ঢাকা, শনিবার, ৬ জুলাই ২০২৪, ২২ আষাঢ় ১৪৩১, ২৯ জিলহজ ১৪৪৫

নিরাপদ খাদ্যের নিশ্চয়তা চাই

প্রকাশনার সময়: ১৪ মার্চ ২০২৪, ০০:০০ | আপডেট: ১৪ মার্চ ২০২৪, ০৭:৫০

রাজধানীর অবৈধ হোটেল-রেস্তোরাঁর ব্যাপারে দেশজুড়ে হইচই হচ্ছে। বেইলি রোডে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পর প্রশাসন নড়েচড়ে বসেছে। হোটেল-রেস্তোরাঁগুলোতে অভিযান চলছে। এমনই হয় বাংলাদেশে। কোনো একটা ঘটনা ঘটে গেলে কদিনের টনক নড়ে সংশ্লিষ্টদের। তারপর যা ছিল তাই থাকে।

প্রশ্ন হলো- অবৈধ রেস্তোরাঁর বিষয়ে অভিযান চলছে কিন্তু সারা বাংলাদেশের অধিকাংশ হোটেল-রেস্তোরাঁয় যে ভেজাল খাবার মানুষকে খাওয়াচ্ছে তার কি হবে? এ বিষয়টি আগে সামনে আসা উচিত। আমরা যে খাবার খাচ্ছি তা তো বিষে ভরা। দেশি-আন্তর্জাতিক সব গবেষণায় দেশে খাবারের বিষক্রিয়ার বিষয়টি বারবার উঠে আসছে। ফুটপাত থেকে শুরু করে অভিজাত হোটেল-রেস্টুরেন্ট বা নামিদামি ব্র্যান্ডের পণ্য এমনকি বাসাবাড়ির খাদ্যও এখন ভেজালমুক্ত নয়।

খাদ্যে ভেজাল, খাদ্যে বিষক্রিয়ার ব্যাপ্তি যে হারে বাড়ছে তা আতঙ্কিত হওয়ার মতো। ভেজাল খাবার ঝুঁকির দিকে ঠেলে দিচ্ছে জীবন। উৎপাদনকারী ও ব্যবসায়ীদের একটি শ্রেণি অধিক মুনাফার লোভে মনুষ্যত্ব ভুলে গিয়ে খাবারে প্রচুর মাত্রায় কেমিক্যাল, ক্যালসিয়াম কার্বাইড, ফরমালিন, আর্টিফিশিয়াল রং, ইউরিয়াসহ বিষাক্ত সামগ্রী ব্যবহার করছে।

এসব কেমিক্যাল অত্যন্ত বিষাক্ত। আর এসব বিষাক্ত খাবার খেয়ে কারও কিডনি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, ফুসফুস আক্রান্ত হচ্ছে, ক্যান্সারের কিংবা অন্য কোনো জটিল রোগে ভুগছে মানুষ। মানুষের শরীরে রোগবালাই পেয়ে বসেছে। মানুষ অকালে মারা যাচ্ছে। বিষ খেলে মানুষ তো মরবেই!

গবেষণা বলছে, শুধু ভেজাল খাদ্য গ্রহণের ফলে দেশে প্রতি বছর প্রায় সাড়ে তিন লাখ লোক ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে। ডায়াবেটিস আক্রান্তের সংখ্যা দেড় লাখ, কিডনি রোগে আক্রান্তের সংখ্যা দুই লাখ। এ ছাড়া গর্ভবতী মায়ের শারীরিক জটিলতাসহ গর্ভজাত বিকলাঙ্গ শিশুর সংখ্যা প্রায় ১৫ লাখ। এই পরিসংখ্যানটি আমাদের না ভাবিয়ে পারে না। ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে খাদ্যে ভেজাল দেয়া এবং ভেজাল খাদ্য বিক্রির সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।

এ ছাড়া ১৪ বছরের কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। ২০১৫ সালে গঠন করা হয় ‘নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ’। নিরাপদ খাদ্যের বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে এ সংস্থাটি কি করছে? ভেজালমুক্ত খাবার এদেশের জনগণ কে পাচ্ছে না?

ভেজাল খাদ্য রোধে আইনের প্রয়োগই বা দেশে আছে কতটুকু? আমরা কি নিরাপদ খাদ্য পাচ্ছি? সামনে পাওয়ার সম্ভাবনাও কম। ভেজাল পণ্য ও অসাধু ব্যবসায়ীদের ঠেকাতে ব্যাপক অভিযান প্রয়োজন। অস্বীকার করা যাবে না যে, খাদ্যে ভেজাল বা দূষণ একটি বৈশ্বিক সংকট। এ সংকট তৈরি হয়েছে ভেজালবিরোধী অধিকাংশ আইন বর্তমানে অনেকটা অকার্যকর থাকায়। আইনের প্রয়োগ খুব কম। ভেজালবিরোধী অভিযান পরিচালিত হয়, তা বিচ্ছিন্নভাবে।

ভেজাল খাদ্য রোধে বাজারে সার্বিক তদারকি ব্যবস্থা খুবই করুণ। ভেজাল রোধে সবাইকে সচেতন হতে হবে। ভেজালবিরোধী আইন বাস্তবায়ন করতে হবে। ভেজালকারবারিদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। মাঠ পর্যায়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের এ ব্যাপারে ধারণা দিতে হবে, সচেতন করতে পারবে। তারা তাদের পরিবারকে সবচেয়ে বেশি কাউন্সিলিং করতে পারবে। সর্বোপরি রাষ্ট্র এ ব্যাপারে জিরো টলারেন্স না দেখালে আমাদের সর্বনাশ হয়ে যাবে।

এদেশে ভেজাল প্রতিরোধে দায়িত্বপ্রাপ্ত বিভিন্ন সরকারি সংস্থার মধ্যে সমন্বয়ের বড় অভাব রয়েছে। আমাদের দেশে পর্যাপ্ত আইনি ও কারিগরি নিরাপত্তাব্যবস্থা না থাকায় প্রায় সব ধরনের খাদ্যদ্রব্যেই অবাধে ভেজাল চলে। এমন অবাধ ভেজালের ফলে মানুষও অসুস্থ হচ্ছে দিন দিন। মানুষ মারাও যাচ্ছে। প্রশ্ন হলো- দেশ নাকি উন্নয়নের শিখরে যাচ্ছে।

আমাদের জীবনযাত্রার মান বেড়েছে, রাস্তাঘাটের উন্নতি হয়েছে— না বলার সুযোগ নেই। যদি দেশের মানুষ সুস্থই না থাকে, জীবনই যদি না বাঁচে তবে কাদের জন্য এ উন্নয়ন। ভেজাল খাদ্যে উন্নয়ন হয়েছে। এটা ভয়ঙ্কর! দেশের সার্বিক উন্নয়নের সঙ্গে ভেজাল খাদ্য রোধে উন্নয়ন চাই। জনস্বাস্থ্য ঝুঁকিতে থাকলে, দেশের মানুষ রোগাক্রান্ত হলে উন্নয়ন কাদের জন্য? রাষ্ট্র বিষয়টি ভাববে এটা আমাদের কাম্য।

হাঁস-মুরগির আর মাছের খাবারে ক্যান্সার সৃষ্টিকারী উপাদান ক্রোমিয়াম মাত্রাতিরিক্ত অবস্থায় আছে বলে সংবাদ ছাপা হচ্ছে তাতে আমরা ভয় পাচ্ছি। হাঁস, মুরগি ও মাছের শরীরে প্রবেশ করছে বিষ। বিভিন্ন ধাতু ও রাসায়নিকসমৃদ্ধ বিষাক্ত ট্যানারি বর্জ্য খাবার হিসেবে অধিক মুনাফার জন্য খাদ্যের মাধ্যমে ব্যবহার করছেন খামারিরা। এ ধরনের মাছ ও মাংস গ্রহণ করলে তা মানব শরীরে প্রবেশ করে। তা মানবদেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের কর্মকর্তারা জানান, ট্যানারির বর্জ্য থেকে উৎপাদিত পোলট্রি ফিডে হেভিমেটালে ক্যাডমিয়াম, লেড (সিসা), মার্কারি (পারদ) ও ক্রোমিয়ামসহ বেশ কিছু বিষাক্ত পদার্থ মিলেছে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেন, ক্রোমিয়ামসহ এসব ধাতু ও রাসায়নিক থেকে ক্যান্সার, হূদরোগ, আলসার, লিভারের জটিল রোগ, কিডনির অসুখ হতে পারে। মানবদেহে অতিরিক্ত ক্রোমিয়াম প্রবেশ করলে পুরুষের সন্তান উৎপাদন ক্ষমতা হ্রাস, নারীদের অকাল প্রসব, বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম, অ্যাজমা, শ্বাসকষ্ট, চর্মরোগও হয়ে থাকে।

অবশ্য এ বিষয়ে গবেষক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. আবুল হোসেন জানিয়েছেন, ট্যানারি বর্জ্য ছাড়া অন্য যেসব উপাদান ব্যবহার করে দেশে যে পোলট্রি ফিড তৈরি হয়, তাতে ক্রোমিয়ামের উপাদান থাকার আশঙ্কা নেই। সে ক্ষেত্রে যেন পুরো পোলট্রি ফিডশিল্পের ব্যাপারে ভোক্তা ও উৎপাদকদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি না হয়, তাতে সতর্ক থাকা জরুরি। অতীতে এ ধরনের আতঙ্কের কারণে আমাদের পোলট্রি শিল্প ধসের মুখোমুখি হয়েছিল। এর পুনরাবৃত্তি কোনোভাবে যেমন কাম্য নয়, আবার বিষযুক্ত মাছ-মাংসও আমাদের যেন খেতে না হয় এজন্য সরকার সংশ্লিষ্টদের সজাগ থাকতে হবে।

দেশে ক্যান্সার রোগী বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ হলো বিষযুক্ত এসব খাবার। খাদ্যপণ্যে ফরমালিন ও কার্বাইড ব্যবহারের ফলে স্বাস্থ্যঝুঁকি বেড়েই চলেছে। ভেজাল নিরসনে আইনি কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে, সন্দেহ নেই; কিন্তু তার চেয়েও বড় সীমাবদ্ধতা হচ্ছে আইনের প্রয়োগ খুবই সামান্য। একজন ভোক্তা হিসেবে আমাদের নিরাপদ খাদ্য পাওয়ার অধিকার রয়েছে। এ অধিকার থেকে আমরা বরাবরই বঞ্চিত। মানুষ কেন খাদ্যে ভেজাল দেয় তার কারণ পর্যালোচনা করলে ভোগী মনোবৃত্তির পরিচয় মেলে।

স্বল্প সময়ে যাতে অধিক উপার্জন করা যায় সেদিকেই ভেজালকারীদের প্রধান লক্ষ্য থাকে। এতে পরিশ্রম কম হয়, কিন্তু রাতারাতি বিত্তবান হয়ে ওঠা যায়। স্বার্থান্ধ মানুষ নিজেদের স্বার্থের কথা মনে রেখে ভেজাল দিতে গিয়ে মানুষের যে চরম সর্বনাশ করে তা কখনোই তারা ভেবে দেখে না। অন্যের ভালো-মন্দ বিবেচনা করার মতো বিবেক তাদের নেই।

আইন প্রয়োগ হলে সব ঠিক হয়ে যাওয়ার কথা। খাদ্যে ভেজাল রোধে আইনের যথাযথ প্রয়োগও নিশ্চিত হবে তা আমরা আশা করব। খুব ঘৃণিত একটি বিষয়, আমরা বিভিন্ন সময়ে দেখেছি কিভাবে মাছ ও দুধে ফরমালিন, শুঁটকিতে ডিডিটি, ভাজা খাবারে তেলের বদলে পোড়া লুব্রিকেটিং, ফুডগ্রেডের বদলে টেক্সটাইলে ব্যবহূত রং ব্যবহার করা হয়। আমরা মনে করি, নিত্যনতুন কায়দায় খাবারের সঙ্গে মানবদেহে বিষ প্রয়োগ নীরব গণহত্যারই নামান্তর। এই নীরব ঘাতককে রুখতে শুধু সরকারি সংস্থার সক্রিয়তা নয়, বেসরকারি বিভিন্ন পক্ষ বা নাগরিকদেরও সরব হওয়া জরুরি। এটা রাষ্ট্রেরও দায়িত্ব।

বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমে খাদ্যে ভেজালের সংবেদনশীল ও ভয়ানক খবরগুলো বিভিন্ন সময়ে প্রকাশ হয়ে আসছে। ভেজাল রোধে হাইকোর্টের একটি দ্বৈত বেঞ্চ নিম্নমানের ৫২ খাদ্যপণ্য প্রত্যাহারের নির্দেশ দিয়েছে। এ নিয়ে সে সময় দেশে হইচইও হয়েছে। কিন্তু তাতে কী হয়েছে?

আমরা উদ্বেগের সঙ্গে দেখেছি, হাইকোর্টের হস্তক্ষেপের পরও সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে পরিস্থিতির তেমন হেরফের ঘটেনি। অথচ সরকারি সংস্থার দ্বারা ভেজাল চিহ্নিত হওয়ার পরই উপযুক্ত সরকারি সংস্থা দায়ী প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেবে, সেটাই ছিল দেশের মানুষের স্বাভাবিক প্রত্যাশা। কিন্তু কিছুই হয়নি। থেমে গেছে সব কার্যক্রম। এর ফলে ভোক্তাদের মধ্যে হতাশা, এমনকি অসহায়ত্ববোধ আরও তীব্র হয়েছে। খাদ্য মানুষের অন্যতম প্রধান মৌলিক অধিকার।

খাদ্যগ্রহণ ছাড়া মানুষসহ কোনো প্রাণীই বেঁচে থাকতে পারে না। তবে সে খাবার অবশ্যই হতে হয় বিশুদ্ধ। আমরা আশা করব, ভেজাল খাদ্যপণ্য কার্যকরভাবে প্রত্যাহার করে এবং দোষী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে যথাযথ পদক্ষেপ নিয়ে সরকার একটি অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে।

সুস্বাস্থ্যের জন্য স্বাস্থ্যসম্মত নিরাপদ খাদ্যের বিকল্প নেই। আমরা নিরাপদ খাদ্য চাই; আমরা সুস্থ থাকতে চাই। আর তা রাষ্ট্র নিশ্চিত করবে- এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

লেখক: সাংবাদিক, সমাজ গবেষক

নয়া শতাব্দী/আরজে

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ