অনেক মানুষের ভিড়ে জন্ম নেয় একজন ক্ষণজন্মা দেশপ্রেমিক বিপ্লবী মানুষ। দেশের জন্য জীবন উৎসর্গের কাহিনি আমাদের দেশে নতুন নয়। যুগে যুগে বীর সন্তানরা নিজের রক্তের বিনিময়ে দেশকে মুক্ত করেছেন। নিজের জীবনের চেয়ে দেশের মানুষের কথা ভেবেছেন তারা। এখানে নারী-পুরুষ যোগ দিয়েছেন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একসঙ্গে। দেশের জন্য জীবন দিয়ে যে নারীরা অমর হয়ে আছেন, তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন বিপ্লবী অগ্নিকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার।
১৯১১ সালের ৫ মে, বর্তমান চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া উপজেলার ধলাঘাট গ্রামে জন্ম নিয়েছিলেন প্রীতিলতা। মেয়ের গায়ের রং কালো, তখন তার ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তায় পড়ে গেলেন আত্মীয়-স্বজনরা।
ভারতবর্ষে আজো মানুষের গায়ের রং যে তার ভবিষ্যতের কিছু ব্যাপার নিয়ন্ত্রণ করে থাকে, তার ব্যতিক্রম সে সময়েও ছিল না। সবাই যখন এরকম এক মেয়েকে নিয়ে হা-হুতাশ করছে, তখন মা তার নাম রাখলেন ‘রানি’। বললেন, “আমার এ কালো মেয়েই একদিন তোমাদের মুখ আলো করবে”। সেদিনের এই ছোট্ট মেয়েটি আর কেউ নন, ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম চেনা মুখ প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার। প্রীতিলতা ডা. খাস্তগীর সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু করেন। পড়াশোনায় ভালো হওয়ায় প্রীতিলতা ছিলেন শিক্ষকদের প্রিয়। তার প্রিয় শিক্ষক ঊষাদিই একদিন প্রীতিলতাকে ‘ঝাঁসির রানি লক্ষ্মীবাই’ নামের একটি বই পড়তে দেন। বইটি প্রীতিলতা ও তার খুব ঘনিষ্ঠ একজন বন্ধু কল্পনা দত্তের মনোজগতকে দারুণভাবে আলোড়িত করে, ছোটবেলা থেকে লালিত বিজ্ঞানী হওয়ার স্বপ্নের স্থানে জায়গা করে নেয় বিপ্লবী হওয়ার স্বপ্ন। ঘটনার ধারাবাহিকতায় একদিন প্রীতিলতাদের বাড়িতে আসেন পূর্ণেন্দু দস্তিদার, বিপ্লবী দলের কর্মী। তিনি সরকার কর্তৃক বাজেয়াপ্ত কিছু বই প্রীতিলতার কাছে গোপনে রেখে গেলে কৌতূহলবশত প্রীতিলতা বইগুলো খুলে দেখে এবং একে একে পড়ে ফেলে ‘বাঘা যতীন’, ‘দেশের কথা’, ‘ক্ষুদিরাম’ আর ‘কানাইলাল’। সেই বয়সেই বইগুলো প্রীতিলতার চিন্তাজগতে যথেষ্ট প্রভাব ফেলে। তখন তিনি সবে দশম শ্রেণির ছাত্রী। তখন থেকেই তিনি দেশের কাজে অংশগ্রহণের কথা ভাবতে শুরু করেন। কিছুদিন পর তার সেই বিপ্লবী দাদা পূর্ণেন্দু দস্তিদার তাদের বাড়ি এলে প্রীতিলতা জানান যে তিনিও বিপ্লবী হতে চান। কিন্তু তখন পর্যন্ত দলে কোনো নারী সদস্য নেয়া হতো না। ফলে প্রীতিলতারও যোগ দেয়া হলো না বিপ্লবী দলে। কিছুদিন পরেই লেটারমার্ক সহ ম্যাট্রিক পাস করে ঢাকায় ইডেন কলেজে পড়তে যাওয়ায় বিপ্লবী দলে যোগদানের একটা সম্ভাবনার দ্বার খুলে যায় তার জন্য। ঢাকায় সেসময় ‘শ্রীসংঘ’ নামে একটি বিপ্লবী দল ছিল। আর ‘দীপালি সংঘ’ নামে ছিল শ্রীসংঘের একটি নারী শাখা। এই শাখার নেত্রী ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লীলা নাগ। ‘দীপালি সংঘ’ মূলত শ্রীসংঘের নেতৃত্বে গোপনে মেয়ে বিপ্লবী সংগঠন গড়ে তুলত। ইডেনে পড়ার সময় দৃঢ় মনোবল ও দেশের প্রতি ভালোবাসা দেখে তারই এক শিক্ষিকা তাকে দীপালি সংঘের সদস্য হওয়ার কথা বলেন এবং গ্রীষ্মের ছুটিতে বাড়ি যাওয়ার সময় তাকে সংঘের সদস্য হওয়ার জন্য একটা ফরম দেন।
বাড়ি ফেরার পর প্রীতিলতা ফরমটি তার বিপ্লবী দাদাকে দেখালে দাদা সেটি নিয়ে সূর্য সেনের সঙ্গে দেখা করেন। ততদিনে বেঙ্গল অর্ডিন্যান্সের বিনা বিচারে আটকে থাকা নেতারা একে একে মুক্ত হয়ে ফিরে আসছেন। দীপালি সংঘের ফরমটি দেখে সূর্য সেন বিপ্লবে মেয়েদের অংশগ্রহণের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে আলোচনা করে প্রীতিলতাকে গোপনে দলের অন্তর্ভুক্ত করেন এবং বলেন, প্রীতিলতা চাইলেই দীপালি সংঘের সদস্য হতে পারবেন। এবার ঢাকায় ফিরে দীপালি সংঘে যোগ দিয়ে ছোরাখেলা, লাঠিখেলা প্রভৃতি বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিতে থাকেন প্রীতিলতা। ১৯২৯ সালে আইএতে মেয়েদের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করে বৃত্তি নিয়ে কলকাতায় বেথুন কলেজে পড়তে যান প্রীতিলতা। বেথুন কলেজে পড়ার সময় প্রীতিলতা জানতে পারেন, রামকৃষ্ণ বিশ্বাস, চট্টগ্রামের আরেক বিপ্লবীর কথা। যিনি তখন ফাঁসির আসামি হিসেবে জেলে আছেন। তার কথা শোনার পর থেকে প্রীতিলতা অস্থির হয়ে ওঠেন, তার সঙ্গে দেখা করার জন্য। কিন্তু কোনো বিপ্লবীর সঙ্গে সরাসরি এভাবে দেখা করা ছিল বিপজ্জনক। তাই শেষমেশ আরতি ছদ্মনামে রামকৃষ্ণের দূর সম্পর্কের বোনের পরিচয় নিয়ে প্রীতিলতা তার সঙ্গে দেখা করতে যান। এরপর যতদিন রামকৃষ্ণ বেঁচে ছিলেন, ততদিনে অনেকবার গেছেন প্রীতিলতা তার সঙ্গে দেখা করতে।
রামকৃষ্ণের সঙ্গে দেখা হওয়ার দিনগুলোর মধ্যেই প্রীতিলতা এবং কল্পনা দত্ত বেশ কয়েকবার কলকাতা থেকে চট্টগ্রামে ফেরার পথে লুকিয়ে বোমার খোল নিয়ে গেছেন। পৌঁছে দিয়েছেন চট্টগ্রামের বিপ্লবীদের কাছে। সবার সঙ্গে বোমা বানিয়েছেন। বিপজ্জনক কাজ বলে মাস্টারদা তাকে অনেকবার নিষেধ করেছেন, কিন্তু প্রীতিলতা নিষেধ শোনেননি। তিনি বলেছেন, “ওরা পারলে আমিও পারব।” বোমার গান-কটন কেনার জন্য গায়ের সামান্য গয়নাটুকুও তিনি তুলে দিয়েছেন বিপ্লবীদের হাতে। ১৯৩২ সালে বিএ পরীক্ষার পর বাড়ি এসে প্রীতিলতা দেখেন, বাবার চাকরি নেই। এমতাবস্থায় তাকেই পরিবারের হাল ধরতে হয়। নন্দনকানন উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকার চাকরি পান তিনি। নিজের কাজ নিয়ে ভালোই সময় কেটে যাচ্ছিল তার, কিন্তু সব সময় মাথায় ছিল মাস্টারদার সঙ্গে সাক্ষাতের চিন্তা। এদিকে চট্টগ্রামে থাকা কল্পনা দত্তের সঙ্গে অনেক আগেই মাস্টারদার সাক্ষাৎ হলে কল্পনা তাকে প্রীতিলতার আগ্রহের কথা বলেন। সব শুনে মাস্টারদাও তার সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। কিছুদিনের মধ্যেই তাদের সাক্ষাতের ব্যবস্থা করা হয়। ১৯৩২ সালের ১২ জুন, মাস্টারদা লোক পাঠিয়ে প্রীতিলতাকে বাড়ি থেকে আনার ব্যবস্থা করেন। সেদিন সাবিত্রী মাসির বাড়িতে আরও ছিলেন নির্মল সেন ও অপূর্ব সেন। কিছুদিন আগেই ইংরেজ সরকার মাস্টারদা এবং নির্মল সেনকে জীবিত অথবা মৃত ধরিয়ে দিতে পারলে ১০ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেন। প্রীতিলতা সাবিত্রী মাসির বাড়িতে আসার পর অনেক কথাবার্তা শেষে তারা দু’জন যখন নিচে রান্নাঘরে খেতে বসেছেন, ঠিক সেই সময় বাড়িতে মাস্টারদা আর নির্মল সেনের উপস্থিতির গোপন খবর পেয়ে কাছের ক্যাম্পের অফিসার ইনচার্জ ক্যাপ্টেন ক্যামেরন দলবল নিয়ে আক্রমণ করেন। এতে পুলিশের সঙ্গে বিপ্লবীদের ছোটখাটো একটা সংঘর্ষ হয়। ফলস্বরূপ ক্যাপ্টেন ক্যামেরন এবং নির্মল সেন গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। ওদিকে বাড়ির পেছন দিক দিয়ে মাস্টারদা, প্রীতিলতা আর অপূর্ব সেন পালানোর চেষ্টা করলে পুলিশ তাদের ওপর গুলিবর্ষণ করে। গুলিতে মারা যান অপূর্ব সেন। মাস্টারদা আর প্রীতিলতা সেই অন্ধকার রাতে কচুরিপানা ভর্তি পুকুরে সাঁতার কেটে, কর্দমাক্ত পথ পাড়ি দিয়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন।
ওদিকে, সেই রাতের মধ্যেই ক্যাপ্টেন ক্যামেরনের সঙ্গে থাকা পুলিশের আই এস মনোরঞ্জন বোস ক্যাম্পে ফিরে গিয়ে আরও সৈন্য আর অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে সাবিত্রী মাসির বাড়িতে ফিরে এসে বাড়িটিকে ধ্বংস করে দেয় এবং পরদিন সকালবেলা বিপ্লবীদের আশ্রয় দেয়ার অভিযোগে সাবিত্রী দেবী ও তার ছেলেমেয়েকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়।
এরকম অবস্থায় মাস্টারদা প্রীতিলতাকে আত্মগোপন করার পরামর্শ দিলে ৫ জুলাই বীরেশ্বর রায় এবং মনিলাল দত্তের সঙ্গে আত্মগোপন করেন প্রীতিলতা। ১৩ জুলাই আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত হয় তার অন্তর্ধান ও বেঙ্গল পুলিশের অনুসন্ধানের খবর। চট্টগ্রাম শহরের উত্তরে ছিল ইংরেজদের প্রমোদকেন্দ্র পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাব। ১৯৩০ সালেই এই ক্লাব আক্রমণের পরিকল্পনা থাকলেও তা করা হয়নি। কিন্তু তার প্রায় দুই বছর পর সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়। শেষে তরুণ বিপ্লবী শৈলেশ্বর চক্রবর্তীর নেতৃত্বে একদল বিপ্লবীকে ক্লাব আক্রমণের দায়িত্ব দেয়া হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তাদের আক্রমণ ব্যর্থ হয়। এর কিছুদিন পরই ব্যর্থতার গ্লানি সহ্য করতে না পেরে শৈলেশ্বর চক্রবর্তী আত্মহত্যা করেন। আক্রমণের প্রথম ব্যর্থতার পর দলের নেতা নতুনভাবে কাজটির ছক সাজানোর চিন্তা করেন। নতুন একটা দল পাঠাবেন বলে সিদ্ধান্ত নেন মাস্টারদা, আর সেই দলের নেত্রী করবেন একটি মেয়েকে। আর সেই মেয়েটি ছিলেন প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার। মাস্টারদা প্রীতিলতাকে জানিয়ে দিলেন, ১৯৩২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর রাতে পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণের নেত্রী তিনি। প্রীতিলতার মনে তখন উত্তেজনার ঝড়। পূর্বে বহুবার তিনি চেয়েছেন এ রকম কোনো অভিযানে যোগ দিতে। এতদিনে তার সে সুযোগ এসেছে। মূল ঘটনার পূর্বে কিছুদিন কাট্টলীর সাগরপাড়ে প্রীতিলতা ও তার সঙ্গীদের অস্ত্রচালনা প্রশিক্ষণ চলে।
প্রীতিলতা ও তার সাতজন সহযোদ্ধা সামরিক পোশাক আর অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে সূর্য সেনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যাত্রা শুরু করেন ইউরোপিয়ান ক্লাবের দিকে। পূর্বনির্ধারিত স্থানে পজিশন নেয়ার পর বাবুর্চির সংকেতে অপারেশন শুরু করেন প্রীতিলতা ও তার দল। ক্লাবের বাইরে পাহারায় থাকা পুলিশরা আক্রমণ হওয়ার সময়ই পালিয়ে যায়। গুলি ও বোমা ছুঁড়ে বেশ কিছু মানুষকে হতাহত করেন বিপ্লবীরা। ভিতরে থাকা আহত ইংরেজরাও এদিক-ওদিক পালিয়ে যায়। খুব অল্প সময়েই সব ঠিকমতো শেষ হয়ে গেলে দলবল নিয়ে প্রীতিলতা ফেরার পথে পা বাড়ান। সামরিক নিয়ম অনুসারে দলের সবাইকে আগে পাঠিয়ে পেছন পেছন হেঁটে আসতে থাকেন প্রীতিলতা। ফেরার রাস্তার পাশেই ছিল একটা নালা।
ক্লাব আক্রমণের সময় সেখান থেকে পালিয়ে আসা এক ইংরেজ লুকিয়ে ছিল সেই নালার মধ্যে। এর আগে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার আক্রমণের পর থেকেই ইংরেজরা সব সময় সঙ্গে কোনো না কোনো অস্ত্র রাখত। নালায় আত্মগোপনরত ওই ইংরেজ সাহেবের কাছেও ছিল একটা রিভলবার জাতীয় অস্ত্র। নালার ভিতর শুয়েই এক বিপ্লবীকে খুব কাছ দিয়ে হেঁটে যেতে দেখে রিভলবার থেকে গুলি ছোঁড়ে ওই ইংরেজ। গুলি এসে লাগে প্রীতিলতার বুকে, সঙ্গে সঙ্গেই মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি। ঠিক সেই মুহূর্তের মধ্যেই তিনি ঠিক করে ফেলেন নিজের শেষ কর্তব্য। এ রকম কোনো অভিযানে অনেক সময় সৈনিকদের সঙ্গে পটাশিয়াম সায়ানাইড দিয়ে দেয়া হয়। যদি এমন পরিস্থিতি আসে যখন সে শত্রুর কাছে ধরা পড়ে যাচ্ছে- তখন তার কাজ হচ্ছে, নিজে নিজে মরে যাওয়া। প্রীতিলতা সেই সময় পটাশিয়াম সায়ানাইড খেয়ে মৃত্যুবরণ করেন। এভাবেই একজন বীর দেশপ্রেমিক বিপ্লবী দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করলেন।
লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক
নয়াশতাব্দী/ডিএ
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ