ঢাকা, রোববার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

টুঙ্গিপাড়ার খোকা থেকে জাতির পিতা

প্রকাশনার সময়: ১৭ মার্চ ২০২৪, ০০:০০ | আপডেট: ১৭ মার্চ ২০২৪, ০৮:১৮

মধুমতির তীরে এসে বসবাস করতে শুরু করলেন এক ধার্মিক মানুষ, নাম যার বোরহান উদ্দিন শেখ। প্রায় ২৫০ বছর আগের কথা। বোরহান উদ্দিন শেখ কোথা থেকে এই মধুমতির তীরে আসলেন তা কেউ সঠিকভাবে জানতে পারেনি। আর বোরহান উদ্দিন শেখের তিন চার পুরুষ পরের পুরুষ শেখ কুদরত উল্লাহ। কুদরত উল্লাহর ভাই শেখ একরাম উল্লাহ। খোকারা সেই দুই ভাইয়েরই বংশধর।

কুদরত উল্লাহ শেখ আর একরাম উল্লাহ শেখের মৃত্যুর পর শেখদের আধিপত্য কমতে থাকে। তবে রয়ে গেল আভিজাত্য। খোকার নানা শেখ আব্দুল মজিদ। দাদা শেখ আব্দুল হামিদ। খোকার বাবা একসময় আদালতে চাকরি পান। তা দিয়ে কোনোমতে সংসার চালানো শুরু করলেন। বড় বোন ফাতেমা আর মেজো বোন আছিয়ার পর ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ খোকার জন্ম।

চৈত্র মাস তখন। সেজো বোন হেলেনা আর ছোট বোন লাইলী। একমাত্র ছোট ভাই শেখ আবু নাসের। খোকার নানা বাড়ি ও দাদা বাড়ি ছিল পাশাপাশি। আকিকার সময় শেখ মুজিবুর রহমান নামটি রাখেন তার দাদা। বাবা তাকে ডাকতেন খোকা বলে। চার বোন আর দুই ভাইয়ের মধ্যে খোকা ছিল তৃতীয়।

তখনকার দিনে বাবা-মা আদর করে বড় ছেলের নাম রাখতেন খোকা। স্কুল কলেজে সবাই তাকে ডাকত মুজিব ভাই। পাড়া-পড়শিরা ডাকত মিয়া ভাই। ফজরের আজানের পূর্বে বাবা উঠে যাওয়ার পর বাড়ির পাশের মসজিদে আজান শুনে খোকা উঠে পড়ত। বাবা ঘরে আসলে সবার সঙ্গে খোকা কোরআন তিলাওয়াতে বসে যেত। কোরআন তিলাওয়াত শেষে বাইরে ছুটে যেত। প্রকৃতিকে ভালোবাসত খোকা। খোকার খাওয়া দাওয়ায় ভীষণ অরুচি ছিল। বাঁশের মতো ছিপছিপে শরীর বলে মা তাকে তালপাতার সেপাই বলত। খোকা পাখির বাসা খুঁজে বের করতে ভালোবাসত।

যে গাছে পাখির বাসা সে গাছে উঠে দেখত পাখি কয়টা ডিম পেড়েছে, কয়টা ডিম ফুটে বেরিয়েছে। যেদিন ছানা উড়তে শিখত সেদিন হাততালি দিত। রাতে ঘুমানোর সময় খোকার বাবার গলা ধরে ঘুমিয়ে পড়ত। একবার খোকার কম খাওয়া নিয়ে মা বলেছিল এত কম কেউ খায়? এত কম খেলে শরীর ঠিক থাকে না। জবাবে খোকা বলছিল ‘খায় আম্মা, ওই পাটগাতি বাজারের পাশে মধুমতির পাড়ে নৌকার মাঝি আমার বয়সি। একদিন দেখলাম শুধু পেঁয়াজ আর মরিচ দিয়ে পান্তা ভাত খাচ্ছে দুপুরবেলা। খোকা বলেছিল দুপুরে কেউ পান্তা ভাত খায়?’।

খোকার বাবা যখন খোকাকে ভালো পড়াশোনার জন্য গোপালগঞ্জ নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তখন খোকার মা খুব কষ্ট পান। মায়ের কষ্ট দেখে খোকা গোপালগঞ্জ যেতে রাজি হয়নি। পরে অনেক বুঝিয়ে রাজি করানো হয়েছিল। গোপালগঞ্জ শহরে বড় পুকুরের ধারে খোকাদের অনেক আত্মীয়-স্বজন থাকে। ডানপাশে নারিকেল গাছ ঘেরা বাড়িতে খোকার থাকার ব্যবস্থা করা হয়। নতুন চৌচালা টিনের ঘর তৈরি করা হয়। কিন্তু খোকার মন বসে না। মায়ের জন্য মন কাঁদে।

মন ছুটে যায় টুঙ্গিপাড়ায়। ব্রিটিশ শাসনের সময় ব্রতচারী আন্দোলনে যোগ দেয় খোকা। ব্রতচারী আন্দোলন আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে ১৯৩৪ সালে যার প্রবক্তা সিলেটের গুরুসদয় দত্ত। ব্রতচারী আন্দোলন খোকার মনকে অনেকখানি পাল্টে দেয়। বড় বুজির বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার সময় খোকা কাছে যায়নি কান্না আটকে রাখতে পারবে না বলে।

১৯৩৪ সলে খোকা যখন সপ্তম শ্রেণির ছাত্র হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। ধরা পড়ল বেরিবেরি রোগ। পরে কলকাতায় নিয়ে যাওয়া হয় বড় ডাক্তারের কাছে। দুই বছর চিকিৎসা চলে। বাবার বদলির কারণে খোকা মাদারীপুর হাইস্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হন। আবার খোকা অসুস্থ। ডাক্তার দেখলেন। ডা. খোকাকে কলকাতা নেয়ার পরামর্শ দিলেন। চোখে ঝাপসা দেখে। কলকাতা নেয়ার পর ধরা পড়ে গ্লুকোমা। দুচোখেরই অপারেশন করা হলো।

ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন যখন মাদারীপুর ও গোপালগঞ্জে তুঙ্গে তখন খোকা লুকিয়ে সুভাষ বোসের দলের আলোচনা শুনতে যেত প্রতিদিন। ওখানে বক্তব্য শুনতে শুনতে খোকার রক্ত গরম হয়ে যেত। এ খবর খোকার বাবার কাছে পৌঁছে যায় এসডিও সাহেবের মাধ্যমে। খোকার বাবার বদলি হয় গোপালগঞ্জ। তখন খোকাকে ভর্তি করা হয় গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে।

এর আগে ভর্তি হয়েছিল গোপালগঞ্জ হাইস্কুলে। এক সময় মুসলমানদের খারাপ অবস্থা খোকার চোখে পড়ল। অনেক মুসলিম ছেলেরা ঠিকমতো স্কুলে যেতে পারত না। তখন হামিদ মাস্টারের পরামর্শে মুষ্টি চাল সংগ্রহ করে মুসলিম দরিদ্র ছাত্রদের সাহায্যে এগিয়ে আসে খোকা। ছোটবেলা থেকেই খবরের কাগজ পড়ার অভ্যাস ছিল খোকার। বাবা তখন আনন্দ বাজার, আজাদ, মাসিক মোহাম্মদী ও সওগাত পত্রিকা রাখত। খোকা ভালো ফুটবল খেলত। মাঠের বয়সে বড় ছেলেরা তার নির্দেশ মানত।

ফুটবল দল নিয়ে বিভিন্ন পাড়ায় এমনকি মাঝে মাঝে চিলমারী, মোল্লা হাটে যেত। খোকা যখন নবম শ্রেণির ছাত্র তখন একবার প্রধানমন্ত্রী শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক এবং শ্রমমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী আসবেন গোপালগঞ্জ। তখন স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠনের দায়িত্ব পড়ে খোকার ওপর। অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত খোকা স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন করতে সক্ষম হয়েছিল তার নেতৃত্বের কারণে।

১৯৩৮ সালের ১৬ জানুয়ারি গোপালগঞ্জ এলেন শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। সব শেষে গেলেন মিশন স্কুলে পরিদর্শনে। মন্ত্রীর যাওয়ার পথে ভিড় ঠেলে পথ আগলে দাঁড়ায় খোকা। মন্ত্রীর সামনে এগিয়ে গিয়ে বললেন, মাননীয় মন্ত্রী আপনার কাছে আমাদের একটা দাবি আছে। স্কুল ছাত্রের এমন সাহস দেখে মন্ত্রী মুগ্ধ হয়ে বললেন, কি দাবি? খোকা বলল, ‘হোস্টেলের ভাঙা ছাদ দিয়ে পানি পড়ে ছাত্রদের বই খাতা ভিজে যায়। খুব কষ্ট হয় ছাত্রদের।’

মন্ত্রী বিষয়টি দেখার আশ্বাস দিলেন। খোকা এতে খুশি হয়নি। এক্ষুনি ছাদ মেরামতের ব্যবস্থা করে না দিলে পথ ছাড়বে না বলে দেয়, এতে যা হওয়ার হবে।’ আশপাশের সবাই খোকাকে সরাতে চাইল কিন্তু পারল না। অবশেষে সোহরাওয়ার্দী পাশের একজনকে বলল, ‘আমার ঐচ্ছিক তহবিল থেকে এক হাজার ২০০ টাকা মঞ্জুর করে দাও।’ উপস্থিত সবাই অবাক। এই সেই খোকা আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সোহরাওয়ার্দী কাছে ডেকে নিয়ে নাম জানতে চাইলেন এবং পরবর্তীতে খোকাকে চিঠি পাঠিয়েছিলেন।

একসময় এই শহীদ সোহরাওয়ার্দীর কাছ থেকেই নতুন জীবনের সন্ধান পেল খোকা। সোহরাওয়ার্দী হয়ে উঠলেন তার রাজনৈতিক গুরু। একবার খোকার সহপাঠী মালেক অর্থাৎ আব্দুল মালেককে ধরে নিয়ে যায় হিন্দু মহাসভার নেতারা। তখন গোপালগঞ্জে হিন্দুদের সংখ্যা বেশি এবং প্রভাব প্রতিপত্তিও বেশি। খবর পেয়ে খোকা দলবল নিয়ে গিয়ে তাকে উদ্ধার করে আনে। সে রাতেই হিন্দু নেতারা খোকার নামে মামলা করে খুনের চেষ্টার জন্য।

বাসায় যখন দারোগা যায় তখন অনেকেই খোকাকে পালাতে বললেও খোকা পালায়নি। মিথ্যা বলে ভয় দেখানোর কারণে সেদিন দারোগাকেও হুমকি দিয়েছিল খোকা। টুঙ্গিপাড়ার ডানপিঠে খোকা, বাড়ি আর প্রতিবেশীদের মিয়া ভাই আর কলকাতার মুজিব ভাই একদিন হয়ে উঠেছিলেন আমাদের স্বাধীনতার মহানায়ক, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক

নয়া শতাব্দী/আরজে

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ