এলাহি আলামিন গো আল্লাহ বাদশাহ আলমপনা তুমি।।/ডুবায়ে ভাসাতে পার ভাসায়ে কিনার দাও কারো,/রাখ মার হাত তোমার তাইতে তোমায় ডাকি আমি।।/ মদিনায় রাসুল নামে কে এলো ভাই।।/কায়াধারী হয়ে কেন তাঁর ছায়া নাই।।/ছায়াহীন যার কায়া,/ত্রিভুবন তাঁহারই ছায়া, /এই কথাটির মর্ম লওয়া অবশ্য চাই।।
মহাত্মা ফকির লালন শাহ যখন সাধের একতারা হাতে নৃত্যের ঘূর্ণিতে এইভাবে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের প্রশস্তি গান তাঁকে মনে স্থান দিতে প্রশান্তি বোধ করেন সহজিয়া ধারার মুসলমানরা। অনাদির আদি শ্রীকৃষ্ণনিধি/তাঁর কি আছে কভু গোষ্ঠখেলা।/ব্রহ্মরূপে সে অটলে বসে/লীলাকারী তাঁর অংশকলা।।/সত্য সত্য স্মরণ বেদ আগমে কয়/সচ্চিদানন্দ রূপে পূর্ণ ব্রহ্ম হয়।/জন্মমৃত্যু যার নাই ভবের পর/সে তো নয় স্বয়ং কভু নন্দলালা।।
লালন ফকির যবে এইভাবে শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন করেন। তখন কৃষ্ণপূজারিদেরও প্রাণের মানুষ হয়ে ওঠেন তিনি। অতঃপর লালন যখন বলেন, দিন থাকতে মুরশিদ-রতন চিনে নে-না না।।/এহেন সাধের জনম বয়ে গেলে আর হবে না।।/মুরশিদ আমার বিষয়াদি,/মুরশিদ আমার গুণের নিধি,/পারে যেতে ভব-নদী,/ভরসা ঐ চরণখানা।।
ফকির নিজেই হয়ে ওঠেন গুরুবাদী সহজ মানুষদের সাধন পীর। তাহলে আমাদের কুষ্টিয়ার লালন ফকির আসলে কে? কী তাঁর জাত পরিচয়? উত্তরটা পরিষ্কার করেছেন লালন নিজেই। সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে।/লালন বলে জাতের কি রূপ দেখলাম না এই নজরে।।/সুন্নত দিলে হয় মুসলমান/নারী লোকের কি হয় বিধান।/বামন চিনি পৈতে প্রমাণ/বামনী চিনি কি করে।।সবশেষে লালন তাঁর নিজেকে খুঁজে পান Ultimate Knowledge তথা পরমতত্ত্বে। মিস্টিক কবি বলেন, চরম ও পরম কথা, মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি/মানুষ ছাড়া ক্ষ্যাপারে তুই/মূল হারাবি...।’ এমন মানব জনম আর হবে না।।/দিন থাকতে মানুষ-রতন চিনে নে-না।।
২০০৪ সালে বিবিসি বাংলার জরিপে শ্রোতাদের মনোনীত শীর্ষ কুড়িজন বাঙালির তালিকায় ১২তম স্থানে নিজের নাম রোশনাই করেন সাধক লালন ফকির। লালন ফকির ছিলেন একাধারে একজন আধ্যাত্মিক বাউল সাধক, মানবতাবাদী, সমাজ সংস্কারক ও দার্শনিক। তাঁর গানের মধ্যে সন্ধান পাওয়া যায় এক বিরল মানব দর্শনের।
লালন শাহ, যিনি লালন ফকির বা লালন সাঁই নামেও পরিচিত, তিনি মৃত্যুর ১৩১ বছর পর আজও বেঁচে আছেন তাঁর গানের মাঝে। তাঁর লেখা গানের কোনো পাণ্ডুলিপি ছিল না, কিন্তু গ্রামবাংলায় আধ্যাত্মিক ভাবধারায় তাঁর রচিত গান ছড়িয়ে পড়ে লোকের মুখে মুখে। তাঁর অনুসারীরা সাধুসঙ্গের লীলাস্রোতে ভেসে ভেসে চারিধারে ছড়িয়ে দেন লালনের প্রকৃষ্ট মানবতাবাদী কালাম।
লালন গবেষকদের মতে, শৈশবে পিতৃহীন লালন ‘পূণ্যস্নান’ বা তীর্থ ভ্রমণ শেষে বসন্ত রোগে আক্রান্ত হন। রোগ বৃদ্ধি পেলে অচৈতন্য লালনকে মৃত মনে করে সঙ্গীরা কোনো রকমে তার মুখাগ্নি করে তাঁকে নদীতে ভাসিয়ে দেয়। এক মুসলমান রমণী নদীকূল থেকে লালনের সংজ্ঞাহীন দেহ উদ্ধার করে সেবাশুশ্রূষা করে তাঁকে সুস্থ করে তোলেন। কিন্তু তাঁর একটি চোখ দৃষ্টিহীন হয়ে যায়। এরপর বাড়ি ফিরে গেলে সমাজপতি ও আত্মীয়স্বজন মুসলমানের গৃহে অন্নজল গ্রহণ করার অপরাধে তাঁকে সমাজে গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায়। ব্যথিত লালন চিরতরে গৃহত্যাগ করেন।
বলা হয়, এই ঘটনা সমাজ-সংসার, শাস্ত্র আচার এবং জাতধর্ম সম্পর্কে তাঁকে বীতশ্রদ্ধ করে তোলে এবং এখান থেকেই হয় তাঁর নতুন জন্ম। বাউল গুরু সিরাজ সাঁইয়ের কাছে দীক্ষা নেয়ার পর কুষ্টিয়ার ছেউড়িয়া গ্রামে আখড়া স্থাপন করে তাঁর প্রকৃত সাধক জীবনের সূচনা হয়।“যা আছে ভাণ্ডে, তাই আছে ব্রহ্মাণ্ডে”- এই ছিল লালনের দর্শন। বৈষ্ণব সহজিয়া, বৌদ্ধ সহজিয়া ও সুফিবাদের সংমিশ্রণে মানবগুরুর ভজনা, দেহকেন্দ্রিক সাধনাই লালন প্রদর্শিত বাউল ধর্মের মূলমন্ত্র।
সর্বমত বা সর্বধর্মের এই সমন্বয়বাদ লালনকে ‘বাউল সম্রাট’ কিংবা ‘বাউল গুরু’র অভিধায় অভিষিক্ত করেছে। লালন তাঁর পদাবলীতে বলেন, ও তুই ডুবলে পরে রতন পাবি,/ভাসলে পরে পাবি না, পাবি না/দিল দরিয়ার মাঝে দেখলাম,/আজব কারখানা।
কিংবা আমার এ ঘরখানায় কে বিরাজ করে।।/আমি জনমভরে একদিন দেখলাম নারে।।
লালন ফকির বিশ্বাস করতেন সব মানুষের মধ্যেই বাস করে এক ‘মনের মানুষ’। আর সেই মনের মানুষের সন্ধান পাওয়া যায় আত্মসাধনার মাধ্যমে। দেহের ভিতরেই সেই মনের মানুষ বা যাকে তিনি ‘অচিন পাখি’ বলেছেন, তার বাস। সাঁইজি তাঁর গানেই স্পষ্ট করে বলেন...মিলন হবে কত দিনে/আমার মনের মানুষের সনে। কিংবা খাঁচার ভিতর অচিন পাখি/কেমনে আসে যায়।/ধরতে পারলে মনবেড়ি/দিতাম পাখির পায়।।
লালন গবেষক আবুল আহসান চৌধুরীর মতে, লালন চেয়েছিলেন একটি অখণ্ড মানবমণ্ডলী গড়ে তুলতে। তাঁর সময়ে তিনি নিজেকে বিকশিত করেছিলেন সমাজ-বিদ্রোহী, ভাব-বিদ্রোহী, মরমী একজন সাধক হিসেবে। প্রকৃতপক্ষে লালন ছিলেন মানবতাবাদী ও অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উদ্বুদ্ধ। ধর্ম, জাত, কূল, বর্ণ, লিঙ্গ ইত্যাদি অনুসারে মানুষের ভেদাভেদে তিনি বিশ্বাস করতেন না।
লালন তাঁর অমৃত কালামে বলেন, এমন মানব সমাজ কবে গো সৃজন হবে/যেদিন হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান/জাতি গোত্র নাহি রবে।।
লালন ফকিরের জীবদ্দশায় তাঁর একমাত্র স্কেচটি তৈরি করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাই জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর। লালনের মৃত্যুর বছরখানেক আগে ৫ মে ১৮৮৯ সালে পদ্মায় তাঁর বজরায় বসিয়ে তিনি এই পেন্সিল স্কেচটি করেন- যা ভারতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। এই চিত্রকল্পের নিপুণ দৃশ্যায়নটি আছে গৌতম ঘোষ পরিচালিত ‘মনের মানুষ’ মুভিতে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে যিনি গড়েছিলেন সেই বিবিধ শিল্পের পুরোধা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর সে কালের অনেক বিখ্যাত মানুষের ছবি ধরে রেখেছিলেন তাঁর আঁকা ছবিতে, যে সময় ফটোগ্রাফের প্রচলন হয়নি। প্রায় ১৮০০ স্কেচ সংরক্ষিত আছে আজও। রবীন্দ্রনাথ ও রোদেনস্টাইনের উদ্যোগে ১৯১৪ সালে এই স্কেচগুলো নিয়ে একটি বই প্রকাশিত হয়। ওই বইতে লালন ফকিরের মুখচ্ছবিও সযত্নে রাখা আছে।
সাম্যবাদ ও সমন্বয়বাদের প্রবাদপুরুষ লোককবি লালন ফকিরের জীবনদর্শন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কিংবা আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের মানুষের মুক্তি চিন্তার সমান্তরাল রেখায় ধাবমান। সহজ কথার সুন্দর গতি সরল পথ রচনা করে যাচ্ছে। যেখানে প্রতিক্রিয়া, কুসংস্কার, পুরাণপ্রথার অন্ধকারকে ঢেকে দেয় সম্প্রীতি। আর ওই প্রীতির অন্যতম কারিগর ও বাতিঘর আমাদের সাধক কবি লালন ফকির। অন্যের তুল্যমূল্যে নিজেকে দাস্যভাবের ফকির করে রাখলেও আসলে তিনি বোধের বাদশাহ। সর্বধর্মের সমন্বয়বাদের রূপকার লালন ফকিরের দিকে সবাইকে মনোযোগ দেয়ার আহ্বান জানিয়ে তাই তো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, ‘এই ভারতের এক জাতীয়তা রেখেছে শুধু ফকিররাই।’ লালন ফকির এর সবিশেষ উদাহরণ।
শিক্ষাবিদ ও চিন্তক ড. আহমদ শরীফ বলেছেন- ‘ভেদবুদ্ধিহীন মানবতার উদার পরিসরে সাম্য ও প্রেমের সুউচ্চ মিনারে বসেই লালন সাধনা করেছেন। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সাধক ও দার্শনিকদের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে তিনি সাম্য ও প্রেমের বাণী শুনিয়েছেন।’ মানবতাবাদের দিকদিশারি ফকির লালন শাহের শেষ কথা এই একটাই...One
who goes to the shore of the stream of man Easily gets a priceless gem That river is miraculous
where gems lie multitude,
The quality of its water is beyond praise,
touch it and you’ll touch God.
লালনকথা ‘সত্য বল সুপথে চল ওরে আমার মন’ গাইতে গাইতে আমরা এই সাম্যবাদী মানুষ রতন লালন ফকিরের পুণ্যস্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই।লেখক: সাংবাদিক
তথ্যসূত্র:
Songs of Lalon Shah -Abu Rushd
বাউলতত্ত্ব -আহমদ শরীফ
লালন সাঁই: প্রসঙ্গ ও অনুষঙ্গ- ড. আবুল আহসান চৌধুরী
বিবিসি বাংলানয়া শতাব্দী/আরজে
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ