ঢাকা, রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

প্রসঙ্গ: ছাত্র রাজনীতি

প্রকাশনার সময়: ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৮:০২

বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি চলুক এর পক্ষে কিছু মানুষ এখন সরব। অপরদিকে কিছু মানুষ ছাত্র রাজনীতি বন্ধ থাকুক এ রকম মতামত দিচ্ছেন। যারা মতামত দিচ্ছেন তারা সমাজের কথিত গুণী ও সুশীল হিসেবে বিবেচিত। সাধারণ একজন মানুষ হিসেবে আমি আমার নিজের ছাত্র রাজনীতির অভিজ্ঞতাটা বলব এখানে। আসলে ছাত্র রাজনীতিটা কী?

এটা কি সমাজ গর্হিত কোন কাজ? কোনো ছেলে ছাত্র রাজনীতি করে শুনলে কথিত ভদ্র মানুষগুলো নাক ছিটকায়। তাদের দৃষ্টিতে ছাত্র রাজনীতি মানে দুর্গন্ধযুক্ত একটা বিষয়। ১৯৪৮ সালে উর্দুকে প্রতিহত করে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে তদানীন্তন পাকিস্তানে প্রতিষ্ঠিত করেছিল ছাত্র রাজনীতি।

১৯৪৮ থেকে ১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধ প্রতিটি আন্দোলনের বারুদ হিসেবে ছাত্রনেতারা ছিল সম্মুখ সমরে। আজ সেই রাজনীতি কেন আপদে পরিণত হলো। আসলে ছাত্র রাজনীতির সংজ্ঞাটা কী? আমরা বা বর্তমান ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতারা জানে কী? ছাত্র রাজনীতির লক্ষ্য উদ্দেশ্য? ছাত্র রাজনীতি কি কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বা দলের উদ্দেশ্য সাধনের জন্য করা হয়? ছাত্র রাজনীতি ছাত্র ও সমাজের মঙ্গলার্থে একটি রাজনৈতিক কার্যক্রম। ছাত্র রাজনীতি দেখবে দেশে চলমান শিক্ষানীতি কতটুকু বাস্তবসম্মত। দেশের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মান সমাজের চাহিদার সঙ্গে কতটুকু বাস্তবসম্মত তা পরিবীক্ষণ করবে ছাত্র রাজনীতি যারা করেন তারা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সবার জন্য শিক্ষা ব্যবস্থাটা কতটা বাস্তবায়িত হচ্ছে তা দেখবে ছাত্র রাজনীতি। সমাজের ধনী দরিদ্র ধর্ম বর্ণের মানুষগুলোকে দেশজ সংস্কৃতির বলয়ে এক ধরনের শিক্ষার আওতায় আসতে পেরেছে কী— তা পরিবীক্ষণ করবে ছাত্র রাজনীতি।

এগুলো কি এখনকার ছাত্রনেতারা পর্যবেক্ষণ করেন। শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে গবেষণা করবে ছাত্র রাজনৈতিকরা। ছাত্র রাজনীতির মূল এজেন্ডা এখন কেতাবে বন্দি?

ছাত্ররা যা করছেন তা হলো কোনো গোষ্ঠী বা ব্যক্তির স্বার্থ হাসিলের জন্য কিছু কাজ। তাছাড়া এখনকার ছাত্র সংগঠনগুলোর চেহারার সঙ্গে মূলধারার রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর চেহারা, বৈশিষ্ট্য, কার্যক্রমের মিল পাওয়া যায়। ছাত্ররা ছাত্রদের তথা শিক্ষা নিয়ে কোনো কার্যক্রম করেন না। তারা তাদের মূল সংগঠনের এজেন্ডাগুলো বাস্তবায়ন করার জন্য কাজ করছে, তাই সাধারণ মানুষের ধারণা ছাত্র রাজনীতির প্রয়োজন নেই। এ ধারণাটা যদি বাস্তবায়িত হয়, তাহলে অদূর ভবিষ্যতে সমাজ ঘোর অন্ধকারের দিকে ধাবিত হবে। বাংলাদেশ জন্মের সঙ্গে ছাত্র রাজনীতি ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে, অথচ জন্মের ৫৩ বছরে এসে ছাত্র রাজনীতি মহিমান্বিত হওয়ার কথা কিন্তু তা না হয়ে অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছে।

১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান বাংলা অক্ষরের ব্যবহার নিষিদ্ধ করার পদক্ষেপ নেন। শিক্ষামন্ত্রী বাংলা শব্দগুলোকে আরবি হরফে লেখার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান তার প্রস্তাবনা বাস্তবায়নের জন্য বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ড. মুহাম্মদ শহিদুল্লাহকে পদক্ষেপ নেয়ার জন্য দিয়েছিলেন একটি চিঠি। ড. মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ এই চিঠি প্রত্যাখ্যান করেন এবং চিঠির বিষয়বস্তু প্রকাশ করে দেন সংবাদপত্রে।

আর এই সংবাদ দেখে ছাত্রনেতারা প্রতিবাদ করে দেশব্যাপী আন্দোলন গড়ে তোলেন। সেই সময় দেশের প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমানের প্রস্তাব বাতিলের দাবিতে সোচ্চার হয়ে ওঠে। আন্দোলনের মুখে তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমানের প্রস্তাবটি বাতিল হয়ে যায়। বাংলা ফিরে পায় তার নিজের বর্ণমালা। ছাত্র রাজনীতির এই গৌরবময় কৃতিত্বকে ম্লান করে চলছে ছাত্র রাজনীতি বাতিলের চক্রান্ত। এর জন্য দায়ী কারা? স্বৈরাচার এরশাদ হটানোর গুরু দায়িত্ব পালন করে এদেশের ছাত্রসমাজ। সামরিক জান্তা এরশাদ শত চেষ্টা করেও একটি ছাত্র সংগঠন দাঁড় করাতে পারেনি? দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ ছাত্ররা এরশাদের ছাত্র সংগঠনে যোগ দেয়নি। শত চেষ্টার পর ব্যর্থ হয়ে এরশাদ ছাত্র সংগঠন করা বাদ দেয়। আমি ছাত্র জীবনে সক্রিয় ছাত্র রাজনীতির কর্মী ছিলাম। ১৯৮৪ সালে মাধ্যমিকে পড়ার সময় ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হই।

‘শিক্ষা সুযোগ নয় অধিকার’- এ এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে হবে। এ এজেন্ডা বাস্তবায়ন করার জন্য যে পদক্ষেপগুলো নেয়া দরকার তৎসম্পর্কিত রাজনৈতিক কার্যক্রমগুলো আমাদের ছাত্র সংগঠন গ্রহণ করত, আর এ বিষয়টির সঙ্গে সকল ছাত্রদের অন্তর্ভুক্ত করার জন্য আমরা মিছিল মিটিং, বৈঠক করতাম।

যেমন কুদরতে খুদার শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের লক্ষে একমুখী বিজ্ঞানভিত্তিক চালু করা। ক্যাডেট কলেজ, কিন্ডারগার্ডেন, সরকারি-বেসরকারি সহ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সরকারি ব্যয় সমান করা। ধনিক তোষণ গরিব শোষণ বন্ধ করা। কারণ গরিবের ছেলেমেয়েরা গ্রামের যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়ন করত, এই প্রতিষ্ঠানগুলোর সরকারি ব্যয় শহরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের চেয়ে অনেক কম।

গ্রামের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গ্রন্থাগার, ল্যাব সুবিধা ছিল না, অথচ শহরের সরকারি স্কুল কলেজে তা ছিল। আমরা ছাত্র রাজনীতি করেছি সমতার জন্য। নৈতিক মূল্যবোধের জায়গাটা আমাদের ছাত্রনেতারা কর্মীদেরকে আদর্শবান করে তৈরি করেছিলেন। আমাদের ছাত্রনেতারা কোনো অনৈতিক কার্যকলাপ করতেন না। বেশির ভাগ ছাত্রনেতা যারা ছিলেন তারা টিউশনি করে নিজের পড়াশোনার খরচ জোগাড় করতেন আর সংগঠনের খরচের জন্য চাঁদা দিতেন। স্বৈরাচার এরশাদের আমলে উপজেলা স্তরে নকলের মহোৎসব ছিল। আমরা যারা ছাত্র ইউনিয়নের সদস্য ছিলাম তাদের প্রতি কঠোর নির্দেশ ছিল নকল থেকে বিরত থাকার।

যদি কোনো ছাত্র ইউনিয়ন কর্মী পরীক্ষার হলে নকল করেছে বলে প্রমাণ পাওয়া যেত সঙ্গে সঙ্গে তাকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হতো। সংগঠন থেকে বলা হতো ছাত্র রাজনীতি করলে নৈতিক মূল্যবোধ সম্পন্ন মানুষ হতে হবে। কারণ হিসেবে ব্যাখ্যা ছিল- নিজের নৈতিক স্খলন ঘটলে এই নৈতিক অবক্ষয়যুক্ত ছাত্রনেতার সংগঠনে সাধারণ ছাত্ররা সদস্য হতে আসবে না। সুতরাং ছাত্র রাজনীতি করতে হলে নিজেকে অপরাধ, অন্যায় বা অসামাজিক কার্যকলাপের সঙ্গে সংযুক্ত করা যাবে না। শিক্ষাঙ্গনের গণতান্তিক পরিবেশ বজায় রাখার লক্ষ্যে কার্যক্রম চালাতে হবে। সকল ছাত্র সংগঠনের রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করার অধিকার রয়েছে তাই অযাচিতভাবে কোনো ছাত্র সংগঠনের কর্মকাণ্ডে বাধা দেয়া যাবে না।

ছাত্র সংগঠনগুলোর নৈতিক শিক্ষা ছিল এমন। তখনকার সময় একমাত্র উগ্রবাদী ছাত্র সংগঠন ছিল ইসলামী ছাত্র শিবির, এরা ছিল স্বাধীনতা বিরোধী জামাতের অঙ্গ সংগঠন। একমাত্র শিবিরই ৯০ পূর্ববর্তী সময় সন্ত্রাসী আচরণ করত। তবে ৯০ এর পর এদের সন্ত্রাস আরও বেশি বেড়ে গেছে। বর্তমানে নিষিদ্ধ থাকলেও এরা গোপনে তাদের মিশন চালাচ্ছে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে।

তবে ছাত্র রাজনীতি বুয়েট ক্যাম্পাসে বন্ধ হওয়ার পর মৌলবাদী রাজনীতি বুয়েটে গোপনে চলছে, এর নানা নিদর্শন পাওয়া যায়। আবরার হত্যার সঙ্গে যে ছাত্র সংগঠন জড়িত তাদেরকে নিষিদ্ধ করাটা ছিল কিছুটা যৌক্তিক, ঢালাওভাবে সকল ছাত্র সংগঠনের কর্মকাণ্ড বন্ধ করাটা অযৌক্তিক। গত ১০ বছর ধরে বুয়েট থেকে যারা গ্র্যাজুয়েশন করে বের হচ্ছে তাদের প্রায় ৮০ ভাগই মৌলবাদী দীক্ষা নিয়ে এসে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করছে। এরা কর্মক্ষেত্রে সেক্যুলারদের ওপর প্রতিশোধ নিচ্ছে।

এর বাস্তব উদাহরণ, নওগাঁ জেলার পোরশা উপজেলার এলজিইডির প্রকৌশলী ছিল ইমরান। ইমরানের জিঘাংসার শিকার হয়ে সেক্যুলার ঠিকাদারকে প্রায় ছয় লাখ টাকার লোকসান দিতে হয়েছে। গত দশ বছরে বুয়েট থেকে বের হওয়া গ্র্যাজুয়েটদের আচার আচরণ সার্বিকভাবে পর্যবেক্ষণ করলে বোঝা যায় যে, তারা সংঘবদ্ধভাবে নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে রপ্ত। বুয়েট হিজবুত তাহরিনের কেন্দ্র হিসেবে আখ্যা দিয়েছে ছাত্রলীগ। এ বিষয়টা উড়িয়ে দেয়া যায় না। কথাটার অধিক তদন্তের প্রয়োজন। বর্তমানে যারা বুয়েটে অধ্যয়ন করছে এই শিক্ষার্থীদের পোশাক পরিচ্ছেদ, চলাফেরার গতিবিধি লক্ষ করলেও বোঝা যায়, প্রায় ৮০ শতাংশই হবে এরা কোনো না কোনোভাবে মৌলবাদ লালন করছে। তাই সকল ছাত্র সংগঠনের বিষয়টি নিয়ে ভাবা দরকার।

বুয়েটে ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন এমন স্বনামধন্য অসংখ্য প্রকৌশলী দেশে বিদেশে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন। ছাত্র রাজনীতি করলে পড়াশোনার ক্ষতি হয় এটা ঠিক না। তবে পরিশীলিত ছাত্র রাজনীতি চাইলে প্রথমেই যে কাজটি করতে হবে তা হলো, ছাত্র সংগঠনগুলোকে রাজনৈতিক সংগঠনের লেজুড়বৃত্তি থেকে বের করে আনতে হবে। প্রতিটি ছাত্র সংগঠনকে তাদের নিজস্ব সংগঠনের লক্ষ্য উদ্দেশ্য নিয়ে কার্যক্রম চালাতে হবে। দেশের প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ছাত্র সংসদ নির্বাচন ব্যবস্থা করার প্রয়োজন। লেখক: কলামিস্ট

নয়া শতাব্দী/আরজে

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ