ফরিদপুরে মন্দিরে আগুনের ঘটনায় স্রেফ সন্দেহের বসে দুই সহোদরকে পিটিয়ে হত্যা করা হলো। যার গেছে তার পরিবারে নিশ্চিতই শোকের মাতম চলছে এখন। এমন ন্যক্কারজনক ঘটনা কি এড়ানো যেত? নিশ্চয়ই। আমরা যদি সহনশীল, প্রজ্ঞাবান ও প্রেমময় মানুষ হতাম কখনোই অভিযোগের ভিত্তিতে এভাবে কারও প্রাণ কেড়ে নিতাম না। যে অমৃত প্রাণ আমরা দিতে পারি না, কোনো অজুহাতেই তা কেড়ে নেয়ার অধিকার রাখি না। এমনকি কেউ কোনো অপরাধে দোষী হলেও তাকে আইনের হাতে সোপর্দ করাই সভ্যতা। আমাদের মধ্যে সেই সভ্যতারই বড় আকাল চলছে।
স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, ‘মানুষের ভিতরে যে দেবত্ব আছে, তারই প্রকাশ সাধনকে বলে ধর্ম।’ তাহলে যে মন্দিরকে কেন্দ্র করে পাশবিকতা দেখানো হলো, নিঃসংশয়ে আমরা বলতে পারি সেখানে অধর্ম জয়যুক্ত হয়েছে। প্রশ্ন উঠছে, ভারতে বিভিন্ন ইস্যুতে ৩০ কোটি মুসলিম যতটা কোণঠাসা অবস্থায় থাকে, তাদের নাগরিকত্বে কাটাছেঁড়া চলে; তার তুল্যমূল্যে বাংলাদেশে হিন্দুরা কি অমন অবস্থায় আছে?
একশ্রেণির অবোধ মুসলিম এবং গ্রেডলেস মৌলভির দিক থেকে হিন্দুদের প্রতি চরম ঘৃণা ও বিদ্বেষ আছে বৈকি কিন্তু কোনোমতেই ভারতের মতো বাংলাদেশে হিন্দুদেরকে মর্যাদাহীন করে রাখতে রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনো রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেই। ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক কামরুল আহসান তালুকদার শনিবার দুপুরে বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, ‘মন্দিরটিতে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সন্ধ্যা বাতি দেয়া হয়েছিল। পরে প্রতিমায় আগুন ও দুজনকে হত্যার ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু আগুন কারা লাগিয়েছে সেটি জানতে তদন্ত চলছে। এর মধ্যেই ১০ জনকে আটক করা হয়েছে।
নিহত দুজন সহোদর এবং তাদের বয়স ২০ বছরেরও কম বলে জানিয়েছেন তাদের চাচাতো ভাই ইমরান খান। তিনি ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচার দাবি করে বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘এটি কোনো গণপিটুনির ঘটনা নয়, এটি পরিকল্পিত খুন। একটি রুমে কয়েকজনকে বেঁধে লাঠি, ইট ও রড দিয়ে পেটানো হয়েছে।’ মন্দির এলাকার বিবরণ দিয়ে স্থানীয় সাংবাদিক পান্না বালা বিবিসিকে জানান, মন্দিরটি ছোট আকৃতির এবং এর চারদিকে দেয়াল আর উপরে চৌচালা টিন। আর সামনে বাঁশের বেড়া দিয়ে আটকানো। ঘটনাস্থল পরিদর্শনের সময় স্থানীয়রা তাকে জানিয়েছেন, প্রতিদিন সন্ধ্যায় ওই মন্দিরে সন্ধ্যা বাতি জ্বালানোর কাজটি করে মালতী মণ্ডল। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে তিনি প্রদীপ নিয়ে মন্দিরে গিয়েছিলেন।
ওদিকে ওই মন্দির লাগোয়া স্কুলের শৌচাগার নির্মাণের জন্য পাশেই কয়েকদিন ধরে কাজ করছিলেন একদল শ্রমিক, যাদের বাড়িঘর অন্য এলাকায়। হঠাৎ আগুনের ঘটনার পর হিন্দু অধ্যুষিত এলাকাটির লোকজন জড়ো হয়ে ওই শ্রমিকদের ওপর আক্রোশ ও জিঘাংসা ঢেলে দেয়। ঘটনার অন্তর্নিহিত কার্যকরণ কি, আগুনের ঘটনায় আদৌ ওই শ্রমিকদের সম্পৃক্ততা আছে কি নেই- তা তদন্তের পর জানা যাবে। মন্দির নিয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের কোনো স্বার্থগত দলাদলি আছে কিনা সেটিও বের হবে। কিন্তু ওই দুই সহোদরের প্রাণ আর কখনোই ফিরে আসবে না। মন্দির সংশ্লিষ্ট উগ্র পেটোয়া বাহিনীরা কোনোদিন দুই ভাইয়ের পরিবারের শূন্যতা পূরণ করতে পারবে না।
অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় পাশের শ্রমিকদের হাত থাকতে পারে এমন ধারণার বশবর্তী হয়ে কারও প্রাণ বধ করা যে সুস্থ মগজধারী মানুষের কাজ নয় এই বোধ ও বিবেক যদি আমাদের মধ্যে না জাগে কোনো পুজো মন্দির প্রতিমা বিগ্রহের আধ্যাত্মিকতার কোনো মানে থাকে না। ইসলামিজমে ভিন্ন ধর্মের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার কথা জোর দিয়ে বলা হয়েছে। ভিন্নধর্মীদের জানের সুরক্ষা এবং মালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা মুসলিমদের দায়িত্ব। এ প্রসঙ্গে ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো ভিন্নধর্মী নাগরিককে হত্যা করল, সে জান্নাতের সুগন্ধও পাবে না, অথচ তার সুগন্ধ ৪০ বছরের রাস্তার দূরত্ব থেকেও পাওয়া যায়।’ (বুখারি শরিফ, হাদিস: ২৯৯৫)। সামান্যতম ধর্মীয় জ্ঞান থাকলেও কোনো নিষ্ঠাবান মুসলিম মন্দিরের ক্ষতি চিন্তা করবে না। অপরদিকে হিন্দু ধর্মের অনুসারীরা যদি ভালো করে উপনিষদ আত্মস্থ করত, জাতি ধর্ম বর্ণ গোত্র নির্বিশেষে সবার সুন্দর সহাবস্থান নিশ্চিত হতো। কী বলছে প্রাচ্যপুরাণ উপনিষদ?
“সর্বে ভবন্তু সুখিন, সর্বে সন্তু নিরাময়া,
সর্বে ভদ্রানি পশ্যন্তু, মা কশ্চিদ দুঃখ ভাগভবেৎ।
ওম শান্তি, ওম শান্তি, ওম শান্তি।” (বৃহদারন্যক উপনিষদ ১/৪/১৪) জগতের সকল সৃষ্টি সুখী হোক, সকলেই আরোগ্য লাভ করুক। কষ্মিনকালেও যেন কেউ দুঃখ ভোগ না করেন। জগতের সকল প্রাণী শান্তি লাভ করুক।
এ কথাগুলো মন্দিরের দুয়ারে যদি উৎকীর্ণ থাকে ওই মন্দিরের নিষ্ঠাবান অনুসারীরা পিটিয়ে কারও প্রাণ হরণ করতে পারবে?
ধর্মীয় আধ্যাত্মিকতা এবং ধর্মীয় রাজনীতির মধ্যে বিস্তর ফারাক। যেখানে স্পিরিচুয়ালিটি প্রাধান্য পাবে সেখানকার দুয়ার সর্বমানুষের জন্য উন্মুক্ত থাকবে। কবি কাজী নজরুল ইসলামের মতো সেখানকার সাম্যবাদী কবিরা মনের আনন্দে লিখবেন,
মোরা এক বৃন্তে দু’টি কুসুম হিন্দু-মুসলমান। মুসলিম তার নয়ন-মণি, হিন্দু তাহার প্রাণ।। এক সে আকাশ মায়ের কোলে
যেন রবি শশী দোলে,
এক রক্ত বুকের তলে, এক সে নাড়ির টান।। এক সে দেশের খাই গো হাওয়া, এক সে দেশের জল,
এক সে মায়ের বক্ষে ফলাই একই ফুল ও ফল। এক সে দেশের মাটিতে পাই
কেউ গোরে কেউ শ্মশানে ঠাঁই
এক ভাষাতে মা’কে ডাকি, এক সুরে গাই গান।।
আর যেখানে রাজনৈতিক ধর্মের বাড়াবাড়ি থাকে সেখানটায় উদাহরণ তৈরি করে ভারতের বর্তমান সরকার প্রধানের মতো মানুষরা। চলমান প্রথম পর্ব জাতীয় নির্বাচনে আশানুরূপ ফল না মেলায় মুসলিমদেরকে ঢালাওভাবে অনুপ্রবেশকারী বলেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। রাজস্থানের জনসভায় তিনি এও বলেছেন যে, কংগ্রেস ক্ষমতায় এলে হিন্দুদের সব সম্পত্তি মুসলিমদের মধ্যে ভাগ করে দেবে। এবং মুসলিমদের দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন তারা সন্তান নেয় বেশি।কংগ্রেসে শীর্ষ নেতৃত্ব খোদ যারা সনাতন ধর্মের অনুসারী তারাও দেশের প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্যকে চরম সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষপ্রসূত বলেছেন। বিরাগ ও বিদ্বেষের এই যে বাড়াবাড়ি এপারে এবং ওপারে, যে কোনো মূল্যে এর সমাপ্তি টানা জরুরি। না হলে মানবিক সমাজ কায়েম হবে না। মানব সভ্যতাও টিকবে না।
আমরা চাই, ফরিদপুরের দুই ভাই হত্যার ঘটনায় জড়িতদের দ্রুততম সময়ে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা হোক। তিলকে তাল বানিয়ে মানুষের প্রাণ সংহরণ করে সোশ্যাল মিডিয়ায় উল্লাস প্রকাশের ঘটনা যেন আর না ঘটে। ধর্ম থেকে রাজনীতি ও স্বার্থবাদিতা যত দূরে রাখা যাবে ততই ধর্মানুরাগীদের মঙ্গল। এর অন্যথায় ধর্মানুভূতির কোপানল তথা ক্রোধের আগুনে পুড়ে সবাই ছাড়খার হবে। নিজের মর্যাদা নিজে বুঝলে, তবেই না অন্যরা সম্মান দেবে।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘যে ধর্মের নামে বিদ্বেষ সঞ্চিত করে, ঈশ্বরের অর্ঘ্য হতে সে হয় বঞ্চিত।
অপরদিকে দ্রোহ ও প্রেমের কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন,
হিন্দু না ওরা মুসলিম?
ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?
কান্ডারি! বল, ডুবিছে মানুষ!
সন্তান মোর মা’র।
লেখক: সাংবাদিকনয়া শতাব্দী/আরজে
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ