ঢাকা, শনিবার, ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ৬ পৌষ ১৪৩১, ১৮ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

রুমি আল কাহতানি ও পুরুষতান্ত্রিক মানস

প্রকাশনার সময়: ০২ এপ্রিল ২০২৪, ১২:৩০ | আপডেট: ০২ এপ্রিল ২০২৪, ১২:৪০

অনলাইন ইনফ্লুয়েন্সার ও সুপার মডেল রুমি আল কাহতানি মিস ইউনিভার্স প্রতিযোগিতায় লড়তে যাচ্ছেন। সৌদি এরাবিয়ান এই নারীর আসন্ন মেক্সিকো কমপিটিশনে অংশগ্রহণ নিয়ে দুই শিবিরে বিভক্ত হয়ে গেছে বাঙালি নেটিজেনরা। রক্ষণশীল একপক্ষ এতে আরবের জাত চলে গেল বলে রব তুলেছে।

অতি উদার অপরপক্ষ কাহতানির সৌন্দর্য প্রদর্শনকে নারীর অগ্রযাত্রা বলে বাহ্বা দিচ্ছে। কিন্তু কেউ আসল কথাটি বলছেন না যে, বিশ্ব সুন্দরী প্রতিযোগিতা আয়োজন পুরুষের বাসনা পূরণের খামখেয়ালিপনা মাত্র। কেউ কখনো শুনেছে, নারীদের আয়োজনে কোথাও ঘটা করে মিস্টার ইউনিভার্স প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়েছে? যেখানে বিচিত্র ভঙ্গিমায় পুরুষ স্তুতিমূলক সংগীতের সুরমূর্ছনায় নারীস্থানের মাঝখান দিয়ে অর্ধবসন পুরুষরা হেঁটে যাচ্ছে।

অথবা সুইম স্যুট পরে জলাধারের দুইপাশে নারীদের দৃষ্টিসীমায় নিজেদেরকে রেখে ওই সুদর্শন পুরুষরা সাঁতরে যাচ্ছে? না যায়নি, যাবেও না। লন্ডনভিত্তিক মিস্টার ওয়ার্ল্ড নামে যে প্রতিযোগিতার কথা বলা হয়, সেটি নিয়ে নারীমহলে সরব আলোচনা নেই। খুব বেশি লোক সেটি জানেও না।

পুরুষ এমন এক জগৎ তৈরি করে নিয়েছে যেখানে ইচ্ছা করলেই ধর্ম, প্রচলিত আইন বা নীতিশাস্ত্রের দোহাই দিয়ে নারীকে কালো অবগুণ্ঠনে আবৃত করে অবরোধবাসিনী হিসেবে রেখে দেয়া যায়। আবার পুরুষের মনে হলো তো, ওই নারীকে মাহরুম ছাড়াই মেক্সিকোর রঙ্গমঞ্চে গায়রে মাহরুমদের ভিড়ে রূপ প্রদর্শনে ঠেলে পাঠানো যায়।

শতবর্ষ আগে নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া যেটিকে পুরুষের আদেশপত্র বলে উল্লেখ করে ভগিনিদের জাগতে বলেছেন। ভগিনিরা না জেগে যদি পুরুষের বংশবদ হয়ে থাকতে চায়, তেমনটা থাকতে পারার অধিকার তাদের আছে। আমাদের সপ্রশংস ভূমিকা থাকা তাতে চলে না।

কাহতানি নিজে অবশ্য বলেছেন, ‘২০২৪ সালের মিস ইউনিভার্সে সৌদি আরবের প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পেয়ে আমি সম্মানিত বোধ করছি। আমি বহির্বিশ্বের সংস্কৃতি সম্পর্কে অবগত হতে চাই। পাশাপাশি আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আমি ছড়িয়ে দিতে চাই’।

কাহতানির শেষের বক্তব্যটির সঙ্গে আমরা একাত্মতা প্রকাশ করছি। সৌদি নারীরা যেখানে সহসা বাইরেই বের হতে পারে না, তেমন বাস্তবতায় কাহতানি যদি বৈশ্বিক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সোহবত পায়, সেটি নিঃসন্দেহে সামগ্রিক নারী সমাজের জন্য ভালো। কারণ সংকোচের বিহ্বলতা নিজের অপমান ছাড়া কিছুই নয়। সংকটের কল্পনায় ম্রিয়মাণ হওয়াও মানুষের সাজে না।

নারী বা পুরুষের বিভাজিত সভ্যতার রূপরেখা ধরে যেন কেউ হাঁটতে না পারে সেই জবাবদিহি জারি রাখতে হবে। মিস ইউনিভার্স যদি হতে পারে, সমান্তরালে মিস্টার ইউনিভার্সও হতে হবে। মহাপ্রকৃতির অনন্য ও অনুপম সৃষ্টি পুরুষ খুব সুন্দর। আয়োজন করে তার রূপলহরি নারীরা কেন দেখতে পাবে না!

বিশ্ব সুন্দরী প্রতিযোগিতা নারীর কৌমার্য চায়। কোনো নীতিবাগিশ বা মানবতাবাদীর পক্ষে এসব মেনে নেয়া সম্ভব নয়। এসব প্রতিযোগিতা অত্যন্ত হাস্যকরভাবে মেয়েদের কাছে তাদের ‘ভার্জিনিটি’ দাবি করে। পুরুষদের সামনে নিজেদের সৌন্দর্যের ডালি সাজিয়ে ধরতে বাধ্য হন মেয়েরা।

প্রতিযোগিতার বিচারকাজও যেসব মাপকাঠিতে নির্ণয় করা হয়, তা নারীর জন্য বড় অবমাননাকর। নারী তো পণ্য নয়, মানুষ। উচ্চতা, ওজন, কোমর, বক্ষ আর অধোদেশের ভিত্তিতে মার্কিং করেন বিচারকরা। যারা এমন পদ্ধতিগুলো নারী সৌন্দর্যের মানদণ্ড করেছেন এবং যেসব গুটি কয়েক নারী বিচারক এসব প্রতিযোগিতার বিচারকাজে নাম লেখান, তাদের ব্যক্তিত্বের রুচি নিয়ে আমাদের প্রশ্ন থাকবেই। বাহুবল, পেটের সিক্স প্যাক কিংবা রান করার সক্ষমতার ভিত্তিতে পুরুষের মানদণ্ড নারীরা নির্ণয় করতে পারে না। তাহলে কিছুতেই রুমি আল কাহতানির সৌন্দর্য প্রতিযোগিতায় যাওয়া নারীর অগ্রযাত্রাকে চিহ্নিত করে না।

খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে প্রাচীন গ্রিসে প্রথম সুন্দরী প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। নতুন শহর ব্যাসিলেসের উদ্বোধন উপলক্ষ্যে করিন্থের শাসক কিপসেলাস ওই সুন্দরী প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছিলেন।

শুরুর সে প্রতিযোগিতাও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছিল। কারণ সবার চক্ষু ছানাবড়া করে দিয়ে সে প্রতিযোগিতায় সেরা সুন্দরী নির্বাচিত করা হয়েছিল ওই শাসকের স্ত্রীকেই। নারী জিতবে নাকি হারবে তা নির্ণয় করে পুরুষ। সেটি প্রাগৈতিহাসিক সময় কিংবা উত্তরাধুনিক কাল। মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ। বিশ্বব্যাপী আমেরিকাভিত্তিক ‘মিস ইউনিভার্স’ কিংবা যুক্তরাজ্যভিত্তিক ‘মিস ওয়ার্ল্ড’ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে যারা বিশ্ব সুন্দরীর খেতাব অর্জন করেন, তারা ভবিষ্যৎ জীবনে ভারতীয় সিনেমার জনপ্রিয় নায়িকা ঐশ্বরিয়া রাইয়ের মতো নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে দারুণ প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন। কিন্তু তা হাতেগোনা দু-চারজন। বাকিরা কালের গর্ভে হারিয়ে যান।

সুতরাং কাহতানির সৌন্দর্য প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ নিয়ে খুব বেশি আশান্বিত হওয়ার কিছু নেই। তিনি যদি মানবতার অগ্রযাত্রায় নিজের ভূমিকা পাকাপোক্ত করতে চান, সেটি তার আপন যোগ্যতাতেই করবেন এবং যেটি তিনি করেও চলেছেন। সুবিধাবঞ্চিতের পাশে থাকা, জলবায়ু সংরক্ষণে বৃক্ষরোপণ, মানুষকে ইতিবাচক মানসিকতায় অনুপ্রাণিত করা- ইত্যাকার সব ভালো কাজ এখনই করে চলেছেন কাহতানি। মিস ইউনিভার্স হয়ে গেলে সেই পরিচিতিতে নতুন পালক সংযোজিত হবে সত্য, কিন্তু সেটি তার বোধের জগতকে আলাদা মহিমা দেবে না।

চরম রক্ষণশীল সৌদি আরবে বড় হয়েও নারীর অধিকার নিয়ে তিনি যতটা লড়ছেন সেটিই অনেক বেশি। নারীর পরিচিতি হবে তার কর্মে, রূপে নয়। পৌরাণিক সুন্দরী হুর কিংবা ইহলৌকিক নারীর রূপে মাতে একশ্রেণির লালসার সাধকরা। আমরা সেই হীনমন্য ও কূপমণ্ডুক সাধকদের থেকে নারীদের শতহস্ত দূরে থাকতে বলব।

শ্রদ্ধা, মায়া, মমতা, ভালোবাসা, সহমর্মিতা ও সমানাধিকারের প্রশ্নে পুরুষ যদি নারীর সঙ্গে একাত্ম হয়, তবেই পৃথিবী সুন্দর হয়। আমরা সেই সত্য ও সুন্দরের আরাধনা করি। রুমি আল কাহতানির জন্য আমাদের প্রাণান্ত শ্রদ্ধা। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই গানখানি আত্মবিশ্বাসী মিজ কাহতানির জন্য অঞ্জলি হিসেবে রাখা থাকল...

সংকোচের বিহ্বলতা নিজেরে অপমান।/সংকটের কল্পনাতে হয়ো না ম্রিয়মাণ।/ মুক্ত করো ভয়, আপনা-মাঝে শক্তি ধরো, নিজেরে করো জয়।/ দুর্বলেরে রক্ষা করো, দুর্জনেরে হানো,/নিজেরে দীন নিঃসহায় যেন কভু না জানো।/মুক্ত করো ভয়, নিজের পরে করিতে ভর না রেখো সংশয়।/ধর্ম যবে শঙ্খরবে করিবে আহ্বান/নীরব হয়ে নম্র হয়ে পণ করিয়ো প্রাণ।/মুক্ত করো ভয়, দুরূহ কাজে নিজেরি দিও কঠিন পরিচয় লেখক: সাংবাদিক

নয়া শতাব্দী/ আরজে

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ