ঢাকা, রোববার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মৌলবাদ পিতৃতন্ত্র নারীবাদ ও সমঅধিকার

প্রকাশনার সময়: ১০ মার্চ ২০২৪, ০৭:৫৬

বর্তমান সমাজে সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে যে বিষয়গুলোর পক্ষ-বিপক্ষ নিয়ে যুক্তিতর্ক করতে দেখা যায়, তাদের মধ্যে অন্যতম হলো মৌলবাদ, পিতৃতন্ত্র এবং নারীবাদ। এ বিষয়গুলোর মৌলিক সংজ্ঞাগুলো কী? এ বিষয়গুলোর কতখানি নেতি ও ইতিবাচক প্রভাব সমাজে ফেলে তা দেখার বিষয়।

মৌলবাদ (ইংরেজি Fundamentalism) হচ্ছে ধর্মীয় মতবাদগুলোর কঠোর অনুগমনের চাহিদা, আবার মৌলবাদ দিয়ে বুঝায় ধর্মতত্ত্বের সহায়ক একটি কর্ম কখনো কখনো এটাই আবার উদার ধর্মতত্ত্বের বিরুদ্ধে একটি প্রতিক্রিয়া। মৌলবাদ শব্দটির সাধারণ অন্য অর্থ হলো মূলজাত। এখানে মূল শব্দটি দ্বারা ধর্মকে বুঝানো হচ্ছে।

মৌলবাদ বা Fundamentalism শব্দটি সর্বপ্রথম ১৯২২ সালে আমেরিকায় ব্যবহূত হয়। উনিশ শতকের শেষের দিকে ও বিশ শতকের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রের খ্রিস্টীয় মৌলবাদ লক্ষ করা যায়। খ্রিস্ট মৌলবাদীরা প্রচণ্ডভাবে আধুনিক নব্য প্রবর্তিত রীতি-নীতিগুলোকে বিরোধিতা করে। কারণ তারা মনে করেন আধুনিক পন্থিরা তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসে বাইবেলের বিশ্বস্ততা ও সঠিকতার ভিত্তি দুর্বল করছে। খ্রিস্টীয় মৌলবাদের আগ্রাসনের ফলে বর্তমানে নৃ-তাত্ত্বিক গোষ্ঠীর ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতি বিলোপের পথে ধাবিত হচ্ছে। খ্রিস্টীয় মৌলবাদীরা পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে নানা প্রলোভনে প্রলোভিত করে কম সংখ্যায় ধর্মপালনকারী আদিবাসীদের খ্রিস্টান বানাচ্ছেন। এর ফলে পৃথিবীর ধর্মীয় বৈচিত্র্যতা লোপ পাচ্ছে সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছে আঞ্চলিক ভাষা ও সংস্কৃতি।

ধর্মীয় মৌলবাদী ধ্যান-ধারণা অনুশীলনের ক্ষেত্রে ইহুদিদের সংখ্যা অন্য ধর্মের চেয়ে অনেক বেশি। ইহুদিরা সবচেয়ে বেশি ধর্মীয় মৌলবাদে প্রভাবিত হয়ে জঙ্গি মনোভাব সম্পন্ন হয়। ধর্মীয় ও রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে ইহুদিবাদকে সবচেয়ে বেশি জঙ্গিবাদী সহিংস হিসেবে বিবেচনা করা যায়। ইহুদিবাদীরা তাদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ তৌরাত এবং তালমুদে উল্লিখিত ধর্মীয় আইন ও নৈতিক নির্দেশনাকে কঠোরভাবে মেনে চলার ওপর গুরুত্ব দেয়। এ নির্দেশ অমান্যকারীদের ইহুদিরা সমাজচ্যুত করে।

পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশিকতাবাদ, সাম্র্রাজ্যবাদী যুদ্ধ, গণ দারিদ্র্য এবং সামাজিক, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে স্থানচ্যুতির প্রেক্ষাপটের বিরুদ্ধে ‘শুদ্ধি’ নামে হিন্দু মৌলবাদী এ আন্দোলন শুরু হয়। এ আন্দোলনটি গড়ে ওঠে দয়নিন্দ সরস্বতীর নেতৃত্বে। শুদ্ধি আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল ইসলামসহ অন্যান্য ধর্মে পূর্বে যে সকল হিন্দু ধর্ম পালনকারীরা ধর্মান্তরিত হয়েছিল তাদেরকে শুদ্ধ করে পুনরায় হিন্দুধর্মে ফিরে নিয়ে আসা।

তবে এ আন্দোলন রুখতে ইসলাম ধর্মপালনকারীরা তাবলিগ জামাত শুরু করে এবং দরিদ্র ইসলাম ধর্মপালনকারীরা ইসলাম ধর্ম থেকে বিচ্যুত যাতে না হয় এর প্রেক্ষিতে নানা বয়ান করেন। তারা বয়ান দেন যে, ইহজগতে দুঃখ কষ্ট করলে পরজগতে (মৃত্যুর পর) সুখ ভোগ করবে। তবে বর্তমানে ভারতে রাজনৈতিক মোড়কে হিন্দু মৌলবাদের বিস্তার ঘটাচ্ছে নরেন্দ্র মোদি, প্রকৃতার্থে মোদির মৌলবাদী প্রচারণাটা হিন্দু ধর্মের স্বার্থে নয়। এটা তার রাজনৈতিক স্বার্থ। নিজ ক্ষমতায় টিকে থাকার লক্ষ্যে তিনি হিন্দু ধর্মকে ব্যবহার করছেন।

ইসলাম ধর্মের মৌলবাদের উত্থান ইরানে। ইরানে ইসলামি বিপ্লব সম্পন্ন হয়, যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত রেজা শাহ পাহলবীকে (১৯১৯-৮০) ক্ষমতাচ্যুত করে। ইরানের বিপ্লব জনপ্রিয় হওয়ার মূল কারণ ছিল ইরানকে বিদেশি প্রভাবমুক্ত করা। আর এভাবে ইরানে ইসলামিক প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা। ধর্মীয় রাজনৈতিক বলয়ে বিদেশি প্রভুকে উচ্ছেদ করায়, সাধারণ মানুষ এ রাজনৈতিক আন্দোলনকে স্বাগত জানায়। তবে বর্তমানে ইসলামি বিপ্লবের নামে পৃথিবীর দেশে দেশে জঙ্গিগোষ্ঠী জন্ম নিচ্ছে।

৯০ দশকে সমাজতান্ত্রিক ধারাকে অবলোপন করার লক্ষ্যে পুঁজিবাদী আমেরিকা ইসলামি মৌলবাদের শিকড়ে রসের জোগানদার হয়ে ওঠে। পরবর্তী সময়ে ইসলামি মৌলবাদ সারা দুনিয়ায় মাথাচারা দিয়ে ওঠে। এরা ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করে নাই এদের লক্ষ্য ক্ষমতায় বসার। পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের অর্থনীতির বিধ্বস্ততার জন্য দায়ী মৌলবাদীদের ক্ষমতার রাজনীতি। আইএস, আল কায়দা , বাংলাদেশে বাংলা ভাই, হিজবুত তাহরিন, হেফাজতে ইসলাম সহ কিছু সংগঠন যারা সামাজিক শান্তির চরম অবনতি ঘটাচ্ছে।

মৌলবাদ শব্দের আভিধানিক অর্থ কোনো মতবাদের অবিকৃত মূলতত্ত্ব। যে কোনো বিশ্বাস, মতবাদ, আইনের সম্পুর্ণ পথ অনুুসারী হওয়াই মৌলবাদ। মৌলবাদের নানা প্রকারভেদ রয়েছে। সমাজে কোনো বিষয়ই স্থির না। তাই পথানুসরণটা অনেক সময় স্থান কাল পাত্র বিশেষের জন্য অনুপযোগী বলে প্রমাণ হয়।

ইসলামি মৌলবাদীরা নারীদেরকে হিজাবাবৃত করে রাখে। তার কারণ ইসলামের উৎপত্তিস্থল সৌদি আরব। সৌদি আরবের উষ্ণ আবহাওয়ার জন্য সমস্ত শরীর হিজাব বা কাপড়ে আবৃত রাখে ওই অঞ্চলের মানুষরা, এটা তাদের পরিবেশের অনুকূল পোশাকব্যবস্থা। এখন ইসলামি মৌলবাদী অনুসরণের ফলে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলের নারীরাও হিজাব আবৃত হয়ে চলাফেরা করে যা পরিবেশ প্রতিকূল পোশাকব্যবস্থা। এটা নারীর শারীরিক ও মানসিক সমস্যার সৃষ্টি করে। ধর্ম তার উৎপত্তিস্থল থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে। তবে ধর্মের জন পালনীয় প্রথাগুলো জন্ম ধর্ম উৎপত্তিস্থলের পরিবেশ আবহাওয়ার সঙ্গে মিল রেখে নির্ধারণ করা হয়েছিল। তাই মৌলবাদ অনুসরণের ফলে ওই প্রথাগুলো মানার জন্য পরিবেশ, আবহাওয়া ও সংস্কৃতির প্রতিকূলে কিছু কাজ মৌলবাদ অনুসরণকারীদের। যার জন্য দেখা যায় যে, অনুসরণকারীদের মাঝে এক ধরনের মনোবৈকল্যতা সৃষ্টি করে যা সমাজের জন্য বা অন্য মানুষের জন্য অমঙ্গল বয়ে আনে। উদাহরণ হিসেবে দেখা যায়, ইসলাম ধর্ম অনুসরণকারী একজন পুরুষ মানুষ প্রস্রাবের পর মাটির টুকরো নিয়ে রাস্তায় চল্লিশ পদক্ষেপ হাঁটেন, যা অত্যন্ত দৃষ্টিকটু ব্যবস্থা, এই হাঁটার সময় তাকে হিজাব ধারনকারী নারীরাও দেখেন। কিসে ধরে তিনি হাঁটছেন ওই নারীরাও তা অনুধাবন করতে পারেন।

পুরুষের প্রস্রাবের পর মাটির টুকরো নিয়ে হাঁটাকে বলা হয় ঢিলাকুলুপ নেয়া। এ ঢিলাকুলুপ প্রথা চালু হয় সৌদি আরবে। তার কারণ মরুভূমিতে পানি ছিল না ফলে শৌচ ব্যবস্থার জন্য মাটির ব্যবহারটা ছিল খুবই প্রয়োজনীয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে পানির অভাব নাই সুতরাং এখানে শৌচ ব্যবস্থার জন্য মাটির কি আদৌ প্রয়োজন আছে?

স্ব স্ব অঞ্চলের আবহাওয়া, জলবায়ু, সংস্কৃতি, খাদ্যাভ্যাসের সঙ্গে মিল রেখে ধর্ম পালন করা উচিত। কোরবানি প্রথার উৎপত্তি সৌদি আরব থেকে। ওই সময় সৌদিতে দুম্বা বা উট কোরবানি দিত। ওই অঞ্চলে গরু ছিল না। বর্তমানে ভারতীয় উপমহাদেশের সব অঞ্চলেই গরুকে কোরবানির পশু হিসেবে ব্যবহার করা হয়।

পিতৃতন্ত্রের বা পুরুষকেন্দ্রিক শাসনের জাঁতাকলে পিষ্ঠ হয়ে নারীরা প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। আর এই প্রতিবাদী রূপটি নারীবাদ হিসেবে অভিহিত হয়ে যায়। নারীবাদ শব্দটির ইংরেজি প্রতিশব্দ Feminism। এ শব্দটি এসেছে ফরাসি শব্দ থেকে। Femme শব্দটির অর্থ নারী isme শব্দটির অর্থ মতবাদ। নারীবাদী Christina Hoff Sommers এর মতে, নারীবাদ হচ্ছে ‘A concern for women and a determination to see them fairly treated.’ কমলা বাসিন ও নিগাদ সৈয়দ খান তাদের ওয়ার্কসপ অব সাউথ এশিয়ান উমেন এ নারী সম্পর্কে বলেন ‘An awareness of women’s oppression and exploitation in society, at work and within the family and conscious action by women and men to change this situation.’

তবে নারীবাদেরও অপব্যবহার শুরু হয়। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে নারীর স্বাধীনতা নামে নারীও হয়ে ওঠে বিজ্ঞাপন পণ্য। নারীবাদের নামে সাউথ এশিয়ায় এনজিওরা ব্যাপক বাণিজ্য করে, প্রকৃতার্থে এ আন্দালন করে নারীরা তাদের কাঙ্ক্ষিত অধিকার পায় নাই। ধর্মভিত্তিক নারীর উত্তরাধিকারের বিষয়টি রদ বা বাতিল করার জন্য এনজিওরা আন্দোলন করে নাই।

তাছাড়া নারীরা একজন মানুষ হিসেবে সমঅধিকার পাক সেই স্ল্লোগানটি কোন নারীবাদী বিদেশি সাহায্যপুষ্ট এনজিও ওয়ালারা রাস্তায় প্রতিষ্ঠার জন্য কঠোর আন্দোলনের জন্য নামে নাই মাঠে। কথিত নারীবাদটাও অধিকারের নামে নারীকে রাস্তায় নামিয়ে এ দিয়ে বিদেশি সাহায্য পাওয়ার একটি নব্য কৌশল। প্রকারান্তরে বলা যায়, এদেশের এনজিওরা স্বেতভাবে নারীকে শোষণ করছে।

এনজিওর অভ্যন্তরে নারী নির্যাতনের বিভৎস চিত্র রয়েছে, যা পলেস্তারণে ঢাকা। এ নির্যাতনের চিত্রটা বাহির থেকে দেখা বা উপলব্ধি করা যায় না। বিদেশি অর্থ খেয়ে এনজিওরা এদেশে নারীদেরকে কতটুকু সচেতন করতে পেরেছে বা কতটুকু অধিকার আদায়ের সমর্থ হয়েছে, তা বর্তমান সমাজের হিজাব ব্যবস্থাটা দেখলেই বোঝা যায়। এনজিওরা এদেশে নারীদের অধিকার আদায় তো দূরের কথা, কোনো নারীকে এরা সামাজিকভাবে সচেতন করতে পারে নাই।

তথাকথিত কিছু নারীবাদী আছেন, তারা পুরুষ ও নারীর মাঝে দ্বন্দ্ব সৃষ্টির একটি প্রচেষ্টা চালাচ্ছে, তাদের মধ্যে অন্যতম হলো তসলিমা নাসরিন। তসলিমা নাসরিন তার একটি কবিতার বই লিখেছেন, ‘সাবধান কুকুর যাচ্ছে তার শরীরে র‍্যাবিশ আছে, সাবধান পুরুষ যাচ্ছে তাদের শরীরে সিফলিস আছে’। এটা কি কোনো নারী অধিকারের আদায়ের ভাষা হলো? তার প্রতিটি কবিতা বা লেখায় এ ধরনের বিদ্বেষমূলক লেখা উল্লেখ থাকে। যা সমাজ তথা পরিবারের জন্য হিতকর ব্যবস্থা বয়ে আনে না।

সত্যিকারার্থে মৌলবাদ, পিতৃতন্ত্র, নারীবাদ তিনটি বাদই ভোগবাদীদের ভোগ, বৈষম্য ও শোষণ টিকিয়ে রাখার পর্যায়ক্রমিক ধাপ। তাই এ ব্যবস্থা নির্মূল করা প্রয়োজন।

কার্ল মার্কস, ফ্রেডারিক এঙ্গেলস এর মার্কসবাদী মতাদর্শকে নারীবাদের মূল ভিত্তি হিসেবে ধরা যায়। লেনিন, অগাষ্ট বেবেল, ক্লারা জেটক্লিন, আলেকজান্ডার কোলনতাই প্রমুখ মার্কবাদী তাত্ত্বিকরা মার্কসবাদকেই নারীবাদের ভিত্তি হিসেবে মনে করেছেন। এ তাত্ত্বিকরা শ্রেণিবৈষম্যকে চিহ্নিত করেছেন নারী নির্যাতনের মূল কারণ হিসেবে। পুঁজিবাদকে বিতাড়িত করে শোষণহীন সমাজব্যবস্থা নির্মান করতে পারলে নারী মুক্তি সম্ভব। কারণ নারীর মুক্তির আন্দোলন পুরুষের বিরুদ্ধে নয়। নারীর সমঅধিকার ও মুক্তির আন্দোলনের মূল লক্ষ্য পুঁজিবাদী ব্যবস্থা এবং পুরুষতান্ত্রিক পুঁজিবাদী সামাজিক সম্পর্কটা উচ্ছেদ করা।

লেখক: কলামিস্ট

নয়া শতাব্দী/আরজে

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ