আমার বাসা বিমানবন্দর সড়কের পাশে। ফলে রাস্তার হর্ন ও অন্যান্য শব্দ বায়ুস্তর ভেদ করে বাসার ভেতর ঢুকে পড়ে। আমি ঢাকার রাস্তায় গাড়ি চালাই। রাস্তায় বের হলে নিত্যদিন দেখি অন্যান্য গাড়ি ও পথচারীদের মধ্যে বিরামহীন এক প্রতিযোগিতা কে কার আগে যাবে, কে কাকে টপকে যাবে।
এ টপকানোর কাজ করতে গিয়ে ট্রাফিক নিয়মকানুনকে পরোয়া তো করেই না, এমনকি সাধারণ বিদ্যাবুদ্ধি শিষ্টাচার কোনো কিছুই কারো মধ্যে কাজ করে না। সবাই যেন দৌড়াচ্ছে সামনে এগিয়ে যেতে। অন্ধ হয়ে দৌড়াচ্ছে। অন্যকে পদদলিত করতে না পারলে এ যাত্রায় এগিয়ে যাওয়ার যেন সুযোগ নেই।
আমরা এমন এক সমাজ নির্মাণ করে ফেলেছি যেখানে সবাই মিলে সবার কল্যাণের জন্য কিছু করার জায়গা নেই। এ সমাজে সবাই সবার প্রতিযোগী। যেন আমরা জঙ্গলে বাস করছি। যে যত বেশি শক্তিশালী, যে যত বেশি বেপরোয়া, যে যত বেশি হিংস্র, সে তত টিকে থাকবে। এ সমাজে আইন নেই। যা আছে তা কাগজে কলমে। আর সেটুকু আইন ভাঙার মধ্যেই যেন শ্রেষ্ঠত্ব নিহিত। সমাজে কে শ্রেষ্ঠ? মাপকাঠি কি? মাপকাঠিটা হয়ে গেছে নিয়ম ভাঙার মধ্যে।
যে যত বেশি নিয়ম ভাঙতে পারে, সে তত বেশি ক্ষমতাধর, সে তত বেশি স্মার্ট। শ্রেষ্ঠত্বের বিচারে সে তত এগিয়ে। অভিভাবকরা এখন সে সন্তানকে বেশি আদর করে যে মাস্তান। যে ঠিক-বেঠিক সব কাজ করতে পারবে। যে ছোট বোনকে স্কুলে ভরতি করিয়ে দিতে পারে, ছোটো ভাইয়ের চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে পারে। রাস্তা থেকে ইলেকট্রিক সংযোগ এনে দিতে পারে। টেলিফোন সংযোগ নিশ্চিত করতে পারে। পড়শির দেয়াল দু-ফুট দূরে ঠেলে দিতে পারে। রাজউক থেকে একদিনে নকশা অনুমোদন করিয়ে দিতে পারে। সে সন্তান নমস্য যে এর-ওর চাকরি করিয়ে দিতে পারে। এর-ওর বদলির তদবির করতে পারে। পদোন্নতির তদবির করতে পারে।
আমাদের দেশে সে বড় শিল্পপতি যে বড় ঋণ খেলাপি। সে বড় ধনবান যে দেশের বাইরে টাকা পাচার করে। সে বড় প্রতিপত্তিশালী যে আইন নিজের হাতে নিতে পারে। এ দেশে অযোগ্যরা পদ দখল করে আছে।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা এক-একজন একেকভাবে সংবাদের শিরোনাম হচ্ছেন। তিতাসের লাইনম্যান হয়ে যান শত কোটি টাকার মালিক। বিদ্যুতের মিটার রিডারের থাকে দশ-বারোটা অ্যাপার্টমেন্ট। ক্ষমতা দেখাতে নিজ গাড়ির আয়তন বাড়াতে তৎপর সবাই। কি অসুস্থ প্রতিযোগিতা!
মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। হয়তো ভুলে যাই মুক্তিযুদ্ধে গৌরবের পাশাপাশি গ্লানির ইতিহাসও আছে। যুদ্ধের সুযোগে মানবতা বিরোধী অনেক অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। হত্যা, গণহত্যা, খুন, প্রতিশোধপরায়ণতা, অত্যাচার, নির্যাতন, ধর্ষণ, লুট, বাড়িঘরে অগ্নি সংযোগ। দুর্ভাগ্যজনক, এসব অপরাধের কোনো বিচার হয়নি। কোনো আদালত এসব অপরাধ নথিভুক্ত করেনি। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়েছে অনেকে। পরবর্তীতে দেশে সামরিক অভ্যুত্থান হয়েছে।
সামরিক আইন জারি হয়েছে। সামরিক বাহিনী বেআইনিভাবে ক্ষমতা দখল করে রেখেছে। কেবল অস্ত্রের জোরে, কেবল গায়ের জোরে, এভাবে বছরের পর বছর সমাজে আধিপত্য চালিয়ে গেছে। সামরিক বাহিনীর লোকজনদের বেসামরিক চাকরিতে নিয়োগ দিয়েছে। অবসর নেওয়ার পর লাভজনক পদে আসীন হয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্য দখল করেছে। কারও কাছে সামরিক বাহিনীকে জবাবদিহি করতে হয়নি। এমনকি পরে যখন বেসামরিক শাসন বলবৎ হয়েছে তখন সামরিক শাসন চলাকালীন সময়ের সব সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপকে আইনানুগ বলে ঘোষণা করেছে।
ফলে, সমাজ বুঝে গেছে, ক্ষমতায় যাওয়ার এবং ক্ষমতায় থাকার এই-ই পথ। গায়ের জোর, অস্ত্রের জোর। ফলে রাজনীতি বিষাক্ত হয়েছে, কলুষিত হয়েছে। সমাজ-অর্থনীতি-সংস্কৃতি সবকিছু বিষাক্ত হয়েছে। মানুষের আদর্শ বদলে গেছে। অনেক বড় বড় হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়নি। এমনকি জাতির পিতাকে হত্যাকাণ্ডের বিচারের পথ রুদ্ধ করে রাখা হয়েছিল সংবিধানে ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স অন্তর্ভুক্ত করে।
১৯৯৬ সাল পর্যন্ত কোনো সরকার এ ইনডেমনিটি আদেশ রদ করেনি। ফলে ১৯৭৫ সালের নারকীয় হত্যযাজ্ঞের জন্য বিচার কেন, কোনো অভিযোগও দায়ের করা যায়নি। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে প্রথম সুযোগে জাতীয় সংসদে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করে। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হয়। অন্যান্য অনেক হত্যকাণ্ডও বিচারের আওতায় আসে। এরপর ২০০১ সালে ক্ষমতার পালাবদল হলে আবার সে বিচার স্থবির হয়ে পড়ে।
২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার সময় আওয়ামী লীগ বারবার বলেছে অপরাধের বিচার হবে। দায়মুক্তির সংস্কৃতি বন্ধ করা হবে। আওয়ামী লীগের সভায় গ্রেনেড হামলার বিচার হয়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার শুরু হয়। বিবেকবান মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করে, অপরাধী যেই হোক, তাকে আইনের আওতায় আসতে হবে। কিন্তু সমাজ থেকে অপরাধের সংস্কৃতি যায়নি। কোথাও কোথাও ন্যায়বিচার আটকে যায়।
আইন যেন আইন প্রতিষ্ঠার প্রতিই অন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আমাদের সমাজে জবাবদিহিতা, স্বচ্ছতা, সুশাসন, আইনের শাসন— এখনো কোনোটাই প্রতিষ্ঠিত হয়নি। পরস্পরের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা ও সম্মানবোধ দিন দিন কমছে। আমরা অসম্ভব অসহনশীল হয়ে পড়ছি।
আমাদের প্রধান রপ্তানিখাত তৈরি পোশাক শিল্প। এখানে শ্রমিকদের প্রতি বঞ্চনা তো আছেই, উপরন্তু যোগ হয়েছে কারখানায় অগ্নি দুর্ঘটনা। তাজরীন গার্মেন্টসে অগ্নি দুর্ঘটনা এবং সাভারের রানা প্লাজা নামের এক কারখানা ভবন ধসে পড়ে বহু শ্রমিকের হতাহতের ঘটনায় তৈরি পোশাক শিল্পের রপ্তানি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে।
সরকার বিভিন্নভাবে জোড়াতালি দিয়ে সে ক্ষত মোচনের চেষ্টা করেছে। কিন্তু অবস্থার বড় কোনো পরিবর্তন হয়নি। পরিস্থিতির অল্প যেটুকু উন্নতি হয়েছে, তার তুলনায় পোশাক শিল্পের ক্ষতি হয়েছে বিস্তর। সেসঙ্গে ধূলিস্মাৎ হয়েছে দেশের ভাবমূর্তি। দুঃখজনক, সংশ্লিষ্ট কারুরই সম্ভবত শিক্ষা হয়নি। তাজরীনের মতো বড় অগ্নিকাণ্ড অন্য কোনো কারখানায় হয়নি, সত্য, তবে পোশাক কারখানাগুলো এখনো অগ্নি ঝুঁকির ঊর্ধ্বে না। কারখানার পাশাপাশি বঙ্গবাজার, কাঁচাবাজার ও বস্তিতে আগুন ধরেছে। নতুন যোগ হয়েছে উঁচু ভবনের অগ্নিকাণ্ড।
কাওরান বাজারে ইস্পাত শিল্প সংস্থার ভবনে আগুন ধরেছিল। বহু বছর আগের কথা। আগুন থেকে বাঁচতে অনেকে সে ভবন থেকে লাফিয়ে পড়েছিলেন নিচে। আগুন থেকে বেঁচেছিলেন তারা, কিন্তু তা জীবনের বিনিময়ে। একই ঘটনা ঘটেছে কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউয়ের এক ভবনে। এরপর পুরোনো ঢাকায়। অল্প কিছুদিন আগে বেইলি রোডের এক রেস্টুরেন্ট ভবনে। আগুনে প্রাণহানি অগণিত। মরেছে সর্বস্তরের মানুষ। কে প্রভাবশালী, কে সেলিব্রিটি, কে বিত্তশালী, আগুন তার কিছুই বিচার করেনি। প্রতিটা ঘটনা ঘটার পর তদন্ত হয়েছে, ত্রুটি শনাক্ত হয়েছে।
কিন্তু সে ত্রুটি দূর করার জন্য কখনো কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। পোশাক কারখানাগুলোতে অনেকরকম পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে আমদানিকারকদের সন্তুষ্ট করতে। অন্যত্র, যেহেতু বিদেশি কাউকে সন্তুষ্ট করতে হয় না, দেশের ভেতর আইন না মানলেও বিভিন্নভাবে পার পাওয়া যায়, সেহেতু ত্রুটি দূর করতে কেউ সচেষ্ট হয়নি।
কাজটা কি খুব কঠিন? আমার স্পষ্ট উত্তর, না। দেশে আইন আছে। প্রয়োজনীয় বিধি নেই। ফলে আইন প্রয়োগ করা কঠিন। আইনের প্রয়োগ অনেক বেশি বিমূর্ত। প্রয়োজনীয় বিধি তৈরি করে তা মূর্ত করতে হয়। বিধির অনুপস্থিতিতে সংশ্লিষ্ট সবাই অসুবিধায় আছে। কেউ জানে না কে কোনটার অনুমোদন দেবেন, কে কি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবে।
অনুমোদনের সময় বা পরীক্ষা-নিরীক্ষার সময় কি কি আওতায় আনতে হবে। কিভাবে সেসবের পরীক্ষা হবে? কে মনিটর করবে? ঢালাওভাবে রাজউক, ফায়ার সার্ভিস বা পুলিশের দিকে আঙুল যায়। আবার সব সংস্থাই পাশ কাটানোর ফাঁকফোকরও পায়।
এসব সমস্যার সমাধান সম্ভব। আইন কমিশন বা এমন কোনো সংস্থা এসব বিধি বা কোড তৈরি করতে পারে। এমনিতে অনেক দেরি হয়ে গেছে। আর যেন দেরি না হয়। উদাহরণ দিয়ে বলি। এক, দুই, তিন করে অগ্নি নিরাপত্তার জন্য একশ বা দুশ কোড থাকতে পারে। এমন করে ট্রাফিক বিধি, সড়ক দুর্ঘটনা বা নির্মাণ বিধিমালা। সবকিছুকে কোডের মধ্যে নিয়ে আসা যায়। ফলে বিষয়টায় স্বচ্ছতা আসে। ব্যবহারকারী হিসেবে আমি জানব কোন কোড আমার বেলায় প্রযোজ্য।
কার কাছ থেকে অনুমোদন নিতে হবে। কার কাছে জবাবদিহি করতে হবে। বিশ্বাস করবেন, পশ্চিমা দেশে একটা রেস্টুরেন্টকে প্রতি মাসে হিসেব দিতে হয় কোন উপকরণ কতটুকু ব্যবহূত হয়েছে। জ্বালানি কতটুকু ব্যবহূত হয়েছে। রান্নার তেল কি পরিমাণ ব্যবহূত হয়েছে। চুলা, ফ্রিজ, ওভেন— কোনটা কতটুকু ব্যবহূত হয়েছে। এরপর কোড অনুযায়ী মিলিয়ে দেখা হয় ব্যবহারের উপর ভিত্তি করে পর্যাপ্ত কার্বন-ডাই অক্সাইড বা ধোঁয়া নির্গত হয়েছে কি না।
পরিমাণমতো পোড়া তেল ফেলা হয়েছে কি না। বাজারের ইনভয়েসের সঙ্গে বিক্রির ইনভয়েস এবং বর্জ্যের ইনভয়েস মেলানো হয়। এরপর মেলানো হয় কর দেওয়ার অনুপাত। ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ নেই। পশ্চিমারা করতে পারলে আমাদের পক্ষেও তা করা সম্ভব। একদিনে না হোক, একশ দিনে।
আমি একজন পথচারীকে আজ যতটা সম্মান দেব, যেদিন আমি পথচারী হব, হয়তো সেদিন আমিও ততটুকু সম্মান পাব। এ বোধটুকু আমাদের মধ্যে অনুপস্থিত। কেন? কারণ, যিনি সিদ্ধান্ত নেন, যিনি আইন প্রণয়ন করেন, তিনি পথচারী না, তিনি গাড়িতে চড়েন, গাড়ি চালান এবং ভাবেন চিরদিন তিনি সেখানে থাকবেন।
লেখক: সাবেক বাংলাদেশ রাষ্ট্রদূত, পোল্যান্ড
নয়া শতাব্দী/আরজে
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ