দেশে অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে প্রসূতি মায়েদের অস্ত্রোপচারে সন্তান প্রসব। অতিরিক্ত অর্থ উপার্জনের জন্য একশ্রেণির চিকিৎসক বা চিকিৎসা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা অপ্রয়োজনে প্রসূতি মায়েদের অস্ত্রোপচারে সন্তান প্রসব করাচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। আসলে একজন গর্ভবতী মা ও স্বজনদের কর্তব্যরত চিকিৎসক ও নার্সদের তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তের ওপরই অনেকাংশে নির্ভর করতে হয়।
মফস্বল এলাকায় অনেক ক্ষেত্রে অস্ত্রোপচার করার আগে যথাযথ পরীক্ষা-নিরীক্ষাও করা হয় না এবং শুধু টাকার লোভে অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচারের দিকে ঠেলে দেয়া হয়। অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচারের খপ্পরে পড়ে অনেক গর্ভবতী মা অকাল মৃত্যুর শিকার হচ্ছেন। আর বেঁচে থাকা অনেক মা ও তার শিশু সন্তান পড়ছেন মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে, যা সারা জীবন তাদের ভোগ করতে হয়।
সম্প্রতি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ২০২৩ সালের বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস (এসভিআরএস ২০২৩) প্রকাশিত এক তথ্যে বলা হয়েছে, দেশে অস্ত্রোপচারে ৫০ দশমিক ৭ শতাংশ শিশুর জন্ম হচ্ছে। এই হার গত বছরের অর্থাৎ ২০২২ সালের চেয়ে ৯ দশমিক ৩ শতাংশ বেশি। গত বছর অস্ত্রোপচারে শিশু জন্মের হার ছিল ৪১ দশমিক ৪ শতাংশ। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, সর্বোচ্চ ১৫ শতাংশ প্রসবে অস্ত্রোপচার দরকার হতে পারে। কিন্তু অস্ত্রোপচার হচ্ছে ৫০ শতাংশের বেশি। অর্থাৎ অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচার ৩৫ শতাংশ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোনো প্রয়োজন ছাড়াই অধিকাংশ অস্ত্রোপচার হচ্ছে যা মা ও শিশুর প্রসব পরবর্তী স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ ও ক্ষতিকর। সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগ দেশে শিশু জন্মে অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচার কমাতে পারছে না। এ কারণে দেশে বর্তমানে অর্ধেকের বেশি শিশুর জন্ম হচ্ছে অস্ত্রোপচারে। জনস্বাস্থ্যবিদরা অস্ত্রোপচারের দুই ধরনের ক্ষতির কথা বলছেন।
প্রথম ক্ষতি স্বাস্থ্যের। অস্ত্রোপচারে মায়ের শরীরে ক্ষত হয়, অস্ত্রোপচারে বাড়তি ওষুধ খেতে হয়, অধিক সন্তান জন্মদান বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। এ ছাড়া স্বাভাবিক প্রসবের সময় নবজাতক মায়ের শরীর থেকে যেসব উপকারী জীবাণু পায়, অস্ত্রোপচারে তা থেকে নবজাতক বঞ্চিত হয়। দ্বিতীয় ক্ষতি অর্থের। স্বাভাবিক প্রসবের চেয়ে অস্ত্রোপচারে খরচ অনেক বেশি। অপ্রয়োজনে বাড়তি খরচ করছে দেশের মানুষ।
এদিকে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার দিকনির্দেশনা হচ্ছে- একটি দেশে নানা কারণে অস্ত্রোপচারে ১৫ শতাংশ শিশু জন্ম হতে পারে। কিন্তু ২০১৭-১৮ সালের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে সেটি ৩২ দশমিক ২২ শতাংশ এবং এটি ২০০৩-২০০৪ সালের দিকে ছিল মাত্র ৩ দশমিক ৯৯ শতাংশ। এ ছাড়া গ্রামাঞ্চলে ওই সময়ে অস্ত্রোপচার করে বাচ্চা হওয়ার হার ছিল ১ দশমিক ৯৭ শতাংশ, যেটি ২০১৭-১৮ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ২৯ দশমিক ১৮ শতাংশে, যা নিরাপদ মাতৃত্বের জন্য বড় বাধা এবং মা ও শিশু স্বাস্থ্যের জন্য উদ্বেগজনক চিত্র।
আসলে শিশু জন্মের সময় জটিলতা দেখা দিলে প্রসূতি মায়েদের অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে স্বাভাবিক প্রসবের বিকল্প সন্তান জন্মদানের ব্যবস্থা করা হয়। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায়, এটাই অস্ত্রোপচারে শিশু প্রসব বা সিজারিয়ান (সংক্ষেপে সি-সেকশন)। কথিত আছে, রোমের সম্রাট জুলিয়াস সিজারের জন্ম হয়েছিল অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে, সেখান থেকেই নামটা এসেছে।
অবশ্য এটা কতটা সত্য, তা নিয়ে চিকিৎসকদের মধ্যে দ্বিমত আছে। প্রসবের সময় কিছু জটিলতায় মা ও নবজাতকের জীবন হুমকির মুখে পড়তে পারে। তখন সিজারিয়ান অপরিহার্য। কিন্তু এতে মা ও শিশুর কিছু সমস্যাও হয়। তাই একেবারে অপরিহার্য না হলে যেন অস্ত্রোপচার না করা হয়, সেদিকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া দরকার। কিন্তু আমাদের দেশে মা ও শিশুর স্বাস্থ্যঝুঁকির কথা মোটেও বিবেচনা করা হয় না। শুধু অর্থের লোভে এবং ব্যবসায়িক মনোবৃত্তির কারণে অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে শিশু জন্মের সংখ্যা অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে। এর ফলে মা ও শিশু দুজনেই ভোগান্তির শিকার হচ্ছে।
গবেষণায় দেখা গেছে, সিজারিয়ান শিশু বা অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে জন্ম নেয়া শিশুদের চেয়ে স্বাভাবিক প্রসবে জন্ম নেয়া শিশুরা বেশি স্মার্ট ও বুদ্ধিমান হয়। যদি অপ্রয়োজনীয় সিজারে শিশু জন্মের হার বাড়তেই থাকে, তাহলে অদূর ভবিষ্যতে এমন এক অবস্থার উদ্ভব ঘটবে, যখন সিজারে জন্ম নেয়া শিশুরাই জনসংখ্যার একটা বড় অংশ হয়ে দাঁড়াবে। তাদের মাধ্যমে যেসব শিশু জন্ম নেবে, তাদেরও অপারেশনে জন্মলাভের সম্ভাবনা বেশি থাকবে।
অনেক ক্ষেত্রে এই শিশুদের মাথার আকার একটু বড় হতে পারে। তাহলে শেষ পর্যন্ত পৃথিবীতে মানব প্রজাতি হয়তো এমন এক অবস্থায় যাবে, যেখানে মানুষের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা একটু দুর্বল, মেধায় একটু পিছিয়ে থাকবে। স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার বাইরে গেলে এ ধরনের সমস্যা দেখা দেয়া অসম্ভব নয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অস্ত্রোপচার এখন দেশের বেশিরভাগ প্রাইভেট হাসপাতাল-ক্লিনিকের বড় ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। এ প্রবণতা কোনো ক্রমেই রোধ করা যাচ্ছে না, বরং দিন দিন প্রাইভেট হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলো আরও বেপরোয়া হয়ে উঠছে। কোনো প্রসূতি মা পেলেই প্রাইভেট হাসপাতাল-ক্লিনিকগুলোর একশ্রেণির চিকিৎসক থেকে শুরু করে সবাই বিভিন্ন অজুহাতে রোগীকে স্বাভাবিক প্রসবের বিষয়ে কৌশলে মানসিকভাবে ভীতসন্ত্রস্ত করে তোলে।
এমনকি অনেক ক্ষেত্রে অস্ত্রোপচার না হলে মা কিংবা নবজাতকের ক্ষতি হওয়ার ভয়ও দেখানো হয়। নিরুপায় হয়ে প্রসূতি ও তার স্বজনরা নিরাপদ মাতৃত্ব ও সুস্থ সন্তানের স্বার্থে হাসপাতালের প্রত্যাশায় সায় দেয়। আর অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে প্রসব পদ্ধতিতে রাজি হলেই শুরু হয় টাকা হাতানোর হিসাব কষাকষি। অভিযোগ আছে, স্বাভাবিক প্রসবের চেয়ে অস্ত্রোপচারে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক বেশি টাকা পান।
হাসপাতাল বা ক্লিনিক কর্তৃপক্ষেরও এতে রমরমা ব্যবসা বেশি। কারণ বেশি সময় হাসপাতালে থাকতে হয়, ওষুধ বেশি লাগে, অপারেশন থেকে শুরু করে অন্যান্য খরচও বেশি আদায় করা হয়। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে অপারেশনের পর প্রসূতির অনেক সময় বিভিন্ন ধরনের জীবাণুর আক্রমণ দেখা দেয়। এতে হাসপাতালের ব্যবসা বেড়ে যায়।
আর স্বাভাবিক প্রসব হলে রোগী এক-দুদিনের মধ্যে বাসায় চলে যেতে পারে। কিন্তু অস্ত্রোপচার হলে আগে-পরে মিলিয়ে রোগীকে প্রায় এক সপ্তাহ থাকতে হয়। এতে হাসপাতালের কেবিন বা বেডভাড়া ও বিভিন্ন সার্ভিস চার্জের নামে বেশি টাকা আদায় করা সম্ভব। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, প্রাইভেট হাসপাতাল ও ক্লিনিকের দেখাদেখি এখন সরকারি ও বিভিন্ন এনজিওর হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোয়ও অস্ত্রোপচারের প্রবণতা উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে।
আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি), বিশ্ব ব্যাংকসহ ছয়টি প্রতিষ্ঠানের গবেষকদের ২০১৮ সালের একটি প্রবন্ধে বলা হয়েছে, গড়ে একটি প্রসবজনিত অস্ত্রোপচারে বাংলাদেশে খরচ হয় ২২ হাজার ৮৫ টাকা। জাতীয়ভাবে আর কোনো হিসাব পাওয়া যায়নি বলে আগের খরচটিকে বর্তমান খরচ বলে বিবেচনা করা হয়েছে।
সবশেষ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ অনুযায়ী, ২০২২ সালে ৩৬ লাখ ৩ হাজার ৫০৬টি শিশুর জন্ম হয়েছিল। এর মধ্যে ৪৫ শতাংশ বা ১৬ লাখ ৯ হাজার ১৫৬টি শিশুর জন্ম হয়েছিল অস্ত্রোপচারে। এর মধ্যে অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচারে ১০ লাখ ৭২ হাজার ৭৭০টি শিশুর জন্ম হয়েছিল।
অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচার না হলে এসব শিশুর জন্ম হতো স্বাভাবিক প্রসবে। স্বাভাবিক প্রসবের কিছু হয় বাড়িতে, কিছু হাসপাতালে। আগের গবেষকরা দেখেছেন, স্বাভাবিক প্রসবে গড়ে ৩ হাজার ৫৬৫ টাকা করে খরচ হয়। স্বাভাবিক প্রসবের পরিবর্তে অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচারের কারণে প্রতিটি প্রসবে বাড়তি খরচ হয়েছে ১৮ হাজার ৫২০ টাকা করে। ২০২২ সালে শিশু জন্মে বাড়তি খরচ হয়েছে এক হাজার ৯৮৬ কোটি টাকা। এই টাকায় ১৪ হাজার ২০৮টি কমিউনিটি ক্লিনিকের তিন বছরের খরচ চালানো সম্ভব। কমিউনিটি ক্লিনিকের জন্য বছরে সরকারের বরাদ্দ থাকে ৬০০ কোটি টাকা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাস্তবে ১৫ থেকে ২০ ভাগের বেশি অস্ত্রোপচারের দরকার নেই। কিন্তু এখন ঢাকার বাইরেও অস্ত্রোপচারের প্রবণতা বাড়ছে। এর কারণ হিসেবে তারা বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোর ব্যবসায়িক মনোবৃত্তিকে দায়ী করেন। প্রসূতি মা ও পরিবারের মধ্যেও একধরনের মনোভাব তৈরি হয়েছে যে, অস্ত্রোপচার পদ্ধতি নিরাপদ। কিন্তু অপ্রয়োজনে অস্ত্রোপচার মায়ের মৃত্যুঝুঁকি এবং নানা ধরনের শারীরিক জটিলতার আশঙ্কা অনেক বাড়িয়ে দেয়।
আসলে এটি শুধু একটি অস্ত্রোপচার নয়। রোগীকে অজ্ঞান করতে হয়। ফলে তার ঝুঁকি বেড়ে যায়। একবার অস্ত্রোপচার করলে পরবর্তীতেও অস্ত্রোপচার করতে হয়। অনেক সময় জরায়ু কেটে ফেলে দিতে হয়। প্রসবের থলিও ফেটে যায়। অনেক সময় এত রক্তপাত হয় যে, মাকে আর রক্ষা করা যায় না।
অস্ত্রোপচার বাড়ার পেছনে হাসপাতাল ও ক্লিনিকের ব্যবসায়িক মনোবৃত্তি ছাড়াও এটা এখন অনেকের কাছে একটা ফ্যাশন হয়ে গেছে। তারা মনে করছেন, স্বাভাবিক প্রসবের চেয়ে অস্ত্রোপচারে মায়ের শরীর এবং অন্যান্য বিষয়ের জন্য ভালো। এটি মারাত্মক ভুল ধারণা এবং এটা দূর করতে হবে। অস্ত্রোপচার কমাতে হলে সবাইকে সচেতন করতে হবে।
আর এ সচেতনতা রোগী ও চিকিৎসক সবার মাঝেই তৈরি করতে হবে। নিরাপদ মাতৃত্ব শুধু সন্তান প্রসবের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। মায়ের গর্ভধারণ থেকে শুরু করে সন্তান প্রসব এবং প্রসব-পরবর্তী স্বাস্থ্যসেবার সব কিছুই এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। মায়ের স্বাস্থ্য ও পুষ্টি নিশ্চিতের ওপরই নির্ভর করে নবজাতকের স্বাস্থ্য এবং পুষ্টি। এজন্য সরকার ও চিকিৎসা সংশ্লিষ্ট সবাইকে সচেতনতার পাশাপাশি এ উদ্বেগজনক অস্ত্রোপচার রোধ করতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
লেখক: ব্যাংকার ও কলাম লেখক
নয়া শতাব্দী/আরজে
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ