদেশের এখনকার সংবিধান মুসলিমদের কাছে পবিত্র বাক্য ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ দিয়ে শুরু হয়েছে। নিজের স্বৈরাচারিত্ব পোক্ত করতে মুসলিম নুইসেন্স নিজের পক্ষে রাখতে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে যেটা করেছিলেন ধুরন্ধর এরশাদ। হোক সংখ্যায় একজন, শুধুমাত্র মুসলিমরাই তো এদেশের নাগরিক নন। বাংলাদেশের আইনসিদ্ধ নাগরিক একজন নৃ-গোষ্ঠী চাকমাকেও এই সংবিধান পাঠ করতে হয়। তাকে কেন জোরজবরদস্তিতে ইসলামি বাক্য পাঠ করতে বাধ্য করা হবে? যেখানে স্বয়ং আল্লাহ তায়ালাই বলেছেন, তোমরা ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করো না। যার যার ধর্ম তার তার।
“লাকুম দ্বীনুকুম ওয়ালিয়া দ্বীন” এর মতো মহৎ বাণীর মানে হলো “তোমার ধর্ম তোমার কাছে আর আমারটা আমার”। কোরআনের ১০৯ নম্বর সুরা কাফিরুনের ৬ নম্বর আয়াতে লেখা আছে এই কথা। কোরআনের ২ নম্বর সুরা আল বাকারার ২৫৬ নম্বর আয়াতে লেখা “ধর্মের ব্যাপারে কোনো জোরজবরদস্তি নেই”।
তাহলে আমরা দেশের যেটা সামষ্টিক আইনের মূলগ্রন্থ সংবিধান, তার ওপর কীভাবে একটা নির্দিষ্ট ধর্মের তকমা আরোপ করি? একজন নৈধার্মিক যিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সশরীরে অংশ নিয়েছেন আবার ব্যক্তিগত বিশ্বাসের জায়গা থেকে ইসলামের অনুসারী নন, তিনি কেন বিসমিল্লাহ বলে সংবিধানের কানুন পড়বেন বা মানবেন। এটা তার প্রতি অনধিকার আরোপিত আচার। যা কোনো সুসভ্য মানুষই করবে না।
৬২২ খ্রিস্টাব্দ তথা প্রথম হিজরিতে মহানবী (সা.) মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করার পর দাস্তুর আল মদিনা বা মদিনা সনদ প্রণয়ন করেন। যেটাকে বৈশ্বিকভাবে একটি রাষ্ট্র কাঠামোর প্রথম লিখিত সংবিধানের মর্যাদা দেয়া হয়। ৪৭টি ধারায় এর মূল বিষয়বস্তু লিপিবদ্ধ করা হয়েছিল। *প্রথম ধারায় বলা হয়েছিল— সনদপত্রে স্বাক্ষরকারী সম্প্রদায়সমূহ একটি জাতি গঠন করবে;
এখানে বলা হয়নি মদিনা একটি ইসলামি রাষ্ট্র হবে এবং তার ধর্ম হবে ইসলাম। শুধু মুসলিমরাই সেখানে বসত করবে। *চতুর্থ ধারায় বলা হয়েছিল— মুসলিম, খ্রিস্টান, ইহুদি, পৌত্তলিক ও অন্যান্য সম্প্রদায় ধর্মীয় ব্যাপারে পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করবে, কেউ কারও ধর্মীয় কাজে কোনো রকম হস্তক্ষেপ করতে পারবে না;
*পঞ্চম ধারা ছিল এমন— মদিনার ওপর যে কোনো বহিরাক্রমণকে রাষ্ট্রের জন্য বিপদ বলে গণ্য করতে হবে এবং সেই আক্রমণকে প্রতিরোধ করার জন্য সকল সম্প্রদায়কে এক জোট হয়ে অগ্রসর হতে হবে; এবং
*একাদশতম ধারায় বলা হয়েছিল— মুসলমান, ইহুদি ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের লোকরা পরস্পর বন্ধুসুলভ আচরণ করবে;
বাংলাদেশের জন্মলগ্নে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধটাও হয়েছিল ধর্ম বর্ণ জাতি গোষ্ঠী নারী পুরুষ নির্বিশেষে সবার সামষ্টিক ঐকমত্য ও প্রতিরোধ যুদ্ধে। যার আলোকে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ৭২ -এ এমন একটা সংবিধান প্রণয়ন করা হয়েছিল যেখানে সর্বমতের মানুষের সমান প্রাধান্য ও অধিকার নিশ্চিত থাকে।
পবিত্র নগরী মদিনাতেও মহানবী (সা.) এমনটাই করেছিলেন। যেখানে সব ধর্মের মানুষকে নিয়ে তিনি একটা জাতিরাষ্ট্র গঠন করার কথা লিখিত সংবিধানের মাধ্যমেই বলে দিয়েছিলেন। অনুরূপভাবে একালেও বিশ্বের অধিকাংশ মুসলিম দেশের সংবিধানে সুনির্দিষ্ট করে কোনো রাষ্ট্রধর্মের কথা বলা নাই। সব কথার এক কথা ‘রাষ্ট্রধর্ম’ বলে ইসলামিক কোনো পরিভাষাই নেই। যেটা নেই সেটা মান্যতারও প্রশ্ন নেই।
১৯৭৩ এর ৫ সেপ্টেম্বর আলজেরিয়ার রাজধানী আলজিয়ার্সে চতুর্থ ন্যাম সম্মেলনে যোগ দেন বঙ্গবন্ধু। বৈঠক চলাকালীন সময়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সৌদির বাদশাহ ফয়সালের সঙ্গে একটি দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। মূল উদ্দেশ্য ছিল দেশের মুসলিমদের জন্য পবিত্র হজব্রত পালনের দ্বার উন্মুক্ত করা। বাদশাহ ফয়সাল যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের জন্য দানদক্ষিণা তথা ভিক্ষা চাইতে বলেন বঙ্গবন্ধুকে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু সে কথায় পাত্তা না দিয়ে হজের প্রসঙ্গটি তোলেন। তখন বাদশাহ ফয়সাল জানায়, সৌদি আরবের স্বীকৃতি পেতে হলে বাংলাদেশের নাম পরিবর্তন করে Islamic Republic of Bangladesh করতে হবে।
প্রত্যুত্তরে দৃঢ়চিত্তে বঙ্গবন্ধু বলেন, এই শর্ত বাংলাদেশে প্রযোজ্য হবে না। বাংলাদেশের জনগণের অধিকাংশ মুসলিম হলেও, আমার প্রায় এক কোটি অমুসলিমও রয়েছে। সবাই একসঙ্গে স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছে, ভোগান্তিতে পড়েছে, আর সর্বশক্তিমান আল্লাহ শুধুমাত্র মুসলিমদের জন্যই নন, তিনি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের স্রষ্টা।
ইউর এক্সেলেন্সী, ক্ষমা করবেন, তাছাড়া আপনার দেশের নামও তো Islamic Republic of Saudi Arabia” নয়। আপনাদের ফাদার অব দ্য নেশন বাদশা ইবনে সৌদের নামে নাম রাখা হয়েছে Kingdom of Saudi Arabia”। আমরা কেউই এই নামে আপত্তি করিনি। খুব স্বাভাবিকভাবেই বৈঠক আর চলেনি। সেই স্বঘোষিত ফার্স্টক্লাস মুসলিম দেশ তাদের ভাষায় থার্ডক্লাস মুসলিমদের বাংলাদেশকে সৌদি আরব স্বীকৃতি দিয়েছিল ৭৫-এ বিপথগামী সেনা ও বৈশ্বিক চক্রান্তে বঙ্গবন্ধু যেদিন এই ভূমিতে চিরশায়িত হন সেদিন।
বাদশাহ ফয়সালদের মতোই হিপোক্রিট এরশাদ তার নিজের স্বার্থে রাষ্ট্রধর্ম নামের বিদআত আমদানি করেছিলেন। ১৯৮৮ সালের জুনে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করার প্রতিবাদে হরতাল করেছিল বিএনপি। প্রতিবাদ সভা ও মিছিল করেছিল আওয়ামী লীগ। ধর্মের নামে জাতিকে বিভক্ত করার চেষ্টা মানুষ মানবে না বলে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া দৃপ্ত উচ্চারণ করেছিলেন। সেই এরশাদকে কোলেপিঠে করে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত মানুষের মর্যাদা দিয়ে রেখেছিল রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি।
পরবর্তীতে অধার্মিক এরশাদ আরোপিত সংবিধানের ‘রাষ্ট্রধর্ম’ নিয়ে এরশাদ পরবর্তী দেশের কর্ণধাররা কেউই আর আলাপ বাড়াননি। কারণ এ সময় ধর্মও রাজনীতির এক অনিবার্য ও আগুনের অংশ। যেখানে হাত দেয়া মানে আপাত শান্ত অগ্নিগিরিটার অগ্ন্যুৎপাত স্টার্ট করে দেয়া। গণমানুষের অন্ন বস্ত্র বাসস্থান শিক্ষা এবং সুশাসন যেখানে মূল প্রায়োরিটি সেখানে রাষ্ট্রের ধর্ম নিয়ে এক্সট্রিমিস্টদের উন্মাদনা ছড়িয়ে দেয়া বিরাট ঝক্কির।
আমরা শেষ কথাগুলো বিদআত নিয়ে বলতে পারি।
বিদআত একটি আরবি শব্দ যার আভিধানিক অর্থ নতুন কোনো বিষয় সৃষ্টি করা বা উদ্ভাবন করা। ইসলামি শরিয়তের পরিভাষায় দ্বীনদারী কিংবা আমল ও ইবাদতের নামে নব উদ্ভাবিত এমন সব কাজ, যা রাসুল (সা.) কোনো সময় করেননি এবং যার কোনো নমুনা সাহাবি কিংবা তাবেঈনদের যুগেও পাওয়া যায়নি।
সুন্নাত আল্লাহ রাসুল থেকে অনুসৃত আর বিদআত ব্যক্তিবিশেষ কর্তৃক উদ্ভাবিত, তাই বিদআতের ব্যাপারে আল্লাহর রাসুল (সা.) কঠোর সতর্ক বাণী উচ্চারণ করেছেন। তিনি বলেন, যে ব্যক্তি এমন কোনো কাজ করল, যা করা সম্পর্কে আমাদের কোনো হুকুম বা নির্দেশনা নেই তা অগ্রাহ্য। যে ব্যক্তি আমাদের দ্বীনি কাজের ওপর অন্য কোনো কাজ আবিষ্কার করল তা হবে অগ্রাহ্য। (আবু দাউদ, হাদিস: ৪৬০৬, ইবনে মাজাহ, হাদিস: ১৪)। সাবধান, তোমরা দ্বীনে নতুন কোনো (ইবাদত) কিছু করা থেকে বিরত থাকবে। কেননা, এতে প্রত্যেক নতুন কিছু করার নামই বিদআত। আর প্রত্যেক বিদআতই গোমরাহী আর প্রত্যেক গোমরাহী হবে জাহান্নামি। (আবু দাউদ: ৪৪৪৩, ইবনে মাজাহ: ৪৬)। বিদআতীরা ইহকাল ও পরকাল দুই জগতেই লাঞ্ছিত হবে। তাদের জন্য অপেক্ষা করবে খারাপ পরিণাম।
এ আলোচনার পরও যারা রাষ্ট্রধর্ম নিয়ে পেরেশানিতে থাকবেন এবং উন্মাদনা সৃষ্টি করবেন বলে পণ করে আছেন, তাদেরকে বলব ধৈর্য ধরুন। ধর্ম-দর্শন ও রাষ্ট্রনীতি নিয়ে আরেকটু পড়াশোনা করুন। এরশাদের বায়োগ্রাফি ভালো করে জানুন। সবচেয়ে বড় কথা ধর্মকর্ম আপনি করবেন এবং তার ফলাফলও আপনিই ভোগ করবেন। রাষ্ট্রের সেই দায় একদম নেই। ধর্ম মানে বৈশিষ্ট্য। আর বাংলাদেশের ধর্ম হলো বাঙালি জাতীয়তাবাদ। রাষ্ট্র তার সেই স্বধর্মেই বলীয়ান। আরোপিত রাষ্ট্রধর্ম তার কেন লাগবে?
লেখক: সাংবাদিক
নয়া শতাব্দী/এসআর
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ