প্রতিবছর ২১ মার্চ সারা বিশ্বে আন্তর্জাতিক জাতিগত বর্ণবৈষম্য বিলোপ দিবস পালন করা হয়। ১৯৭৯ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ প্রথম ২১ মার্চকে আন্তর্জাতিক জাতিগত বর্ণবৈষম্য বিলোপ দিবস হিসেবে পালনের ঘোষণা করে এবং এই দিনটি পালনের পেছনে রয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গ মানুষদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া এক মর্মান্তিক ঘটনা।
বর্ণবৈষম্য প্রথম শুরু হয় দক্ষিণ আফ্রিকায়। ১৯৬০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার সার্পভিলে জাতিগত বর্ণবৈষম্যের বিল পাসের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ শান্তিপূর্ণভাবে মিছিলের আয়োজন করে। যেখানে পুলিশ বিনা কারণে নির্বিচারে সাধারণ মানুষের ওপর গুলি চালায়। এ ঘটনায় ৬৯ জন নিরীহ মানুষ প্রাণ হারান এবং ১৭৮ মানুষ আহত হন।
এ ঘটনার পর ১৯৬৬ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ পৃথিবীর সব দেশ থেকে জাতিভেদ ও বর্ণবৈষম্যের মতো ভয়ানক ব্যাধিকে নির্মূল করতে সোচ্চার হয়। এ বিষয়ের ওপর জাতিসংঘ নানা কর্মসূচি শুরু করে। অবশেষে ১৯৭৯ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ প্রথম ২১ মার্চকে আন্তর্জাতিক জাতিগত বর্ণবৈষম্য বিলোপ দিবস হিসেবে পালনের ঘোষণা দেয়।
২০০১ সালে জাতিগত ভেদাভেদ ও বর্ণবাদবিরোধী বিশ্ব সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। পরবর্তীকালে দক্ষিণ আফ্রিকার ডারবান শহরে আবার একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় যার মূল লক্ষ্য ছিল জাতি ও বর্ণের সমস্যাকে দূরীভূত করা এবং নতুনভাবে বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে এক আন্তর্জাতিক প্রতিশ্রুতি নেয়া।
জাতিগত বিদ্বেষ বা বর্ণবাদের বিষবাষ্প তথা বর্ণবৈষম্য এমন এক বিষাক্ত মতবাদ যা যুগে যুগে মানব সভ্যতা এবং মানব ইতিহাসকে কলঙ্কিত করেছে। আধুনিক যুগও এই কলঙ্কজনক মতবাদের ধ্বংসযজ্ঞ থেকে রেহাই পায়নি। লজ্জাজনক হলেও এটা এক জ্বলন্ত বাস্তবতা। সর্বশেষ ২০২০ সালের ২৫ মে জর্জ ফ্লয়েড নামের এক কৃষ্ণাঙ্গ যুবকের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে পুরো আমেরিকা উত্তাল হয়ে উঠেছিল। বিশ্বের নানা প্রান্তে এর ঢেউ লেগেছিল।
হাজার হাজার মানুষ করোনা ভাইরাসের লকডাউন ভেঙে বিশ্বের নানা প্রান্তে রাজপথে নেমে এসেছিল। আমেরিকার মাটিতে রচিত হয়েছিল এক ভিন্ন ইতিহাস। তবে এ ইতিহাস নতুন কোনো ইতিহাস নয়। হঠাৎ করে ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনাও নয়। বহুবার বহুভাবে বর্ণবাদের বিভিন্ন ঘটনা ঘটেছে এ পৃথিবীতে। বহু মানুষ আহত নিহত হয়েছে। কিন্তু ইসলামে বর্ণবাদী আচরণের কোনো স্থান নেই। সাদা-কালোয়, ধনী- গরিবে, উঁচু-নিচুতে এবং বংশ-জাতির বিবেচনায় কোনো তারতম্য কিংবা শ্রেষ্ঠ-নিকৃষ্টের পার্থক্য করেনি ইসলাম এবং এগুলোকে ভালো-মন্দের কোনো মানদণ্ড হিসেবেও নির্ধারণ করেনি।
বর্ণবাদ বলতে আসলে সেই দৃষ্টিভঙ্গি, চর্চা এবং ক্রিয়াকলাপ বুঝায় যেখানে বিশ্বাস করা হয় যে মানুষ অনেকগুলো গোষ্ঠীতে বিভক্ত এবং একই সঙ্গে বিশ্বাস করা হয় কোনো কোনো গোষ্ঠী অন্য গোষ্ঠীর চেয়ে নির্দিষ্ট কিছু বৈশিষ্ট্যের জন্য উঁচু অথবা নিচু; কিংবা তার ওপর কর্তৃত্ব করার অধিকারী; অথবা বেশি যোগ্য কিংবা অযোগ্য।
আসলে কোনো জনগোষ্ঠীর প্রতি গাত্রবর্ণের কারণে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে বৈষম্যমূলক আচরণের নীতিকেই বর্ণবাদ বলে। বর্তমান সময়ে শুধু গাত্রবর্ণের মধ্যেই বর্ণবাদ সীমাবদ্ধ নয়; বরং শ্রেণি, জাতি, দেশ ও ধর্ম বিশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতেও এমনটি পরিলক্ষিত হয়। বর্ণবাদ সমাজ শোষণের এক জঘন্যতম হাতিয়ার।
বর্ণবাদ মানুষ ও মানবতার জন্য এক ধরনের বড় শত্রু। এ বর্ণবাদ মানুষকে শুধু ছোট করে না, অপমানও করে; শ্রেণিবৈষম্য সৃষ্টি করে। অথচ সৃষ্টির সেরা মানুষ বর্ণ-ধর্ম-ভাষা ও যে কোনো গোষ্ঠীবাদের ঊর্ধ্বে বিধাতার সৃষ্টি বৈচিত্র্যের অনন্য অংশ। তাই এটা নিয়ে যে কোনো ধরনের বাড়াবাড়ি অত্যন্ত গর্হিত কাজ।
মানবাধিকাররের বড় বড় বুলি আওড়ানো আমেরিকাতে যুগ যুগ ধরে শুধু চামড়া সাদা না হওয়ার কারণে আমেরিকার নাগরিক হওয়ার পরেও কালোরা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হয়ে জীবনযাপন করছে। শুধুমাত্র আফ্রিকান বা কালো চামড়ার মানুষই নয় এশীয়, চাইনিজসহ সব ধরনের মানুষ সেখানে নাগরিকত্ব পেয়েও সব জায়গাতেই নিপীড়িত হচ্ছে শুধু চামড়া সাদা না হওয়ার কারণে।
আর যাদের চামড়ার রঙ সাদা নয় আবার নাগরিকত্বও পাননি, তাদের অবস্থা কতটা ভয়াবহ তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। জীবনের সব ক্ষেত্রে সাদা বাদ দিয়ে অন্যান্য গায়ের রঙয়ের মানুষ বৈষম্যের শিকার হচ্ছে তারই ফলাফল আমরা বিগত কয়েক দিনের আমেরিকাতে সংঘঠিত হওয়া আন্দোলনের মাধ্যমে দেখতে পাই।
দাসত্ব প্রথার বিলুপ্তি ঘটলেও শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদ, ঘৃণা ও প্রতিহিংসার সংস্কৃতি থেকে আমেরিকা কখনো বেরিয়ে আসতে পারেনি। গৃহযুদ্ধে বিজয় লাভের পর আব্রাহাম লিঙ্কন ১৮৬৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে আমেরিকায় দাসপ্রথা নিষিদ্ধ করেন এবং দাসদের মুক্তির ঘোষণা দেন। দাসপ্রথার সমর্থকরা পরাজিত হলেও ভিতরে ভিতরে সক্রিয় ছিল।
তারা ১৮৬৫ সালে আব্রাহাম লিঙ্কনকে গুলি করে হত্যা করে। আব্রাহাম লিঙ্কনের শতবছর পর কৃষ্ণাঙ্গ নেতা মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের নেতৃত্বে গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে আমেরিকায় কালোদের মানবাধিকার ও রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে সিভিল রাইটস মুভমেন্ট গড়ে ওঠে। ১৯৬৩ সালে লিঙ্কন মেমোরিয়ালের সামনে লাখ লাখ মানুষের উপস্থিতিতে কিং তার বিখ্যাত ‘আই হ্যাভ অ্যা ড্রিম’ ভাষণ দেন।
এরপর লুথার কিংয়ের আন্দোলনের ফলে ১৯৬৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রে নাগরিক অধিকার আইন ও ১৯৬৫ সালে ভোটাধিকার আইন প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু লুথার কিং বেশিদিন বেঁচে থাকতে পারেননি। ১৯৬৮ সালের এপ্রিলে শ্বেতাঙ্গ উগ্রপন্থি সন্ত্রাসীদের গুলিতে লুথার কিং নিহত হন।
বর্তমান বিশ্বে অন্যতম সমস্যা হচ্ছে বর্ণবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা। অত্যন্ত উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করা যাচ্ছে, বৈষম্য ও বর্ণবাদ দূরীকরণের ব্যাপারে জোর প্রচেষ্টা চালানো সত্ত্বেও বিশ্ব থেকে এখনো বৈষম্য ও বর্ণবাদের অবসান হয়নি। এমনকি এ বর্ণবাদের কারণেই বিশ্বব্যাপী অনেক মানুষকে প্রাণ হারাতে হচ্ছে। এক্ষেত্রে বিশ্বের নন্দিত রাষ্ট্রনায়কদের একজন দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা।
দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদের অবসান ঘটিয়ে বহু বর্ণভিত্তিক গণতান্ত্রিক কাঠামো প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি। আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব, প্রখর রসবোধ, তিক্ততা ভুলে বৈরী প্রতিপক্ষের দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেয়ার মতো বর্ণাঢ্য জীবন কাহিনি তাকে পরিণত করেছিল এক জীবন্ত কিংবদন্তিতে।
দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদী শাসনের অবসান ঘটলেও আজও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বর্ণবাদের অবসান ঘটেনি। ইসলামবিদ্বেষী সার্বদের হাতে আধুনিক যুগেই নিহত হয়েছে প্রায় দুই লাখ বসনিয় মুসলমান। আর এতে পরোক্ষ সহায়তা ছিল ইসলামবিদ্বেষী পশ্চিমা শক্তিগুলোর। তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী জন মেজর তো প্রকাশ্যেই ঘোষণা করেছিলেন যে ‘ইউরোপে এক নতুন মুসলিম রাষ্ট্রের উদ্ভব সহ্য করা হবে না’।
ফলে সেখানকার মুসলমানদেরকে ডেইটন চুক্তির মাধ্যমে সার্ব-ক্রোয়াট ও বসনিয় মুসলিম ফেডারেশনের যৌথ শাসনের আওতায় রাখা হয়েছে। গণহত্যার মূল ঘাতক ও দোসরদের দেয়া হয়নি যথাযথ শাস্তি। যে বর্ণবাদী নীতির কারণে বসনিয় মুসলমানদের একক নেতৃত্বাধীন রাষ্ট্রকে সহ্য করেনি পাশ্চাত্য সেই একই কারণে তুরস্ককেও ইউরোপীয় জোটের সদস্য করতে রাজি হচ্ছে না ইউরোপ।
যুগ যুগ ধরে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বর্ণবৈষম্য দূরীকরণে আন্দোলন হয়েছে। আইন হয়েছে, হয়েছে নানা নীতিমালা ও বিভিন্ন কমিশন। কিন্তু কেন থামছে না এই সাদা-কালোর বৈষম্য ও ভেদাভেদ। অথচ ইসলামে কোনো বর্ণবৈষম্য নেই। বর্ণবাদ বা বর্ণবৈষম্যকে কোনোভাবেই সমর্থন করে না ইসলাম। বর্ণবাদকে নির্মূল করে আদর্শ রাষ্ট্র ও সমাজ প্রতিষ্ঠার অনন্য এক উদাহরণ প্রতিষ্ঠিত করেছেন মানবতার মুক্তির দূত নবী মুহাম্মাদ (সা.)। তাই তো আমরা হাবশী কৃতদাস হজরত বিলালকে (রা.) ইসলামের প্রথম মুয়াজ্জিনরূপে দেখতে পাই।
কোরআনে কারিমের অসংখ্য আয়াতে এবং হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) অনেক হাদিসে বর্ণবাদিতাকে নিষেধ করেছেন। এমনকি হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বিদায় হজের ভাষণে বলেছেন, হে লোক সকল, তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তিই আল্লাহর কাছে অধিকতর সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী, যে তোমাদের মধ্যে অধিক তাকওয়া অবলম্বন করে, সব বিষয়ে আল্লাহর কথা অধিক খেয়াল রাখে। ধর্ম বিশ্বাস, গাত্রবর্ণ, শক্তি ও বংশের অহংকারবশত কোনো ব্যক্তি বা জাতি কর্তৃক নিজেদের শ্রেষ্ঠ বলে দাবি করাকে ইসলাম প্রত্যাখ্যান করে।
সাম্প্রদায়িকতা ও বর্ণবাদকে ইসলাম কোনোভাবেই সমর্থন দেয় না। কোরআন কঠোরভাবে মানুষের মধ্যকার সমতাকে নিশ্চিত করেছে। কোরআনে কারিমে ইরশাদ হচ্ছে, হে মানবমণ্ডলী, নিশ্চয়ই আমি তোমাদের একজন নারী ও একজন পুরুষ থেকে সৃষ্টি করেছি এবং বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যাতে তোমরা পরস্পরে পরিচিত হও। নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালার কাছে সে-ই সর্বাধিক সম্ভ্রান্ত, যে সর্বাধিক পরহেজগার। নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা সর্বজ্ঞ ও সব কিছুর খবর রাখেন। (সুরা হুজরাত ১৩)।
অহংকার থেকেই মূলত হিংসা, বিদ্বেষ ও বর্ণবাদের সৃষ্টি হয়। মহান আল্লাহ বলেন, নিঃসন্দেহে আল্লাহ অহংকারীদের পছন্দ করেন না (সুরা নাহল, আয়াত: ২৩) এবং রাসুল (সা.) বলেন, যার অন্তরে বিন্দু পরিমাণ অহংকার থাকবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না (মুসলিম শরিফ)। বিশ্ববাসীকে আজ এমন এক শিক্ষা নিতে হবে, যাতে করে দুনিয়ায় আর বর্ণবাদ নামের কোনো কিছুর অস্তিত্ব না থাকে। আর এক্ষেত্রে ইসলামের উত্তম শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত। ইসলামের কোনো বিধানই বর্ণবাদের দায়ে দুষ্ট নয়। বিশ্ব বর্ণবৈষম্য নির্মূল দিবসে বিশ্ববাসীকে এই ঘৃণ্য তৎপরতা নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। বর্ণবাদী আচরণ বন্ধে সবাইকে আন্তরিক হতে হবে।
লেখক: ব্যাংকার ও কলাম লেখক
নয়া শতাব্দী/আরজে
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ