ঢাকা, শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শহিদদের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে হবে

প্রকাশনার সময়: ২৬ মার্চ ২০২৪, ১০:২৬ | আপডেট: ২৬ মার্চ ২০২৪, ১০:৩৪

স্বাধীনতাহীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে/কে বাঁচিতে চায়/দাসত্ব-শৃঙ্খল কে পরিবে পায়/বল কে পরিবে পায়?’ স্বাধীনতাহীনতায় কেউ বাঁচতে চায় না। স্বাধীনতাহীনতায় বাঁচা যায় বটে, তবে সে বাঁচাকে মানুষের মতো বাঁচা বলে না। স্বাধীনতা যে কোনো জাতির কাছে তাই এত প্রিয়, আমাদের কাছেও তাই। স্বাধীনতা আমাদের পরম প্রিয়, পরম ধন। স্বাধীনতা আমাদের অর্জন করা জিনিস। এ অর্জন সম্ভব হয়েছে অনেক রক্ত, অনেক প্রাণ এবং অনেক দুঃখ-বেদনা-ত্যাগের মাধ্যমে। আমাদের স্বাধীনতার একটা গৌরবমণ্ডিত ইতিহাস রয়েছে। অনেক দীর্ঘ সে ইতিহাস। একাত্তরে এসে চূড়ান্ত রূপ পায় এই সংগ্রামের ধারাটি। একাত্তর যারা দেখেছেন তারা ইতিহাসের চূড়ান্ত পর্যায়টি দেখেছেন।

সারা দেশের মানুষ এ স্বাধীনতার জন্য এক হয় সে সময়। এ এক অভূতপূর্ব ঘটনা। সারা দুনিয়া আমাদের দেশের এই অবস্থা দেখে তাজ্জব হয়েছে। সারা পৃথিবীর মানুষ আমাদের সমর্থন করেছে। তারপর নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর স্বাধীনতা যুদ্ধের পূর্ণ সাফল্য অর্জিত হয়। আজ আমাদের স্বাধীনতার ঐতিহাসিক দিন, ফিরে এসেছে আমাদের কাছে।

এই দিনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে একটি ভয়াবহ স্মৃতি ২৫ মার্চের স্মৃতি। ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে চলছে হত্যাযজ্ঞ। সারা ঢাকা শহর আক্রান্ত হয়েছে কিছুক্ষণ আগে। চলছে গোলাগুলি। আক্রান্ত হয়েছে রাজারবাগ পুলিশ লাইন, বিডিআর তথা তৎকালীন ইপিআরের পিলখানার সদর দপ্তর। এভাবেই একের পর এক চলছে আক্রমণ। সারাটা শহরে চলছে তাণ্ডব। অস্ত্রশস্ত্র গোলাবারুদ নিয়ে চালানো এই তাণ্ডবে অগণিত মানুষ প্রাণ হারাল। বস্তি, ঘরবাড়ি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হলো। সারা রাত অনবরত গোলাগুলি চলল। নরমেধযজ্ঞ বলতে যা বোঝায় ঢাকাজুড়ে ২৫ মার্চ চলল সেটাই। সারা শহরে সৃষ্টি করল ওরা ভয়াবহ আতঙ্ক। সাধারণ মানুষ, শ্রমিক, ছাত্র, শিক্ষক থেকে শুরু করে নানা পর্যায়ের অগণিত মানুষের রক্ত ঝরল। কয়েক ঘণ্টা আগে, আগের দিনও যেখানে গোটা শহর ছিল প্রাণবন্ত, মানুষের কাজকর্ম, হাসি-আনন্দে ছিল মুখরিত, যে শহর ছিল মিছিলে উত্তাল, উষ্ণ, ২৫ মার্চ রাতে সে শহরে নেমে এল স্তব্ধতা। সারা শহর যেন ঢেকে গেল অন্ধকারের কালো পর্দায়। মানুষের মনে শঙ্কা ছিল, কী হয়, কী হয় এ রকম একটা প্রশ্ন ছিল, সে প্রশ্নের উত্তর তক্ষুণি পেয়ে গেল মানুষ। বুঝল ওরা আমাদের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাকে গুঁড়িয়ে দিতে চায়। ওরা সব সময় দাবিয়ে রাখতে চায়। ওরা স্তব্ধ করে দেবে সব। এ দেশের মানুষের ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষা-স্বপ্নকে চিরদিনের জন্য অন্ধকার এবং অত্যাচারের যবনিকার আড়ালে ঢেকে দিতে চায়।

কিন্তু আঁধার দেখে ভয় পায় না মানুষ। আড়ালে তার সূর্য হাসে। রাতের আঁধার গাঢ়, ঘনীভূত হলেও তা স্থায়ী হয় না। ভোর হবেই। অন্ধকার তাড়িয়ে ফুটবে আলোর রেখা। একাত্তরেও তাই হয়েছে। ২৫ মার্চের ঘন আঁধারের পরই আমাদের ২৬ মার্চ—আমাদের জাতীয় জীবনের আলো ফুটেছে। বয়ে এনেছে আমাদের জীবনে নতুন প্রভাত, শুরু হয়েছে নবজাগৃতির দিন। আজ ২৬ মার্চ সেই দিন।

পাকিস্তান আন্দোলন ও প্রতিষ্ঠায় এ দেশের মানুষের অবদান যথেষ্ট। কিন্তু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার অল্প কিছুকাল পরই স্বপ্নভঙ্গ হয় মানুষের। যে স্বপ্ন মানুষ দেখেছিল, যে আশা করেছিল, তা পূরণ হলো না। পূরণ হওয়ার পথে পদে পদে বাধা সৃষ্টি করা হয়। এ দেশের মানুষের অন্তরের প্রিয় সম্পদ তার সংস্কৃতি। প্রথমেই বড় ধরনের আঘাত আসে এ সংস্কৃতির ওপর।

তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বাংলা ভাষার প্রতি অবজ্ঞা এবং অবহেলা মানুষকে ব্যথিত, হতবাক এবং পুনঃ পুনঃ তাদের একই আচরণ প্রতিবাদমুখর করে তোলে। ভাষা নিয়ে আন্দোলন জোরদার হয়। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি মানুষের চোখ আরও খুলে দেয়। পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দুর সঙ্গে বাংলাকেও করা হোক—এই দাবিটাও মানা হয়নি তখন। ভাষার দাবিতে প্রাণ উৎসর্গ করল এ দেশের বীর সন্তানেরা। ২১ ফেব্রুয়ারি প্রাণ দিলেন বরকত-রফিক-জব্বার-সালামসহ নাম না-জানা আরও অনেক শহিদ। এভাবেই চলতে থাকে। মোহভঙ্গ হতে থাকে মানুষের। বাংলা ভাষাকে নিয়ে নানা সূক্ষ্ম ষড়যন্ত্রও সে সময় চালানোর চেষ্টা চলে। বাংলাকে বাংলা বর্ণমালায় না লিখে অন্য হরফ দিয়ে লেখা যায় কিনা সে ব্যাপারেও কোনো কোনো অর্বাচীনের তরফে কথা ওঠে। মোটকথা, এই সবকিছুর পেছনের উদ্দেশ্য একটাই, যে কোনো প্রকারে হোক এ দেশের মানুষের ভাষাকে বর্জন করার, তাকে নষ্ট করার চেষ্টা। কিন্তু সেটা কি সম্ভব? সম্ভব হয়নি। মানুষ সম্ভব হতে দেয়নি।

এসবের সঙ্গে নানা ক্ষেত্রে বঞ্চনা যুক্ত হয়ে মানুষের মন বিষিয়ে ওঠে। মানুষ বুঝতে পারে পাকিস্তানি কায়েমি স্বার্থবাদী শাসকগোষ্ঠী এ দেশের মানুষের ন্যায্য অধিকার মেনে নেবে না। তারপর ’৭০-এর নির্বাচনের ফল দেখে ওই কায়েমি শাসকগোষ্ঠী বুঝতে পারে এ দেশের মানুষ অধিকার আদায়ের দাবিতে এক হয়েছে, তারা শুরু করে চক্রান্ত, নানা অজুহাত খাড়া করে। একাত্তরের মার্চে এসে এ দেশের মানুষের আন্দোলন যেন ক্লাইম্যাটে পৌঁছে। ঘোষিত হয় অসহযোগ। আসে ৭ মার্চ। রেসকোর্স ময়দানের ভাষণে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন: এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। তারপর ২৫ তারিখ। তারপরই ২৬।

একের পর এক আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় একাত্তরের স্বাধীনতাযুদ্ধ এসেছে এ দেশের মানুষের জীবনে, আর বিভিন্ন পর্যায়ে ঝরেছে অনেক রক্ত। হারিয়ে গেছে অনেক প্রাণ। বহু কষ্ট, অনেক দুঃখবরণ করতে হয়েছে মানুষকে। সেই রক্ত, অশ্রু, বেদনা, যন্ত্রণার কণ্টকাকীর্ণ পথ পার হয়ে এসেছে এ স্বাধীনতা। এর পেছনে যেমন আছে রক্ত, আছে ত্যাগ, সেই কারণে গোটা এ আন্দোলনের ধারার সঙ্গে জড়িয়ে আছে এ দেশের সাধারণ মানুষ, শ্রমিক-কৃষক, ছাত্র-শিক্ষক, বুদ্ধিজীবীসহ সব শ্রেণি ও পেশার মানুষের বীরত্ব ও সাহসিকতা। আর চূড়ান্ত পর্যায়ে স্বাধীনতাযুদ্ধে দিতে হয়েছে এক সাগর রক্ত। স্বাধীনতার জন্য এ দেশের বীর সন্তানরা হাতে তুলে নিয়েছে অস্ত্র। তারপর জীবনবাজি রেখে যুদ্ধ করে স্বাধীনতাকে নিরঙ্কুশ করেছে। দেশকে মুক্ত করেছে। আজ বিশ্বসভায় আমরা স্বাধীন দেশ। স্বাধীন অন্যান্য জাতির সারিতে আমাদের আসন। আমরা বাস করি স্বাধীন দেশে। আমাদের সামনে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কত সম্ভাবনা। এ স্বাধীনতাই আমাদের জন্য এগিয়ে যাওয়ার এবং নিজেদের দেশকে গড়ে তোলার সুযোগ এনে দিয়েছে।

সেই একাত্তরের পর অনেক বছর পার হয়ে গেছে। দেশকে স্বাধীন করার জন্য যারা প্রাণ দিয়েছেন, তাদের একটা স্বপ্ন ছিল। উন্নত, সুন্দর, সমৃদ্ধ দেশ গড়ার স্বপ্ন। স্বাধীনতার পর এত বছরে অনেক ক্ষেত্রে আমাদের কিছু কিছু উন্নতি হয়েছে এ কথা স্বীকার করার পরও এটা কি অস্বীকার করা যাবে যে শহিদদের স্বপ্ন এখনো বহু ক্ষেত্র ও পর্যায়ে অপূর্ণই রয়ে গেছে। দেশ থেকে এখনো দারিদ্র্য দূর করা সম্ভব হয়নি। নিরক্ষরতা দূর করা সম্ভব হয়নি। স্বাধীনতা পেয়েছি ঠিকই, কিন্তু এ স্বাধীনতার সুফল অর্থনৈতিক মুক্তি এখনো সবার ঘরে পৌঁছেনি। অসৎ পথে হাতেগোনা কিছু লোক ধনসম্পদ গড়ে আখের গুছিয়ে নিয়ে টাকার কুমির হয়ে উঠলেও অগণিত সৎ, খেটে খাওয়া মানুষ এখনো পড়ে রয়েছে বহু দূরে-দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করতে বাধ্য হচ্ছে বিপুলসংখ্যক মানুষ। স্বাধীনতার অর্থনৈতিক সুফল কবে এদের ঘরে পৌঁছবে?

স্বাধীনতার ইতিহাস আমাদের গৌরবের ইতিহাস। দেশের নবীনেরা প্রজন্ম পরম্পরায় এ ইতিহাস নিয়ে গৌরববোধ করবে। এ ইতিহাস নিয়ে দীর্ঘকাল নোংরা খেলা দেখেছে মানুষ। এ ইতিহাসকে বিকৃত করা হয়েছে বারবার। সবচেয়ে দুঃখের বিষয়, এ ইতিহাসের প্রধান মানুষটিকে ছোট করে উপস্থাপনের অনেক চেষ্টা অতীতে দেখে মানুষ ব্যথিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধুকে খাটো করার চেষ্টা সরকারিভাবে করা হয়েছে, এটা মানুষ দীর্ঘদিন ধরে দেখেছে। বড়কে ছোট করার এ চেষ্টা হীনমানসিকতারই প্রমাণ দিয়েছে।

আমাদের স্বাধীনতা এসেছে অনেক প্রাণ, অনেক রক্ত এবং ত্যাগের বিনিময়ে। অগণিত মানুষ অকাতরে জীবন দিয়েছে এ স্বাধীনতার জন্য। তাদের চোখে ছিল স্বপ্ন একটি সুন্দর দেশের, সুন্দর সমাজের। যে দেশে বিচার হবে স্বাধীনতার শত্রুদের, যে দেশে থাকবে মানুষের সর্ববিধ মৌলিক অধিকার, যে দেশে থাকবে না নিরক্ষরতা, থাকবে না ক্ষুধা, অপুষ্টি। যে দেশে অব্যাহত চর্চা হবে সত্যিকার গণতন্ত্রের। স্বাধীনতা ভোগ করছি সবাই। কিন্তু শহিদদের স্বপ্ন কি পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়েছে? সে হিসাবটাই করতে হবে আগে। তাদের স্বপ্নের পূর্ণ বাস্তবায়ন চাই। তাদের জীবনদান-আত্মাহুতি স্বার্থক করতে হবে। সেজন্য চাই তাদের স্বপ্নের পূর্ণ বাস্তবায়নের কাজ। স্বাধীনতার চার দশকে এটাই যেন সবার প্রত্যাশা। (সংকলিত)

লেখক: প্রয়াত সাংবাদিক

নয়াশতাব্দী/ডিএ

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ