ঢাকা, রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক মূল্যায়ন পদ্ধতি চালু হোক

প্রকাশনার সময়: ৩১ মার্চ ২০২৪, ০৮:০৭

গুণগত ও মানসম্পন্ন শিক্ষাই একটি সুশিক্ষিত জাতি গঠনের মূল ভিত্তি। আর এ সুশিক্ষা নিশ্চিত করার কান্ডারি হচ্ছেন একজন দক্ষ শিক্ষক। শুধু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা দায়সারাভাবে প্রদানই একজন শিক্ষকের মূল লক্ষ্য না হয়ে সেই শিক্ষাকে সঠিকভাবে প্রদান করা একজন আদর্শ শিক্ষকের দায়িত্ব ও কর্তব্য। জ্ঞান বিতরণ এমনভাবে করা উচিত যাতে প্রত্যেক শিক্ষার্থী সঠিকভাবে বিষয়টিকে বুঝতে পারেন, ধারণ করতে পারেন ও প্রয়োগ করতে পারেন।

কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, বাংলাদেশের অধিকাংশ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকরা ক্লাস নেন সীমিত পরিসরে। মার্কিন শিক্ষা বিভাগের মতে, তিন ক্রেডিটের কোর্সে একজন শিক্ষকের ১৫ সপ্তাহে ৩ ঘণ্টা করে সর্বমোট ১৫দ্ধ৩= ৪৫ ঘণ্টা ও চার ক্রেডিট কোর্সের জন্য ১৫ সপ্তাহে ৪ ঘণ্টা করে সর্বমোট ১৫দ্ধ৪= ৬০ ঘণ্টা ক্লাস নেয়ার কথা থাকলেও শিক্ষকরা কোর্স প্রতি ১৫ থেকে ২০ ঘণ্টা ক্লাস নিয়ে থাকেন। কারণ অনুসন্ধানে দেখা গেছে, কিছু বিভাগে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাতে শিক্ষক ঘাটতি থাকলেও বেশ কিছু বিভাগে রয়েছে শিক্ষকদের অনিচ্ছা ও দায়িত্বহীন মনোভাব। অনেক সময় দেখা যায়, নির্ধারিত এ ক্লাসগুলোতেও শিক্ষকদের শিখন পদ্ধতি শিক্ষার্থীদেরকে আকৃষ্ট করে না। অনেকে শিক্ষার্থীদের পড়ান গদবাধা নিয়মেই। পাঠদান প্রক্রিয়ায় থাকে না কোনো অভিনব পদ্ধতি। সেমিস্টার পরীক্ষা না আসা পর্যন্ত প্রকাশ করা হয় না পরীক্ষার সিলেবাস। প্রকাশ করা হয় না ইন্টারনাল মার্কস। বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য সার্বক্ষণিকভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত হলেও ক্লাসের বাইরে শিক্ষার্থীদের দেন না তেমন সময়। স্বীয় বিভাগের শিক্ষার্থীদের কাউন্সিলিং না করে বাইরে কাউন্সিলিং ও ব্যবসার মাধ্যমে মত্ত থাকেন অর্থ উপার্জনে। নম্বর কমে যাওয়ার শঙ্কায় শিক্ষকদের নিয়ে মন্তব্যও করতে পারেন না শিক্ষার্থীরা। অনেক সময় শিক্ষক কর্তৃক কুপ্রস্তাবের বিপরীতে মুখ খুলতে সাহস পান না নারী শিক্ষার্থীরা। ফলে অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও তাল মেলাতে হয় অনৈতিক কার্যক্রমে। সম্প্রতি দেশসেরা বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক কর্তৃক নারী শিক্ষার্থীকে কুপ্রস্তাব এবং কুপ্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় নানা রকম হেনস্তার ঘটনা বেড়েই চলেছে। এজন্য প্রয়োজন শিক্ষক মূল্যায়ন পদ্ধতি। একজন শিক্ষকের জানা দরকার শিক্ষকতায় তার ঘাটতি কোথায়? কিভাবে শিখন পদ্ধতি আরও শিক্ষার্থী উপযোগী করা যায়? কোর্সের উপকরণ কিভাবে সাজালে শিক্ষার্থীদের জন্য সহজবোধ্য হয়? যে পদ্ধতিতে শিক্ষক জ্ঞান বিতরণ করছেন সেটি শিক্ষার্থীদের কাছে কতটুকু সহজবোধ্য? কতটুকু ফলপ্রসূ? এসব প্রশ্নের উত্তরে শিক্ষকের প্রয়োজন শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে নিয়মিত মন্তব্য গ্রহণ। শিক্ষার্থীদের মন্তব্যে নিজেকে মূল্যায়ন করে জ্ঞান বিতরণ পদ্ধতিতে নতুনত্ব নিয়ে আসা। কর্তৃপক্ষের উচিত একজন শিক্ষক পর্যাপ্ত ক্লাস নিচ্ছেন কি না সেটি নজরদারি করা।

শিক্ষক মূল্যায়ন ফরমের মাধ্যমে একটি নির্দিষ্ট কোর্সের শিক্ষকের ব্যাপারে শিক্ষার্থীদের মন্তব্য নেয়া। এসব শিক্ষক মূল্যায়ন ফরমে থাকবে না কোনো শিক্ষার্থীর নাম, রোল বা অন্য কোনো পরিচয়। পরে উক্ত কোর্স শিক্ষকের সঙ্গে একান্তে বসে শিক্ষার্থীদের মন্তব্য অনুযায়ী কোন কোন জায়গায় উন্নয়ন করা যায় সেগুলো পরামর্শ দেবেন। যৌন নিপীড়ন বা মার্কস টেনপারিংয়ের কোনো অভিযোগ পেলে শিক্ষককে সতর্ক করবেন। বছর শেষে নির্দিষ্ট সময় অন্তত একবার করা যেতে পারে শিক্ষক মূল্যায়ন। শিক্ষার্থীরা নাম, রোল, পরিচয়হীনভাবে মূল্যায়ন করবেন শিক্ষককে। এতে করে নিশ্চিত হতে পারে মানসম্মত শিক্ষা। শিক্ষকরা সুযোগ পাবেন নিজেদেরকে আরও শিক্ষার্থী উপযোগী করে তুলতে। তবে কোনোভাবেই এই শিক্ষক মূল্যায়নকে রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা যাবে না। শিক্ষক মূল্যায়নে যেসব পদ্ধতি ব্যবহার করা যেতে পারে— শিক্ষকের পাঠদানের কার্যকারিতা বিভিন্ন উপায়ে পরিমাপ করা যেতে পারে। উল্লেখ্যযোগ্য তিনটি টুল হলো- ১. স্টুডেন্ট অ্যাচিভমেন্ট গ্রোথ: ‘স্টুডেন্ট অ্যাচিভমেন্ট গ্রোথ’ হলো সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষার্থীর একাডেমিক অগ্রগতির ওপর শিক্ষকের প্রভাব পরিমাপ করে।

এটি শিক্ষার্থীদের একাডেমিক পারফরম্যান্সের উন্নতিতে শিক্ষকের নির্দেশনামূলক পদ্ধতি কতটুকু কার্যকর সেটি নির্ধারণে সহায়তা করে। ২. স্টুডেন্টস পারসেপশনস অব দ্য টিচার ইফেক্টিভনেস অ্যান্ড ক্লাসরুম ইন্সট্রাকশনাল ক্লাইমেট: এ পদ্ধতিতে শিক্ষকের কার্যকারিতা এবং শ্রেণিকক্ষে শেখার পরিবেশ সম্পর্কে শিক্ষার্থীরা কী মনে করছেন সেই তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এ পদ্ধতিতে নাম, রোল, পরিচয় গোপন রেখে শিক্ষার্থীরা কিছু প্রশ্নের ভিত্তিতে প্রতিক্রিয়া প্রদান করে থাকে। যেমন: নির্দিষ্ট কোর্সে কোনো শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে কেমন পাঠদান করেন? ক্লাসের রুটিন অনুযায়ী সময়মতো ক্লাস শুরু করেন কিনা? নির্দিষ্ট সময়ে কোর্স শেষ করেন কিনা? জ্ঞানভিত্তিক লেকচার দেন কিনা? কোর্সের বিষয়বস্তু কেমন? ক্লাসগুলো আকর্ষণীয় এবং প্রাণবন্ত করতে পারছেন কিনা? শ্রেণিকক্ষে আরামদায়ক অ্যাকাডেমিক পরিবেশ তৈরি করতে পারছেন কিনা? কোর্স ম্যাটেরিয়ালস সরবরাহ করছেন কিনা? পরীক্ষা-অ্যাসাইনমেন্ট ঠিকমতো নিচ্ছেন কিনা? এবং সেগুলোর ঠিকমত মূল্যায়ন হচ্ছে কিনা? সামগ্রিকভাবে শিখন প্রক্রিয়া কার্যকর ছিল কিনা? এ প্রতিক্রিয়া শিক্ষকদের শিক্ষাদানের পদ্ধতি এবং শ্রেণিকক্ষের কার্যকলাপের কৌশলগুলো কীভাবে শিক্ষার্থীরা উপলব্ধি করছে সে সম্পর্কে অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করে।

৩. পিয়ার রিভিউ: এক্ষেত্রে শিক্ষকগণ সহকর্মীদের একে অপরের শিক্ষার কৌশলগুলো পর্যবেক্ষণ করবে এবং নিয়মতান্ত্রিকভাবে বিভাগের উদ্দেশের সঙ্গে মিল রেখে পাঠদানের কৌশলগুলোর উন্নতিতে আলোচনা করার ক্ষেত্র তৈরি করবে। এক্ষেত্রে পিয়ার রিভিউ একদিকে শিক্ষকদের মধ্যে সহযোগিতার সংস্কৃতি তৈরি করবে, অন্যদিকে শিক্ষকরা একে অপরের অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা বিনিময়ের মাধ্যমে পাঠদানের পরিবেশকে ক্রমাগত উন্নত করতে পারবেন। শিক্ষক মূল্যায়ন পদ্ধতির কিছু বিশেষ উপকারিতা: শিক্ষক মূল্যায়নের ফলে জবাবদিহিতা নিশ্চিতের পাশাপাশি শিক্ষকদের মধ্যেও ক্রমাগত নতুন কিছু শেখার সংস্কৃতি গড়ে উঠবে। শিক্ষকগণ শিক্ষাদান পদ্ধতিতে উৎকর্ষ ও উদ্ভাবনের জন্য ক্রমাগত চেষ্টা করতে উৎসাহিত হবেন।

শিক্ষকগণ নিজের সর্বোচ্চ সক্ষমতা দিয়ে শেখাতে পারবেন এবং ছাত্ররা তাদের সর্বোচ্চ সক্ষমতা দিয়ে শিখতে পারবেন। শিক্ষক-শিক্ষার্থী ইন্টারঅ্যাকশন বৃদ্ধি পাবে। শিক্ষকগণ পাঠদান ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগে সচেতন হবেন। শিক্ষার্থীরা শিখন প্রক্রিয়ায় নিজেদের মতামত প্রদানের মাধ্যমে ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে পারবেন। শিক্ষার্থীদের শেখার সম্ভাবনাকেই বাড়িয়ে তুলবে। শিক্ষার গুণগত মান আরও উন্নত হবে। এ ছাড়া জবাবদিহিতার পরিবেশ তৈরি হওয়ায় যৌন নিপীড়নসহ শিক্ষক কর্তৃক শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন রকম হেনস্তা কমে যাবে।

শিক্ষক মূল্যায়ন পদ্ধতিতে চ্যালেঞ্জ: শিক্ষক মূল্যায়ন পদ্ধতি বাস্তবায়ন করার ক্ষেত্রে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। এর মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য হচ্ছে শিক্ষকদের একটি পক্ষের ভেটো ও অনীহা। এ ছাড়াও অনেক সময় শিক্ষক মূল্যায়নকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করা হতে পারে। রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের ক্ষেত্রে শিক্ষক মূল্যায়নকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার সম্ভাবনা থাকতে পারে। শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন পর্যালোচনা করার সময় শিক্ষকরা কখনো কখনো ভুল বুঝতে পারেন। শিক্ষকদের অনেকেই শিক্ষক মূল্যায়নকে নিজের পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধির একটি টুল হিসেবে না দেখে বরং ব্যক্তিগতভাবে নিতে পারেন।

শিক্ষক মূল্যায়নের দৃষ্টান্ত: সম্প্রতি জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে চালু করা হয়েছে এ শিক্ষক মূল্যায়ন পদ্ধতি। যেটিকে বলা হয়েছে ‘স্টুডেন্টস পারসেপশনস অব দ্য টিচার ইফেক্টিভনেস অ্যান্ড ক্লাসরুম ইন্সট্রাকশনাল ক্লাইমেট’। বিভাগটিতে শিক্ষার গুগগত মান নিশ্চিতে বিভাগীয় প্রধান প্রফেসর ড. মো. সুজন আলী (শেখ সুজন আলী) গ্রহণ করেছেন এ উদ্যোগ।

শিক্ষকরা যাতে শিক্ষার্থীদের মন্তব্য অনুযায়ী নিজেদেরকে গুছিয়ে শিক্ষার্থীদের মতো করেই জ্ঞান পরিবেশ করতে পারেন সেজন্য এ উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি। তার গৃহীত এ শিক্ষক মূল্যায়ন পদ্ধতিতে নির্দিষ্ট কোর্সে কোনো শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে কেমন পাঠদান করেন? ক্লাসের রুটিন অনুযায়ী সময়মতো ক্লাস শুরু করেন কিনা? নির্দিষ্ট সময়ে কোর্স শেষ করেন কিনা? জ্ঞানভিত্তিক লেকচার দেন কিনা? কোর্সের বিষয়বস্তু কেমন? ক্লাসগুলো আকর্ষণীয় এবং প্রাণবন্ত করতে পারছেন কিনা? শ্রেণিকক্ষে আরামদায়ক অ্যাকাডেমিক পরিবেশ তৈরি করতে পারছেন কিনা? কোর্স ম্যাটেরিয়ালস সরবরাহ করছেন কিনা? পরীক্ষা-অ্যাসাইনমেন্ট ঠিকমতো নিচ্ছেন কিনা? এবং সেগুলোর ঠিকমতো মূল্যায়ন হচ্ছে কিনা?

সামগ্রিকভাবে শিখন প্রক্রিয়া কার্যকর ছিল কিনা? এমন মোট ১০টি বিষয়ে লিকার্ট স্কেলে শিক্ষার্থীদের মতামত জানতে চাওয়া হবে। শেষের প্রশ্নের ভিত্তিতে লিখিতভাবে মন্তব্য ও পরামর্শ দেয়ার সুযোগও আছে। এ মূল্যায়ন পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীর কোনো ব্যক্তিগত তথ্য উল্লেখ থাকবে না। সব তথ্য গোপন রেখে একজন শিক্ষার্থী একটি নির্দিষ্ট কোর্সের জন্য সেই শিক্ষককে মূল্যায়ন করতে পারবে।

শিক্ষার্থীদের এ মূল্যায়নকে আমলে নিয়ে সেই শিক্ষকের শিক্ষা প্রদানের পদ্ধতিকে অনেক ভালো (এ), ভালো (বি), সন্তোষজনক (সি) কিংবা উন্নতির প্রয়োজন (ডি) এ চারটি ভাগে মূল্যায়ন করা হবে এবং সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এ ছাড়াও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়, নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয় ও ইন্ডিপেন্ডেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশসেরা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক মূল্যায়ন পদ্ধতি চলমান রয়েছে। শিক্ষার্থীদের মতামতের ভিত্তিতে শিক্ষকদের পাঠদানের মূল্যায়ন পদ্ধতি চালুর উদ্যোগ নিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ও। যা জুন (২০২৪) থেকে চালুর কথা ভাবছে কর্তৃপক্ষ।

লেখক: সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরাম, নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় শাখা।

নয়া শতাব্দী/আরজে

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ