ঢাকা, বুধবার, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১০ আশ্বিন ১৪৩১, ২১ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

‘জয় বাংলা’ প্রতিপালনে অবহেলা কেন

প্রকাশনার সময়: ১২ মার্চ ২০২৪, ০০:০০ | আপডেট: ১২ মার্চ ২০২৪, ০৮:০৭

‘জয় বাংলা’ বাঙালি জাতির প্রাণের স্লোগান। এ শব্দ দুটির সঙ্গে আমাদের জাতীয় পরিচয় অকৃত্রিম ও অবিচ্ছেদ্যভাবে মিশে আছে। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার পূর্বাপর অবিনাশী ইতিহাসের সঙ্গে ‘জয় বাংলা’ শব্দ যুগল, ধ্বনি কিংবা স্লোগান- যাই বলি না কেন তা অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে আছে।

১৯২২ সালে মতান্তরে ১৯২৪ সালে প্রকাশিত প্রাণের কবি কাজী নজরুল ইসলামের কালজয়ী কাব্যগ্রন্থ ‘ভাঙার গান’ এর ‘পূর্ণ অভিনন্দন’ কবিতার ২৭ তম চরণে সর্বপ্রথম ‘ জয় বাংলা’ শব্দটি উৎকলিত হয়। পরবর্তীতে পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও বরাক উপত্যকার বাঙালিরা এটিকে স্লোগান হিসেবে ব্যবহার করলেও একমাত্র বঙ্গবন্ধুর মাধ্যমেই পূর্ববঙ্গীয় বাঙালি জাতির রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির এক অমীয় স্লোগান হিসেবে এটি ইতিহাসসিদ্ধ হয়ে ওঠে। নিবিড় বিশ্লেষণে দেখা যায়, সকল নিষ্পেষণ ও শোষণের বিরুদ্ধে জাগ্রত নজরুলের সমগ্র বিদ্রোহী চেতনার পূর্ণসার্থক রূপকার হিসেবে বঙ্গবন্ধু বাংলায় আবির্ভূত হয়েছিলেন। কথিত আছে যে, ১৯৬৯ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ কর্তৃক আহুত শিক্ষা দিবসের এক ঘরোয়া সভায় তৎকালীন রাষ্ট্রবিজ্ঞান অনুষদের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আফতাব আহমেদ ও চিশতি হেলালুর রহমান ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটি সর্বপ্রথম ব্যহার করেন।

আবার কারোর মতে, ১৯৭০ সালের ১৯ জানুয়ারি ঢাকাস্থ পল্টনের এক জনসভায় ছাত্রনেতা সিরাজুল আলম খান বক্তৃতাকালে এটি উচ্চারণ করেন। তবে ইতিহাসবিদদের মতে, ১৯৭০ সালের ৭ জুন রেসকোর্স ময়দানের এক বিশাল জনসভায় বঙ্গবন্ধুই সর্বপ্রথম জনসম্মুখে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান তোলেন।

তৎপরবর্তীতে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের গগনবিদারী কালজয়ী ভাষণের শেষান্তে ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম ; এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, জয় বাংলা!’ বলে তিনি সমাপনী টানেন। সেদিন থেকে এ স্লোগানটি মুক্তিপাগল বাঙালির স্বাধীনতার এক দুর্বার ধ্বনিতে পরিণত হয়। তখন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’ গানরূপে এটি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সব বাঙালিকে ইস্পাত কঠিন প্রেমময় বন্ধনে ঐক্যবদ্ধ করেছিল।

গাজী মাযহারুল আনোয়ারের রচনায় ও আনোয়ার পারভেজের সুরে এই পরম প্রেরণাদায়ী গানটি বিবিসির শ্রোতা জরিপে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ২০টি গানের মধ্যে ১৩ তম শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে। শুধু তাই নয়, ৭ মার্চের ভাষণটি নিষ্পেষিত মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে কালের ইতিহাসে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ প্রেরণাদায়ী ভাষণ হিসেবে ইতোমধ্যে জাতিসংঘের ইউনেস্কো কর্তৃক বিশ্ব ঐতিহাসিক দলিলের স্বীকৃতি পাওয়ার প্রেক্ষিতে ভাষণটির ‘জয় বাংলা স্লোগানের ঐতিহাসিক ও জাতীয় মর্যাদার পাশাপাশি এর আন্তর্জাতিক মর্যাদাও অনেক বেশি বৈকি। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর ’৭৫ পরবর্তীতে জিয়া মুক্তিযুদ্ধের বাঙালি-জাতিতাত্ত্বিক চেতনা জাতির মগজ ও মনন হতে দূর করার লক্ষ্যে ইতিহাস বিকৃতির অংশ হিসেবে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।

বিকৃতির বিপন্ন ধারায় সময়ের আবর্তে বাঙালি চেতনাবিরোধী একটি বলয়-গোষ্ঠী রীতিমতো এদেশে গড়ে ওঠে যাদের সংখ্যা যথেষ্ট এবং যারা এ স্লোগানটিকে চর্চা তো দূরের কথা স্বীকারই করে না। এমনকি সমসাময়িক কালে সাধারণ পাঠ্যপুস্তকেও এটার প্রতি যথেষ্ট অবজ্ঞা পরিলক্ষিত হয়। উল্লেখ্য, ‘জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড’ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রণীত উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণির ‘ইংলিশ ফর টু ডে’ পাঠ্যবইটিতে ইংরেজি পরিভাষায় ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ সন্নিবেশ করা হয়েছে।

কিন্তু প্রণীত ভাষণটির শেষাংশে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটিকে বাদ দেয়া হয়েছিল। পরবর্তীতে গণমাধ্যমে (দৈনিক জনকণ্ঠ ০২/১০/২০২১ তারিখ) এই নিবন্ধকার কর্তৃক বিষয়টি তুলে ধরার পর ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটি সংযোজন করা হয়। এ ছাড়া বিএনপি জামায়াত সহ কিছু গোষ্ঠী তাদের রাজনৈতিক দর্শনে ও কালচারে এটাকে স্বীকার করে না। সর্বশেষ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী বশির আহমেদ ২০১৭ সালে ‘জয় বাংলা’ কে জাতীয় স্লোগান করতে মহামান্য উচ্চ আদালতে রিট দায়ের করেন। উক্ত রিটের প্রেক্ষিতে মহামান্য উচ্চ আদালত ২০২০ সালের ১০ মার্চ বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল হাসান ও বিচারপতি কে এম কামরুল কাদেরের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ থেকে ‘জয় বাংলা’ কে জাতীয় স্লোগান করতে রায় প্রদান করেন। রায়ে সাংবিধানিক পদাধিকারগণ, রাষ্ট্রীয় সকল কর্মকর্তাদের অনুষ্ঠানের বক্তব্য শেষে ‘ জয় বাংলা’ স্লোগান উচ্চারণ করতে বলা হয়।

এমনকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আ্য্যসেম্বলি শেষে স্লোগানটি বলতে বলা হয়। পরে ২০২২ সালের ২ মার্চ মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ কর্তৃক এ সংক্রান্ত গেজেট প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। দুঃখজনকভাবে আজো সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রগুলোর অধিকাংশ স্থানে এ নির্দেশনা পালন করা হয় না। এমনকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আ্যাাসেম্বলিতে পঠনীয় শপথ বাক্যেও ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটিকে সংযোজন করা হয়নি। বহু সরকারি কর্মকর্তা এবং উচ্চপদস্থ আমলারাও তাদের আনুষ্ঠানিক সভা সেমিনারে বক্তব্য শেষে এটি উচ্চারণ করেন না যা রাষ্ট্রীয় আদেশ অবজ্ঞার শামিল। সবচেয়ে বড় দুঃখজনক বিষয় হলো, সাংবিধানিক পদাধিকারী কেউ কেউ তাদের আনুষ্ঠানিক বক্তব্য শেষে ‘জয় বাংলা’ বলেন না।

যেখানে মহামান্য রাষ্ট্রপতি স্লোগানটিকে যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করেন সেখানে তারা কিভাবে এটাকে উপেক্ষা করছেন? বলাবাহুল্য, এটা তো নির্দিষ্ট কোনো দলীয় বা রাজনৈতিক স্লোগান নয়। এটি একটি সর্বজনীন রাষ্ট্রীয় স্লোগান। তবে কেন তারা এমনটি করছেন? তবে তারা কি কোনো গোষ্ঠীবর্গের কাছে নিজের নিরপেক্ষতা প্রমাণ করতে এমনটি করছেন? যদি তাই হয় তবে জাতীয় তথা রাষ্ট্রীয় বিষয়কে অস্বীকার করে নিরপেক্ষতার প্রমাণ কতটুকু নীতিসঙ্গত, যুক্তিসঙ্গত ও আইনসিদ্ধ? এ দায় তারা এড়াতে পারেন কি? কিন্তু কেন এমন অবজ্ঞা? রাষ্ট্রের এমন উচ্চ স্তরগুলোতেই যদি এমনটি ঘটে তবে প্রজন্ম কি শিখছে?

জাতি কি ম্যাসেজ পাচ্ছে? সংশ্লিষ্ট সবস্তরে এ জাতীয় স্লোগানকে প্রতিপালন ও চর্চার বিষয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর যথাযথ মনিটরিং জোরদার করা উচিত। একই সঙ্গে জাতীয় স্বার্থে এ বিষয়ে জনসচেতনতা সৃষ্টিতে গণমাধ্যমগুলোরও আরও কার্যকর ভূমিকা থাকা উচিত বলে মনে করি। আমাদের মনে রাখা উচিত ‘জয় বাংলা’ আমাদের ‘স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব’ এর চিরজীবন্ত স্পন্দন।

লেখক: সাংস্কৃতিক সম্পাদক (সাবেক); গবেষণা ও প্রচার সম্পাদক (প্রস্তাবিত);

সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম মুক্তিযুদ্ধ ’৭১, যশোর

নয়া শতাব্দী/আরজে

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ