একটি তিক্ত অভিজ্ঞতার আলোকে নিবন্ধটি শুরু করা যাক। বছর পাঁচেক আগের ঘটনা; যশোর থেকে ঢাকা যাত্রাকালে পথিমধ্যে জোহরের নামাজের জন্য ২০ মিনিট যাত্রা বিরতি। বৈশাখের তপ্ত দুপুরে যাত্রী পূর্ণ গাড়ির মধ্যে অসহনীয় (প্রায় হিট স্ট্রোক পর্যায়ের) গরম। গাড়িতে শিশু, বৃদ্ধ এবং অসুস্থ যাত্রীও আছে। গরমের তাণ্ডবে সবারই নাভিশ্বাস চরমে।
উক্ত সময়ের মধ্যে অন্যরা নামাজ শেষ করে ফিরে আসলেও একজন যাত্রী তখনো আসেননি। সবাই অধির অপেক্ষমাণ। বুঝতে পারলাম, এখানে নামাজের ইস্যু বলে ড্রাইভার ভয়ে লোকটিকে বাদ রেখে গাড়ি ছাড়ছে না। ৫০ মিনিট পর কথিত ধর্মীয় লেবাসে (ধর্মের কোনো সুনির্দিষ্ট লেবাস হয় না) একজন মধ্যবয়সি পুরুষ যাত্রী বেশ ধীরপায়ে অলস ভঙ্গিতে গাড়ির দিকে আসছেন। গাড়িতে ওঠার পর আমি তাকে বিনয়ের সঙ্গে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ভাই আপনার আসতে এত দেরি হলো যে...?।
আপনার দেরির কারণে গাড়িতে আমরা সবাই গরমে কাতরাচ্ছি। বেশ অহং এর ভঙ্গিতে উত্তর দিলেন, ‘আমি নামাজে ছিলাম।’ বললাম, ‘ব্যক্তিগত ইবাদতের অজুহাতে এতগুলো মানুষকে কষ্ট দেয়া কি ইসলাম বরদাশত করে?’ লোকটি হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে চিৎকার করে বললেন, ‘নামাজের জন্য গাড়িটি প্রয়োজনে সারাদিন দাঁড়াবে; প্রয়োজনে পৃথিবীকে স্তব্ধ করে দিয়ে নামাজ আদায় করতে হবে!’ তার ক্ষিপ্রতায় আমি ভিরমি খেয়ে গেলাম।
ভিতরের সবাই তার দিকে হতভম্ব দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। তার সার্বিক আচরণে সবাই মনঃক্ষুণ্ন্ন হলো কিন্তু কেউ-ই জিজ্ঞসা করার সাহস পেল না, কেননা, নামাজ বলে কথা! আমি বললাম, আপনাদের মতো কিছু ধর্মান্ধদের কারণেই সমাজে ইসলাম বিতর্কিত হচ্ছে। আমি তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) এর বৈচিত্র্যময় জীবনের কিছু মহামানবিক ঘটনাবলি ও কোরআনের কিছু দ্ব্যর্থহীন আয়াত বা বাক্য তাকে অনুরোধক্রমে শুনালাম যেগুলোতে সন্দেহাতীতভাবে প্রতীয়মান হয় যে ইসলাম একটি পশুরও শান্তির নিশ্চয়তা বিধান করে অর্থাৎ কাউকে কষ্ট দিয়ে ধর্ম পালন করা, চূড়ান্ত ভাবেই পবিত্র ইসলামের মহান আদর্শের পরিপন্থি। তিনি আমার কথাগুলো শুনে নিবৃত্ত ও অনুশোচিত হলেন। অনুনয়বোধে তিনি বিনয়াবনত হলেন।
বললেন, ইসলামের এমন মধুর বাণী এমন সাবলীলভাবে তিনি আগে কখনই শোনেননি। তিনি জানতে চাইলেন, আমি ইসলাম বিষয়ে পড়াশোনা করা কোনো টাইটেল বা পদবিধারী গবেষক কিনা। আমি না বললাম। তিনি কিছুটা অবাক দৃষ্টিতে আমার ক্লিন্ড সেভ মুখের দিকে চেয়ে রইলেন। আমার কোনো ধর্মীয় লেবাসও নাই। লোকটি কোনো হিসাব মেলাতে পারছিলেন না। আমি বুঝতে পারলাম যে কোনো পদবি ও লেবাস ছাড়াই ইসলামি বিষয়ে আমার এমন তাথ্যিক ও তাত্ত্বিক ধারণা তাকে অনেকটা দ্বিধাদ্বন্দ্বে ফেলেছে। আমাদের সমাজের এই অপুষ্ট মনোস্তত্ত্ব বেশ বিরাজমান যে, একজন লেবাসধারী ও শাস্ত্রীয় পদবিধারী ব্যক্তিই শুদু ধর্মীয় বিষয়ে জ্ঞান রাখে।
বিস্ময় হলো, তার ভ্রান্ত এবং বিকৃত বিবৃতিও (যদি ঘটে) সমাজের সাধারণ মানুষ সঠিক বলে মনে করে। এর বাইরের ব্যক্তিরা সঠিক বললেও বিশ্বাসযোগ্য হয় না। গভীর পর্যবেক্ষণে দেখা যায়- সমাজের উচ্চ শিক্ষিত, ক্যারিয়ার সম্পন্ন ও বিত্তশালী ব্যক্তিরা এদের উপস্থাপনাগুলো অনেকটা অন্ধের মতো সমর্থন করে। কোনো বাছবিচার ছাড়াই বিশ্বাস করে এই ভেবে যে, কথাগুলো ধর্ম সংশ্লিষ্ট লেবাসীবক্তা বলেছেন। এই প্রবণতাকে ইন্টেলেকচুয়্যাল ধর্মান্ধতাও বলা যেতে পারে।
কোরআনে বর্ণিত, ‘বস্তুত চোখ তো অন্ধ হয় না; অন্ধ হয় তাদের বক্ষস্থ হূদয়’ (সুরা হজ্জ, আয়াত: ৪৬)। এভাবে বহু নির্দেশ ও উপদেশের মাধ্যমে চিন্তা ও জ্ঞানকে ইসলামে উৎসাহিত করা হয়েছে। অর্থাৎ সুচিন্তাপ্রসূত জ্ঞান ছাড়া ধর্ম পালন ধর্মান্ধতা যা কখনই কোনো ধর্ম সমর্থন করে না। আমি তাকে আরবির পাশাপাশি মাতৃভাষা বাংলায় কোরআন পড়তে পরামর্শ দিলাম। পরিচয়ে জানলাম তিনি একজন ঈমাম। মানিকগঞ্জের একটি ওয়াজ মাহফিলে বক্তা হিসেবে যোগদান করতে যাচ্ছেন। আমাকে তিনি অনুরোধে নিমন্ত্রণ দিলেন উক্ত অনুষ্ঠানে আলোচক হিসেবে তার সঙ্গে যাওয়ার জন্য।
উল্লেখিত বাস্তবতা বিবেচনায় আমি তার প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলাম। কেননা, আমি জানি, ধর্মীয় লেবাস ও শাস্ত্রীয় পদবি না থাকার কারণে আমার সব কথা উপস্থিত দর্শক-শ্রোতার মাঝে খুব স্বাভাবিকভাবেই আষাঢ়ে গল্পে পরিণত হবে। অথচ লেবাস, পদবি, ক্যারিয়ার জ্ঞান অর্জন ও চর্চার ক্ষেত্রে চূড়ান্তভাবে শর্তযুক্ত নয়। এক শ্রেণির কথিত স্কলার আছে যাদেরকে ধর্ম ব্যবসায়ী বললে অত্যুক্তি হবে না, এরা সৃজনশীল চিন্তার যে কোনো প্রগতিশীল মানুষের বিশুদ্ধ ধর্ম চিন্তাকে ভর্ৎসনা করতেও ন্যূনতম দ্বিধা করে না। এমনকি এদেরকে মাঠে ময়দানে ও সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশ্যে ট্রল করতেও দেখা যায়।
পাশাপাশি এরা অনেক সময় হিংসা, ঈর্ষা ও পরশ্রীকাতরতায় ভয়ঙ্কর ক্রোধান্বিত হয়ে নিজেরাই পরষ্পরকে দোষারোপের আগুনে পুড়িয়ে মারে। তারা প্রকাশ্যে একে অপরকে কাফের, মুরতাদ, মুনাফিক, মুশরেক, গাফেল প্রভৃতি ঘৃণ্য বিশেষণে বিশেষায়িত করে থাকে। ১ ডিসেম্বর ২০১৮ সালে টঙ্গীস্থ বিশ্ব ইজতেমার মাঠ দখলকে কেন্দ্র করে মাওলানা সাদ ও মাওলানা জুবায়ের গ্রুপের মধ্যে সংঘটিত ভয়ঙ্কর রণদৃশ্য সমগ্র বিশ্ব ঘৃণাভরে দেখেছে। এগুলো নিশ্চয় ইসলামের শিক্ষা নয়।
তারপরেও তাদের অসংখ্য অনুসারী দেখা যায়। অসংখ্য শিক্ষিত-উচ্চ শিক্ষিত মানুষও তাদের বচন শুনতে ময়দানে নিমগ্ন থাকে। ঢাকা শহরে অনেক সময় ব্যস্ত সড়ক দখল করে চরম জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করে জুমার নামাজ পড়ানো হয়। অনেক মুমূর্ষু রোগীও তখন অমানবিক ভোগান্তির শিকার হয়। সেখানে এলিট সোসাইটিরও অনেকেই সমবেত হয়। এটা নিশ্চয় ধর্মীয় মূল্যবোধ হতে পারে না। বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে জনদুর্ভোগ সৃষ্টিকারীদের অনেকেই হাজি-মুসল্লি!
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ও প্রশাসন কর্তৃক অভিযান চলাকালে ‘নামাজে আছে’ নোটিশ কার্ড লাগিয়ে পেছনের দরজা দিয়ে এদের পালাতে দেখেছি। কুচক্রী মহল কর্তৃক হীনস্বার্থ চরিতার্থে সরকারি খাস অথবা ব্যক্তি মালিকানাধীন জমি দখল করে মসজিদ-মাদ্রাসা বানানোর নামে ধর্মকে অপব্যবহার করার অপ্রিয় উদাহরণও এ সমাজে কম নয়। উচ্চ শব্দে ওয়াজের মাধ্যমে অবলীলায় শব্দদূষণ চলে। আশপাশে অসুস্থ, বয়স্ক ও শিশুদের স্বাস্থ্যহানি ঘটে। শিক্ষার্থীদের পড়াশোনারও ব্যাপক ক্ষতি হয়। অন্যদেরও নিদারুণ দুর্ভোগ পোহাতে হয়।
এ বিষয়ে ওয়াজিদের ন্যূনতম কোনো মমতা জাগে না। অফিস পাড়াতে একশ্রেণির চাকরিজীবীরা নামাজের নামে প্রয়োজনীয় সময়ের চেয়ে অতিরিক্ত সময় ব্যয় করছে। এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটি সরকারি হলে তো কথাই নেই। ভয়ে হস্তক্ষেপের সুযোগ নাই। কেননা, নামাজ বলে কথা। এভাবে ধর্মের দোহাই দিয়ে একশ্রেণির কর্মবিমুখ মতলববাজ ও দুর্নীতিবাজরা তাদের হীনস্বার্থ চরিতার্থ করছে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সেবাপ্রত্যাশী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। মসজিদ-মাদ্রাসায় একশ্রেণির মোল্লারা নিষ্পাপ শিশু ও নারী বলাৎকার ও ধর্ষণ করছে। বিনষ্ট হচ্ছে ধর্মের পবিত্রতা।
দূষিত হচ্ছে সামাজিক সভ্যতা; এ ধরনের জঘণ্য-ঘৃণ্য অপকর্মের বিরুদ্ধে সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে কেউ কোনো প্রতিবাদ করছে না ভয়ে। এমনকি সুশীল শ্রেণিরাও সরব হচ্ছে না। কেননা, ইস্যুগুলো ধর্মের বলয়ে সংঘটিত। তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিও হচ্ছে না। ফলে, এসব চরম গর্হিত কর্ম একের পর এক ঘটে যাচ্ছে। অধিকাংশ ঘটনা প্রকাশের চেয়ে অপ্রকাশেই থেকে যাচ্ছে। কেননা, এদেশের ধর্মান্ধ ও সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীরা জোটবদ্ধ। এদের বিরুদ্ধে ভয়ে কেউ মুখ খোলে না, প্রতিবাদ তো দূরের কথা। কেননা, প্রতিবাদকারীকে রাষ্ট্র নিরাপত্তা দিতে পারবে কিনা তা নিয়ে জনমনে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। সম্প্রতি ভিকারুননিসা নূন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক মুরাদের যৌন কেলেঙ্কারির ঘটনায় তদন্ত কমিটি তার হজ পালনের অজুহাত দেখিয়ে তাকে চাকরি থেকে বহিষ্কার না করার সুপারিশ করেছে। এখানেও ধর্মের অপব্যবহার ঘটেছে। প্রগতিশীল সমাজ হলে এহেন সাম্প্রদায়িক কূটকৌশলের দায়ে তদন্ত কমিটিকেও বিচারের আওতায় হয়তো পড়তে হতো।
কিন্তু এখানে তা হয়নি। এ জাতীয় অন্যায্যতার ফলে সমাজে ধর্মান্ধতা ও সাম্প্রদায়িকতার ঔদ্ধত্য দিন দিন তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। এর রেশ কাটতে না কাটতেই মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখান উপজেলায় বিদ্যালয়ের শিক্ষক রুমিয়া সরকার হিজাব না পরার কারণে ৯ ছাত্রীর চুল কেটে দিয়েছে যে ঘটনার মাধ্যমে ধর্মান্ধতার হিংস্র রুপ চরমভাবে প্রকাশ পেয়েছে।
ধর্মান্ধতা ও সাম্প্রদায়িকতার বিষাক্ততায় হূদয় কৃষ্ণ মণ্ডল, আমোদিনী পাল, স্বপন কুমারদের মতো প্রগতিশীল শিক্ষকদের চরম নির্যাতিত হতে হয়েছে। শিক্ষক লতা সমাদ্দারকে দিবালোকে প্রকাশ্যে সরকারি ইউনিফর্মধারী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীর দ্বারা জনসমক্ষে ট্রলের শিকার হতে হয়েছে। উল্লেখ্য, ২০২৩ সালের ২৯ এপ্রিল বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হামিদ খানের গার্ড অব অনার প্রদানে নারী ইউএনও ফারজানা আলমকে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী কর্তৃক কথিত শরিয়াবিরোধী অপবাদে ‘বেয়াদব’ ভর্ৎসনার শিকার হতে হয়েছিল।
এখানেও ধর্মকে সাম্প্রদায়িক অপরাজনীতির কূটকৌশল হিসেবে অপব্যবহার করা হয়েছে। এ ঘটনায়ও জাতি একজন বিশেষ বীর মুক্তিযোদ্ধা কর্তৃক মহান মুক্তিযুদ্ধের ধর্মনিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক নীতির করুণ অবক্ষয় কষ্টভারাক্রান্ত চিত্তে অবলোকন করেছে। বস্তুত ধর্মান্ধতা ও সাম্প্রদায়িকতার মাধ্যমে ধর্মের অপব্যবহার ঘটে ও ধর্মের পবিত্রতা বিনষ্ট হয়।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, গোটা সমাজ এখন ধর্মান্ধতা ও সাম্প্রদায়িকতার নীল বিষে আক্রান্ত! এ বিষ থেকে সমাজকে দ্রুত মুক্ত করতে না পারলে ধর্মনিরপেক্ষ তথা অসাম্প্রদায়িক ও মানবিক বাঙালি চেতনার অপমৃত্যু অবধারিত! ফলে ভবিষ্যতে অস্তিত্ব সংকটে পড়তে পারে রক্তের প্রস্রবণে কেনা প্রিয় বাংলাদেশ। ভূলুণ্ঠিত হতে পারে ধর্মের সর্বজনীন মাহাত্ম্য। এ বিষ মুক্তকরণের মন্ত্র ও ওঝা কোথায়?
লেখক: কলাম লেখক
নয়া শতাব্দী/আরজে
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ