ঢাকা, রোববার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

উন্নয়ন-অগ্রযাত্রায় সমঅংশীদার নারী

প্রকাশনার সময়: ০৮ মার্চ ২০২৪, ০৭:৪৮

কবি উইলিয়াম গোল্ডিং এর নারীর মূল্য কবিতার বাংলা অনুবাদ এ রকম, ‘আমি মনে করি, নারীরা একটু বোকা ধরনের হয়/ নইলে নিজেদের তারা পুরুষের সমান ভাববে কেন?/তারা পুরুষদের চেয়ে অনেক অনেক উন্নত এবং সর্বকালের জন্য, চিরকালের জন্য তাই সত্য।/নারীকে যাই দাও না কেন, সে তাকে বাড়িয়ে তুলবে।/যদি একটি শুক্রাণু দাও তাকে, সে দেবে সন্তান।/যদি একটি ঘর দিতে পারো তাকে, সে দেবে সংসার।

মুদির দোকান থেকে চাল, ডাল, তেল, নুন এনে দাও/সে তোমাকে চমৎকার খাবার রান্না করে খাওয়াবে। একটি হাসির বিনিময়ে সে তোমাকে দেবে হূদয়। সে ছোটকে বড় এবং কমকে বেশি করতে জানে। আরও দুই লাইন রয়েছে। কবির নারী সম্পর্কিত বর্ণনায় এত উঁচুতে স্থান দেয়া হয়েছে যে প্রকৃতপক্ষে আর কিছু বলার প্রয়োজন হয় না। ‘মা, বোন, স্ত্রী অথবা কন্যা, যে রূপেই হোক না কেন, নারীর প্রেম পুরুষের প্রেম অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ ও পবিত্র।’— উক্তিটি করেছেন। এইচ. জি. লরেন্স। নারী যা অবারিতভাবে দেয়, পুরুষ তা কার্পণ্য করে।

প্রকৃতির শ্রেষ্ঠ উপহার নারী। আজকের এ সফলতায় যেমন পুরুষের অবদান রয়েছে তেমনি রয়েছে নারীদের অবদান। এই অবদান মনে করিয়ে দেয়, ‘এ বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর, অর্ধেক তার গড়িয়াছে নারী আর অর্ধেক তার নর’— কবি কাজী নজরুল ইসলামের লেখা এই কবিতার লাইন। পৃথিবীর মঙ্গলময় সৃষ্টিতে নারীর রয়েছে সমান অবদান। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীরা কিন্তু অতীতকাল থেকেই অবহেলিত। অথচ আমরা নারীর ওপর সহিংসতার আগে ভুলেই যাই যে, এ রকমই কোনো নারীর দশ মাস দশ দিন গর্ভে ধারণ করা তীব্র যন্ত্রণা হাসিমুখে সহ্য করার কারণেই আজ আমরা এ পৃথিবীতে। পৃথিবীতে আজ আমার যে অধিকার বলে চিৎকার করি সে অধিকার আদায়ের শুরুটা পৃথিবীর আলো দেখিয়ে একজন নারীই করেছে।

দিন বদলের সঙ্গে সঙ্গে নারীদের আত্মপ্রকাশের সুযোগ তৈরি করে নিতে কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছে। নারীর কাজ যে শুধু সন্তান জন্মদান নয় তা বোঝাতেই কেটে গেছে অনেক বছর। নারীদের কাজের ক্ষেত্র বেড়েছে। ঘরের কোণ থেকে বের হয়ে আজ মহাশূন্য পর্যন্ত তাদের পদচিহ্ন রাখছে সফলতার সঙ্গে। তবে কাজের ক্ষেত্র বাড়লেও কমেনি নারীর ওপর সহিংসতার হার। বরং দিন দিন সহিংসতার নতুন নতুন ঘৃণ্য রূপ সমাজকে প্রত্যক্ষ করতে হচ্ছে।

যে সহিংসতা থেকে বাদ পড়ছে না তিন থেকে ৩০ বা তদুর্ধ্ব বয়সি নারীরা। তাদের ধর্ষণ করা হচ্ছে, কুপিয়ে রাস্তায় ফেলে রাখা হচ্ছে, বাসে গণধর্ষণ শেষে ফেলে দেয়া হচ্ছে। এতসব করেও নারীরা আমাদের উন্নয়নের অগ্রযাত্রার সমান অংশীদার। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার অর্ধেক শক্তি। নারী শক্তি বাদ দিয়ে দেশের অগ্রযাত্রা অসম্ভব।

নারীর মেধা এবং পারদর্শিতার স্বীকৃতি দিতে কার্পণ্য করা ব্যক্তির এ সমাজে অভাব নেই। অধিকার ফলানোতেই যেন তাদের আনন্দ সীমাবদ্ধ। বাল্যবিয়ে, যৌতুক, ধর্ষণ, রাস্তাঘাটে যৌন হয়রানি, স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে নিগ্রহ, পরিবারে অনিশ্চয়তা সব কিছু মিলিয়ে প্রতিটি ক্ষেত্রই যেন নারীদের জন্য ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে। মূলত বাল্যবিয়ে এবং যৌতুক নামক এক ভয়ঙ্কর প্রাচীন কিন্তু আধুনিক জীবনের আদিমতা থেকে আজও এ বিশ্ব বের হতে পারেনি। কারণ শুধু বাংলাদেশ নয় ভারত, পাকিস্তান সহ অনুন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর উন্নয়নের প্রধান বাধা এ বাল্যবিয়ে এবং যৌতুক প্রথা। কিছু মানুষের বর্বরতায় কলুষিত হচ্ছে সমাজ জাতি দেশ।

ধর্ষণ নামক এক নোংরা মানসিকতায় সমাজের কিছু মানুষ আনন্দ খুঁজে নিচ্ছে। তারা ধর্ষণ করে চলেছে প্রতিনিয়ত। সেখানে কোনো মায়া নেই, মানবিকতা নেই, কোনো সংকীর্ণতাবোধ নেই। তিন বছর থেকে শুরু করে সব বয়সি নারীরা ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। এটা এমনভাবে বেড়ে চলেছে যে প্রতিদিন পত্রিকা খুললেই কয়েকটি করে ধর্ষণের খবর মিলছে। এটা তো গেল পত্রিকায় যা আসছে তার কথা। তার বাইরেও তো নারীদের ওপর অত্যাচার হচ্ছে।

যেগুলো অনেক সময় লোকচক্ষুর অন্তরালেই থেকে যাচ্ছে। সেসব যোগ করলে অনেকটা ভয়ঙ্কর শোনায়। প্রতিদিন প্রতিমাস এমনকি প্রতিবছর এ সংখ্যা বেড়ে চলেছে। ধিক্কার উঠছে তাদের ঘিরে তবে সেইসব নপুংসকদের মানসিকতায় পরিবর্তন ঘটানো যাচ্ছে না। তাদের কর্ণ কুহরে আমাদের ঘৃণার বাণী পৌঁছানো যাচ্ছে না। তাদের মনে ঘৃণ্য দরজায় শুধু অন্ধকার।

নপুংসকদের কামনার আগুনে দাউ দাউ করে জ্বলছে বিবেকপূর্ণ সমাজ। নিরাপদ করতে চেয়েও পারছি না। বাসযোগ্য করতে গিয়ে বারবার এই সব বোধহীন, রুচিহীন মানুষেরা মুখোশ খুলে বেরিয়ে আসছে। জানি না আর কত দূর সে পথ যেখানে শুধু সভ্য সমাজের সভ্য মানুষরাই থাকবে। কঠোর আইন রয়েছে, নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে গণসচেতনতা জোরদার হয়েছে তবুও যেন এ ধরনের বিকৃত মানুষদের হাত থেকে রক্ষা করা যাচ্ছে না নারীদের।

বারবার বিবেকের দংশনে দগ্ধ হতে হচ্ছে আমাদের। তবে আমরাও হেরে যাব না। একদিন না একদিন এ পৃথিবী নারী-পুরুষ সবার জন্য সমান সুযোগ-সুবিধা দিয়ে বাসযোগ্য করে যাব। আমরা ততদিন প্রতিবাদ করে যাব, যতদিন পৃথিবীর কোনো না কোনো প্রান্তে নারীর ওপর নির্যাতন বন্ধ না হয়।

নারীর ওপর নির্যাতন করার আগে ভাবতে হবে নারীর প্রতি আমার দায়িত্ব নির্যাতন নয় বরং অধিকার নিশ্চিত করা। পেশিশক্তির যুগে নারীর ওপর পেশিশক্তি দেখানোর ভিতর কোনো বীরত্ব নেই। বীরত্ব তো শুধু ভালোবাসায়। কোনো সত্যিকারের পুরুষ তার পৌরুষত্ব ঘৃণ্যভাবে ফলানোর চেষ্টা করে না। পুরুষ তো সে যে তার পৌরুষত্বকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।

যে সবার দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে পারে। তাই নারীর প্রতি আর সহিংসতা নয়। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে নারীদের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ সমরে অংশ নেয়ার উদাহরণ থেকেই দেশের কাজে তাদের সর্বোচ্চ অবদানের প্রমাণ পাওয়া যায়। আমাদের স্বাধীনতার পেছনে রয়েছে লাখ লাখ নারীর সম্ভ্রম।

বিভিন্ন ক্ষেত্রে পুরুষদের ছাড়িয়ে গেছে নারীরা। পাস করা শিক্ষার্থীর ক্ষেত্রেও নারীর সংখ্যাই বেশি। ক্রমশই এই হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। মূলত দয়া নয় অধিকারের দৃষ্টিতে দেখার অভ্যাস করতে হবে নারীদের। সেই অভ্যাসটা পরিবার থেকেই তৈরি করতে হবে। পরিবারেই যদি মেয়েদের নেতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হয় বা কোনো পুরুষ সদস্যের সঙ্গে তুলনায় খাটো করা হয় তাহলে সমাজেও তার প্রভাব পড়ে।

যতদিন বাসে, অফিসে, রাস্তায় সব সময় নারী নিরাপত্তাহীনতায় ভুগবে এবং তাদের নিরাপত্তা পেতে আলাদা কোনো সাহায্য প্রয়োজন হবে ততদিন পার্থক্য সুস্পষ্ট থেকে যাবে। নারী নির্যাতন প্রতিরোধ করতে হলে সমাজের একবারে প্রান্তিক শ্রেণি থেকে তার পরিবেশ তৈরি করতে হবে। বাল্যবিয়ে নামক ব্যাধি গ্রামেগঞ্জে ছড়িয়ে আছে। জেএসসি পরীক্ষার সময় দেখা যায় পত্রিকায় অনুপস্থিত মেয়েদের বেশিরভাগই বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে।

এমনকি পিইসি পরীক্ষায় অনুপস্থিত অনেক মেয়ের ক্ষেত্রেই ভাগ্যের এই নির্মম পরিহাসটি ঘটে। যেখানে একজন ছেলে সন্তানের পরিবার থেকে লক্ষ্য ঠিক করে দেয়া হয় লেখাপড়া করে চাকরি করা। সেখানে মেয়ের ক্ষেত্রে ঠিক বিপরীত। স্বামী সন্তান নিয়ে যত তাড়াতাড়ি ঘর কন্যার কাজে লেগে পড়া যায় ততই মঙ্গল! এটাই বিপরীত চিত্র। এবং আমাদের দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে নিত্য ঘটনা। কিন্তু উন্নয়ন করতে হলে এসব অবশ্যই প্রতিরোধ করতে হবে।

আবার বিয়ের পর যৌতুকের কারণে নির্যাতনের শিকার হওয়ার চিত্রও প্রায়ই দেখা যায়। যদিও এসব অপরাধ প্রতিরোধে আইন আছে এবং অনেকের ক্ষেত্রে শাস্তির ঘটনাও ঘটছে কিন্তু সমস্যা কমছে না। আমরা চাই সমাজে প্রতিটি ক্ষেত্রই নারীদের চলাচল এবং বসবাসের জন্য হবে নির্বিঘ্ন। যার নিশ্চিত পরিবেশ আমাদেরই তৈরি করতে হবে। নারীর প্রকৃত মূল্য নারীকে দিতে হবে। পরিশেষে কবি কাজী নজরুলের নারী কবিতার অংশ দিয়ে শেষ করি।’ এ বিশ্বে যত ফুটিয়াছে ফুল, ফলিয়াছে যত ফল/নারী দিল তাহে রূপ-রস-মধু-গন্ধ সুনির্মল।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

নয়া শতাব্দী/আরজে

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ