ডেটলাইন এপ্রিল ২০১১। সব বড় পত্রিকায় শিরোনাম হয়, ‘ধর্মবিরোধী কর্মকাণ্ডের অভিযোগে তওবা পড়ানো হলো ২৮ বাউলকে!’ রাজবাড়ীর পাংশা উপজেলার হাবাসপুরে লালন ভক্ত ২৮ বাউলকে লাঞ্ছিত করার পর মাথার চুল ও গোঁফ কেটে দিয়েছে স্থানীয় প্রভাবশালীরা। ‘ধর্মবিরোধী কর্মকাণ্ড চালানোর কারণ দেখিয়ে বাউলদের মসজিদে নিয়ে তওবাও পড়ানো হয়।
এমন সংবাদ হরহামেশাই খবরের কাগজে আসে। বরাবর ক্ষমতাসীন দলের লোকজন এসব হামলার পেছনে থাকে। রাজনৈতিক ধর্মের ধ্বজাধারী ওই ক্ষমতাবানরা মামলা ও বিচার প্রক্রিয়াকেও বাধাগ্রস্ত করে। লালনের অনুসারীরা নবী-রাসুল, অবতার, বেদ-পুরাণকে এক ধরনের সমন্বয়বাদের মাধ্যমে আত্মস্থ ও উপস্থাপন করেন। তারা জাতিভেদ প্রথা বাতিল ঘোষণা করে অসাম্প্রদায়িক চেতনার উন্মেষ ঘটান। এটা সংখ্যাগরিষ্ঠ সাম্প্রদায়িকদের পছন্দ হয় না।
তারা লালনপন্থিদের একঘরে করে কোণঠাসা করে রাখার প্রয়াস পান। আক্রমণকারী তারা মনে করে মহামতি লালনের অনুসারীরা তাদের জাতধর্ম বিনাশ করে ফেলবে। এ অবস্থা গৃহহীন ছন্নছাড়া লালনের ফকির হয়ে ওঠার সময়কাল থেকে শুরু করে এখনো সমানতালে চলছে।
এবার রাষ্ট্র নিজেই লালন তরিকার লোকদের সাধনা আটকে দিল। লালন ভাবাদর্শের বাউলরা রাষ্ট্রীয় নির্দেশনা মেনে নিলেও তাদের মন খারাপ হলো, অসহায়বোধ করলেন সবাই; এটা সহজেই অনুমেয়। সংখ্যালঘুদের ওপর সংখ্যাগরিষ্ঠ তার আপন ধর্মের ভাবগাম্ভীর্য চাপিয়ে দিয়ে নিজের স্বার্থটাই কেবল দেখবে, এটা সভ্যতার পরিচয় নয়।
গণমাধ্যমের খবর থেকে জানা যায়, পবিত্র মাহে রমজানের পবিত্রতা রক্ষার্থে এ বছর লালন স্মরণোৎসবে শুধুমাত্র আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। তিন দিনব্যাপী লালন মেলা ও সবার অংশগ্রহণমূলক ‘সাধুসঙ্গ’ উৎসব হলো না!
অবশ্য ফ্রান্স থেকে এসে লালনের ভাবাদর্শে মজে গিয়ে বাংলাদেশে থেকে যাওয়া লালন গবেষক দেবোরাহ জান্নাত কুকিয়েরম্যান জানালেন এমনটা, ‘উচ্ছৃঙ্খল পরিবেশ নেই। শিল্পীর চিল্লানি নেই। মাদক ব্যবসায়ীরা বসেনি এবার। ফকিরদের হাতে নিজের ব্যবস্থা চলছে, যেভাবে চলে এসেছে। সাধুগুরু এসে গিয়েছে, পূর্ণিমা উঠতে যাচ্ছে। সাধুসঙ্গ হবে না কেন? কেউ কোনো বাধা দিচ্ছে না তো। রক্ষার্থের দোহাই দিয়ে সাঁইজীকে রাজনীতিতে ঢুকানোর ফলে ফকিরদের ক্ষতি কম হয়নি। জয়গুরু।’
লালন স্মরণোৎসবকে কেন্দ্র করে বিগত দিনে কুষ্টিয়ার কুমারখালীর ছেঁউড়িয়ার লালন আখড়াবাড়ি এলাকায় সাধু-ভক্ত-দর্শনার্থীদের মিলনমেলায় পরিণত হয়। বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে বসে গ্রামীণ মেলাও। তবে এবারের আয়োজনে থাকেনি বড় পরিসরের আয়োজন ও মেলা। অবশ্য আধুনিককালের লালন স্মরণোৎসব কিংবা মেলা সদগুরুরা পছন্দ করেন এমন নয়। বিচিত্র ধরনের বাইরের লোকদের আনাগোনা নিশ্চিতই সাধকদের ধ্যানভঙ্গের কারণ ঘটায়।
এ ব্যাপারে বিশিষ্ট লোক গবেষক ড. সাইমন জাকারিয়া তার সোশ্যাল হ্যান্ডেলে লিখেছেন, ‘লালনপন্থি সাধকরা অতীতে ছেঁউড়িয়া গ্রামে লালন সাঁইয়ের আখড়ায় সমবেত হয়ে নিজেদের আয়োজনেই লালন প্রবর্তিত দোলপূর্ণিমার সাধুসঙ্গ করতেন। এই সাধুসঙ্গে মূলত ভাবসাধনার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে পর্ব ধরে ধরে আলোচনা ও সংগীত উপস্থাপনার পাশাপাশি গুরু-ভজনার নানা কৃত্যাচার পালন করা হতো। এতে মূলত লালনপন্থি এবং অন্যান্য গুরুবাদী সাধক ও ভক্তরা একত্রিত হতো এবং সাধুসঙ্গের সুনির্দিষ্ট কৃত্যাচার পালন করা হতো। কিন্তু সে সব এখন অতীত হয়েছে।গুরুবাদী ধারার সেই সাধুসঙ্গের পরিবর্তে বহুদিন ধরে একই স্থানে অভক্ত ও গুরুহীন ক্ষমতাসীন বিভিন্ন ধরনের ব্যক্তির পরিচালনা ও নেতৃত্বে ‘লালন মেলা’, ‘লালন উৎসব’, ‘লালন স্মরণোৎসব’ প্রভৃতি অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এতে করে সাধুগুরুরা নতুন কালের আয়োজকদের নির্দেশনা মেনে গান, আসন, খাদ্য গ্রহণ প্রভৃতি করতে বাধ্য হন।
ফলে লালন সাঁইয়ের দর্শন, সংগীত পরিবেশন, সেবা গ্রহণ ও সাধন পদ্ধতির রীতিনীতি সাংঘাতিকভাবে ব্যাহত হয়। কিন্তু সাধুগুরুরা যেহেতু হিংসা-দ্বেষ, ক্রোধ-প্রতিবাদ, প্রতিক্রিয়ার বাইরে নিজেকে নিয়ন্ত্রণের সাধনায় সমাহিত সেহেতু নতুন কালের বিকৃতিতেও তারা প্রত্যক্ষ কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে না। কিন্তু সমাজের শিক্ষিত, ভদ্র, ক্ষমতাবানদের কি উচিত নয় ছেঁউড়িয়া গ্রামে লালন সাঁইয়ের অনুসারীদের সাধনা ও কৃত্যাচার লালনপন্থি ও গুরুবাদী সাধকদের নিজেদের রীতি অনুযায়ী করতে দেয়া?’
বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহ তার জীবদ্দশায় কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ার আখড়াবাড়িতে প্রতি বছর চৈত্রের দোলপূর্ণিমা রাতে বাউলদের নিয়ে সাধুসঙ্গ উৎসব করতেন। তার মৃত্যুর পরও এ উৎসব চালিয়ে আসছেন তার অনুসারীরা।
সাধুসঙ্গ কী? সাধুসঙ্গে ‘সত্য সুপথ চিনতে আর অজানাকে জানতে’ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সাধু, গুরু ও লালনভক্ত ব্যক্তিরা যোগ দেন। সেখানে ফকির লালন সাঁইয়ের বিভিন্ন জ্ঞানসমৃদ্ধ বাণী পরিবেশন করেন সাধুরা। প্রাজ্ঞ ফকিররা গান পরিবেশনসহ সাঁইজির বাণী বিশ্লেষণ করে শোনান। লালনবাদীদের এমন একটি অবশ্যপালনীয় রিচ্যুয়াল বা কৃত্যের সঙ্গে মুসলিমদের রমজানকে কেন হঠাৎ করে সাংঘর্ষিক অবস্থানে নেয়া হলো আমরা তা কিছুতেই বুঝতে পারছি না। এমনটা তো কখনোই কল্পনা করা যায় না যে সংখ্যালঘিষ্ঠের ধর্মাচার পালনের ভাবগাম্ভীর্য রক্ষায় সংখ্যাগুরুর ধর্মাচার কাটছাঁট করা হবে!
কঠিন ব্রত সিয়াম সাধনার মধ্য দিয়ে মুসলিমদের অধিকতর প্রেমময়, অহিংস, উদারনৈতিক, সহনশীল, সংবেদনশীল ও পরমতসহিষ্ণু হিসেবে গড়ে ওঠার কথা। সেটি না হয়ে রাষ্ট্র কেন এর বিপরীতে অবস্থানকারী কট্টরপন্থায় নিমজ্জিতদেরকে দখিনা বাতাস দিয়ে যাবে? আমাদের সংবিধান কি সংখ্যালঘুর ধর্মাচার পালনের স্বাধীনতা নিশ্চিত করেনি? আমরা ঠিক বুঝতে পারছি না, এই সময়ের রাষ্ট্রনিয়ন্তা যারা তারা আসলে সংখ্যাগুরুর ধর্মাচারকে অন্যের প্রতি অন্যায্য দাবি আরোপ করার বাহন করতে চায় কেন? তাহলে কালান্তরে মহাত্মা লালন ফকিরের ধর্মাচারকে কি বাতিল বলে গণ্য করা হবে?
সাধুসঙ্গ যদি রমজানের পবিত্রতাই বিঘ্নিত করে তাহলে লালন একাডেমির যারা নিয়ন্ত্রক তারা আর পবিত্র থাকেন কী করে? যারা স্মরণোৎসবের আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হবেন তাদের পবিত্রতাই বা কীভাবে রক্ষিত হবে?
লালনধর্মের প্রধানতম আরাধ্য বিষয় হলো নিজের মধ্যে দাস্যভাব বজায় রেখে সত্য ও সহজ মানুষের সন্ধান করা। আমরা কোনোদিন শুনিনি লালন তরিকার অনুসারীরা কারও সঙ্গে বিবাদে লিপ্ত হয়েছে, কারও হক তথা অধিকার বিনষ্ট করেছে কিংবা ভিন্ন মতাদর্শের প্রতি জুলুম করেছে। বরং এ অনাচারগুলো হরহামেশাই করে যারা সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্ম পালনের দোহাই দিয়ে লালনবাদকে নিয়ন্ত্রিত রাখতে চায়।
একটি বিশেষ ধর্মের দোহাই দিয়ে অন্যের চিরায়ত মতাদর্শকে কেন দমিয়ে রাখা হবে? কোন নৈতিকতা বলে আমরা এমনটা করতে পারি? সাধুসঙ্গ করলে রমজানের ভাবগাম্ভীর্য কেন ক্ষুণ্ন হবে? সকল জাতি ধর্ম গোষ্ঠীর সমানাধিকার কেন নিশ্চিত করা হবে না? সাধুসঙ্গ সব অনর্থকে বিবর্তিত করে অর্থপূর্ণ অবস্থান দান করে। ইন্দ্রিয়র কুস্বভাব দূরীভূত করে মানুষকে শুদ্ধ ও শুচি করে। মানুষকে সত্য সুপথ চেনায়। মহামতি লালন ফকির তার কালামেই যেমনটা বলেন- সাধুসঙ্গ কর তত্ত্ব জেনে।/সাধন হবে না অনুমানে।/সাধুসঙ্গ কর রে মন/অনর্থ হবে বিবর্তন/ব্রহ্মজ্ঞান ইন্দ্রিয় দমন/হবে রে সঙ্গগুণে। লেখক: সাংবাদিকনয়া শতাব্দী/আরজে
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ