যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের মধ্যে বিরোধ এখন প্রকাশ্যে। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, হামাসের বিরুদ্ধে পরিচালিত অভিযানে ইসরায়েল আন্তর্জাতিক সমর্থন হারাচ্ছে। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু যুদ্ধপরবর্তী গাজা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পনাকে প্রকাশ্যে প্রত্যাখ্যান করেছেন।
এই বিভক্তির খবর এত দিন পর্যন্ত একরকম পর্দার আড়ালেই ছিল। মাঝেমধ্যে খবর পাওয়া যাচ্ছিল যে গাজায় বেসামরিক জনগণের বিপুল প্রাণহানির কারণে দৃঢ় বন্ধনে আবদ্ধ দুই মিত্রের সম্পর্কে চিড় ধরেছে। তাছাড়া মার্কিন প্রেসিডেন্টের দাবি, বিশ্বের বৃহৎ অংশের সমর্থন এখনো ইসরায়েলের পক্ষে। তবে বাইডেন বলেছেন, গাজায় বেপরোয়া বোমাবর্ষণের কারণে ইসরায়েলের সামরিক অভিযানের প্রতি সমর্থন দ্রুত কমছে। তাছাড়া ইসরায়েলি সরকারও দুই দেশভিত্তিক সমাধান চায় না। আর কয়েক সপ্তাহ পর গাজা-সংকট পঞ্চম মাসে পা দিতে চলেছে।
গাজা উপত্যকায় চলমান বর্বর হামলার প্রেক্ষাপটে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও মধ্যপ্রাচ্যকেন্দ্রিক অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অংশীদারদের মনোভাবের কোনো পরিবর্তন হলো কি না, সেই প্রশ্ন এখন তোলাই যায়। অবস্থান যে কিছুটা হলেও বদলেছে তার আঁচ পাওয়া যায় গোপন একটি নথি থেকে। এই নথিকে অবশ্য বলা হচ্ছে নন পেপার।
ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো কোনো জটিল বিবাদমান ইস্যুতে আলোচনার সূত্রপাত ঘটাতে এ ধরনের নথি তৈরি করে থাকে। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত সংস্থাগুলোর মধ্যে আপস মীমাংসার জন্য গত জানুয়ারি ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এক্সটারনাল অ্যাকশন সার্ভিস সদস্য রাষ্ট্রগুলোতে এই নথি পৌঁছেছে। মধ্যপ্রাচ্য শান্তি আলোচনা শুরুর জন্য বাস্তবভিত্তিক কিছু পদক্ষেপের রূপরেখা আছে এতে। তবে নথিটি পুরোপুরি রাজনৈতিক।
শুধু ৭ অক্টোবর কী ঘটেছে এবং এর জবাবে ইসরায়েল গাজায় যে গণহত্যা শুরু করেছে, তার বিশ্লেষণ এই নথির উদ্দেশ্য নয়; বরং কেন ও কীভাবে এই সংঘাতের সূচনা তার বিস্তারিত বিবরণ আছে এতে।
কীভাবে ১৯৬৭ সালে ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের জায়গাজমি দখল করে নিয়েছে তারও উল্লেখ আছে। অবশেষে এই নথিতে স্বীকার করে নেয়া হয়েছে গাজা, অধিকৃত পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেমে ইসরায়েলিদের নির্যাতন ও সহিংসতার ঘটনা বহু পুরোনো। গত বছরের ৭ অক্টোবরের বহু আগে থেকেই ফিলিস্তিনিদের ওপর যে নিপীড়ন চলছে সে কথা আছে নন পেপারে। আরও বলা হয়েছে, গত চার মাসে গাজা হত্যাযজ্ঞের আড়ালে পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেমের ওপর চলা হামলার খবর আড়ালে চলে গেছে। বলা যায় এই নথিটি অলৌকিক।
কারণ, উরসুলা ভন ডার লিয়েনের আমলে এমন একটি প্রতিবেদন তৈরি হতে পারে, এটা অকল্পনীয়। চার মাস ধরে এতকিছুর পরও ইউরোপিয়ান কমিশন ভাঙা রেকর্ডের মতো মন্ত্র জপ করে গেছে, ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকার আছে। একই সঙ্গে এখন পর্যন্ত নারী ও শিশুসহ হাজার হাজার ফিলিস্তিনির মৃত্যুতে সমানুভূতিসূচক একটি শব্দও তিনি উচ্চারণ করেননি। মাঝেমধ্যে তিনি খুব হালকাভাবে বলেছেন, হামলার জবাবটা সমানুপাতিক হওয়া দরকার।
কিন্তু একবারের জন্যও যুদ্ধবিরতির কথা বলেননি। আর তাছাড়া বরাবরই তিনি সমমনা কিছু বন্ধু পেয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য তো ছিলই, সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জার্মানি, ফ্রান্স ও ইতালি। নন পেপারের সবচেয়ে কৌতূহলোদ্দীপক অংশ হলো এর ১১ নম্বর অনুচ্ছেদ। এই অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, শেষ হয়ে গেলে, বিবাদমান দুই পক্ষের কাছে শান্তি পরিকল্পনা উপস্থাপন করা হবে। এই পরিকল্পনার ভিত্তিতে তারা চূড়ান্ত ভাষ্য ঠিক করবে।
এই আপসরফাকে এগিয়ে নিতে সাহায্যকারী রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলো স্পষ্টভাবে জানাবে শান্তি চুক্তিতে সম্পৃক্ত থাকা বা না থাকার কী প্রভাব পড়তে পারে। এই অনুচ্ছেদে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে। যেমন- এই শান্তি পরিকল্পনা কয়েকটি দেশের জোট ও আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলো তত্ত্বাবধান করবে। এই দায়িত্ব শুধু যুক্তরাষ্ট্রের হাতে ছেড়ে দেয়া হবে না। যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপারে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের পেছনে যৌক্তিক কারণ আছে।
কারণ, আরবরা আর যুক্তরাষ্ট্রকে বিশ্বাস করতে পারছে না। তারা মনে করে, যুক্তরাষ্ট্র মধ্যস্থতাকারী হিসেবে সৎ নয়। তারা কখনো সৎ ছিল না; বরং অন্যান্য রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক সংস্থার জোট তাদের জন্য ভালো কিছুর নিশ্চয়তা দেবে। ফিলিস্তিনকে ঘিরে গত কয়েক দশকের যে চর্চা, তার পুরোপুরি বিপরীতমুখী ঘটনা ঘটেছে। এত দিন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র শান্তি আলোচনা নিয়ে লম্ফঝম্প করেছে। এসব প্রস্তাব এককভাবে ইসরায়েল তৈরি করে ওয়াশিংটনকে দিয়েছে।
ইসরায়েলের এগিয়ে দেয়া প্রস্তাব নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র খসড়া তৈরি করে ফিলিস্তিনিদের দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পনা হিসেবে। আর বারংবার বলেছে, এই প্রস্তাব নিয়ে আদৌ তারা ইসরায়েলের সঙ্গে কথা বলেনি। ফিলিস্তিনিরা অবশ্য আগে থেকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের এই খেলা সম্পর্কে জানত। ফলে তারা এ ধরনের প্রস্তাব বারবারও নাকচ করে দেয়।
আর মার্কিন প্রশাসন প্রচার করে যে ফিলিস্তিনিরা সুযোগ হারিয়েছে। ইইএএস এই চতুষ্টয়কে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র, জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও রাশিয়া নতুন করে একটি দল করেছে। ২০০০ সালের শুরুর দিকে তারা সেই তথাকথিত রূপরেখা তৈরি করেছিল, শেষ পর্যন্ত যেই রূপরেখার কোনো গতি হয়নি। মনে রাখা জরুরি, ইসরায়েলের সরকার এই রূপরেখায় ১৫টি ইস্যুতে বিরোধিতা জানিয়েছে। ফলে ওই রূপরেখায় আর সারবস্তু কিছুই অবশিষ্ট ছিল না।
তারপরও ওয়াশিংটন ও এই চতুষ্টয়ের কেউই ইসরায়েলের ব্যাপারে পাল্টা কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। আরও একটি কারণে এই অনুচ্ছেদ ১১ গুরুত্বপূর্ণ। শান্তি আলোচনা থেকে কোনো একটি বা দুটি পক্ষ সরে আসলে কী ধরনের পরিণতি হতে পারে সে সম্পর্কে নন পেপার খুব পরিষ্কারভাবে বলেছে। এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে- প্রথমবারের মতো ইইএএস ব্যবস্থা নেয়ার কথা বিবেচনা করছে। সেটা কী ধরনের? শাস্তি নাকি নিষেধাজ্ঞা? ইসরায়েলের বিরুদ্ধে? ইইউ ফিলিস্তিনিদের ওপর অতীতে নিষেধাজ্ঞা দিতে কসুর করেনি। কিন্তু ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথা কখনো ভাবেনি।
আমরা কি তাহলে দশকের পর দশক ইসরায়েল যে দায়মুক্তি উপভোগ করে আসছে, তার সমাপ্তি দেখতে পাচ্ছি? গত কয়েক সপ্তাহে ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক প্রধান জোসেপ বোরেল একটি সাহসী উদ্যোগ নিয়েছেন। ফিলিস্তিনিদের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রধান অংশীদার প্যালেস্টিনিয়ান ন্যাশনাল অথরিটিকে দুর্বল করতে হামাসকে তহবিল দেয়ার যে কৌশল নেতানিয়াহু নিয়েছিলেন, তার কঠোর সমালোচনা করেন জোসেপ বোরেল।
সম্প্রতি তিনি ইসরায়েলকে কম অস্ত্র দিতে যুক্তরাষ্ট্রকে আহ্বান জানিয়েছেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের অবস্থান যে পরিবর্তন হচ্ছে তার আরও একটি ইঙ্গিত পাওয়া যায় ৩০ জানুয়ারি, যখন ডেভিড ক্যামেরন বলেন যুক্তরাজ্য আনুষ্ঠানিকভাবে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিতে চায়। তিনি বলেন, দুই দেশভিত্তিক সমাধানের পথে এই স্বীকৃতি বিরাট অগ্রগতি হিসেবে গণ্য হবে। এর অর্থ দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানে পৌঁছানোর আগেই যুক্তরাজ্য ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেবে।
অন্য কথায়, এসব অগ্রগতি ইসরায়েলের মুখে একটা থাপ্পড়ের মতো এবং ফিলিস্তিনিদের মুক্তি স্পৃহার প্রতি সমর্থন। ক্যামেরন হোয়াইট হাউসের সঙ্গে আলোচনা করে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন কি না, এখনো বোঝা যাচ্ছে না। যদি আলোচনা করে থাকে তাহলেই মঙ্গল।
সবশেষ ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত ২৭টি সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে হাঙ্গেরি ছাড়া ২৬টি গাজায় যুদ্ধবিরতির পক্ষে অবস্থান নেয় এবং রাফায় যেন ইসরায়েল অভিযান না চালায়, সে ব্যাপারে জোর দাবি জানায়। সহিংস ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীদের নিষেধাজ্ঞা দেয়ার বিপক্ষেও দাঁড়িয়েছে হাঙ্গেরি। সুতরাং বোঝা যাচ্ছে কিছু একটা পরিবর্তন হচ্ছে। তবে এই জায়গায় পৌঁছাতে ৩০ হাজার ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিককে প্রাণ দিতে হচ্ছে। সেই বিবেচনায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের এ অবস্থান লজ্জাজনক।
তবু ইইউ ঠিক পথে এগোবে এটাই প্রত্যাশিত। এদিকে যুক্তরাষ্ট্র এখনো জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের জন্য তাদের সিদ্ধান্তের খসড়া তৈরি করছে। এই খসড়ায় মার্কিন কূটনীতিতে প্রথমবারের মতো যুদ্ধবিরতি শব্দটি যুক্ত হতে যাচ্ছে। এর সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ আরও কিছু বিষয়ও যুক্ত হচ্ছে, যেমন রাফায় অভিযান চালানো যাবে না। বাইডেনের বক্তৃতার আগেই নেতানিয়াহু স্বীকার করেন, যুদ্ধপরবর্তী গাজা কীভাবে পরিচালিত হবে, তা নিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তার মতানৈক্য আছে।
এক বিবৃতিতে এই ইসরায়েলি নেতা আরও বলেন, এটা ঠিক যে হামাসকে পরাজিত করার পরদিন গাজায় কী হবে, তা নিয়ে আমরা একমত হতে পারিনি। তবে আমি আশা করি যে আমরা দ্রুতই ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারব। ৭ অক্টোবর হামাসের সন্ত্রাসী হামলার আগে বাইডেন প্রকাশ্যে নেতানিয়াহুর জোট সরকার নিয়ে সমালোচনা করেছেন। কারণ, নেতানিয়াহু সরকার গঠনে অতি ডানপন্থি দলের সঙ্গে জোট বেঁধেছিলেন। কিন্তু যুদ্ধ শুরুর পর থেকে হাজারো সমালোচনার মুখেও বাইডেন নেতানিয়াহুর কাঁধে কাঁধ রেখে চলেছেন। নেতানিয়াহুর কাছে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম যুদ্ধপরবর্তী গাজা সম্পর্কে জানতে চেয়েছে বহুবার। সিএনএনের ডানা ব্যাশকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের নেতৃত্বে একটি বেসামরিক সরকারের কিছু ভূমিকা গাজায় থাকতে পারে।
তবে সেই সরকারকেও পুনর্গঠিত হতে হবে। ওদিকে বাইডেনের বক্তৃতার আগে নেতানিয়াহু বলেন, আমি আমার অবস্থান পরিষ্কার করতে চাই। অসলোতে আমরা যে ভুল করেছি, সেই একই ভুল আমি আর ইসরায়েলকে করতে দেব না। ইসরায়েলের পাশেই স্বাধীন, সার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের জন্ম হবে- এমন ধারণার উৎপত্তি ১৯৯০-এর দশকে।
অসলো চুক্তির আগে দফায় দফায় দুই পক্ষই বসেছে এবং একের পর এক চুক্তি করেছে। এর অংশ হিসেবে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের জন্ম হয় এবং তারা পশ্চিম তীর ও গাজার কিছু অংশের নিয়ন্ত্রণ পায়। হোয়াইট হাউসে হানুকা অনুষ্ঠানে বাইডেন স্বীকার করেন যে হামাসের হামলা এবং এরপর গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর অভিযানকে ঘিরে ইসরায়েল একটা জটিল পরিস্থিতির মুখোমুখি। গাজাযুদ্ধ শেষে নতুন মধ্যপ্রাচ্যের জন্ম হবে, তবে বাইডেন বলেছেন, ইসরায়েলকে সতর্ক হতে হবে।
কারণ, যে কোনো মুহূর্তে জনমত ঘুরে যেতে পারে। এটা হতে দেয়া যাবে না। যুক্তরাষ্ট্র বলছে, গাজায় সামরিক অভিযান শেষে কী হবে, তা ঠিক করা জরুরি। পাশাপাশি ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠনের যে আলোচনা, তার দরজা খোলা রাখতে হবে। যা-ই হোক সময় ও পরিস্থিতি বলে দেবে কোনদিকে এগোবে গাজার ভবিষ্যৎ।
লেখক: গবেষক ও কলাম লেখক
নয়া শতাব্দী/আরজে
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ