ঢাকা, সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল

প্রকাশনার সময়: ০৭ মার্চ ২০২৪, ০৭:৩১

৭মার্চের ভাষণটি নিয়ে অজস্র লেখালেখি হয়েছে। বহু কৃতী মানুষ গুণী লেখক এর চুলচেরা বিশ্লেষণ করেছেন। এ নিয়ে তবু কথা হবে। এটাই ইতিহাসের নিয়ম। আমি মনে করি এর বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে বাঙালির সাধনা ও স্বপ্নের বাস্তবায়নের সফল ডাক। এর আগে আরেক বাঙালি নেতা নেতাজী সুভাষ বোসও ডাক দিয়েছিলেন। ইংরেজ শাসন শোষণের অবসানের জন্য তিনি বলেছিলেন, ‘তোমরা আমাকে রক্ত দাও আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব।’ সুভাষ বসুর ডাক সফল হলেও স্বাধীনতা ধরা দেয়নি।

বহু বছর পর আমাদের নেতা বঙ্গবন্ধু ডাক দিয়েছিলেন, ‘রক্ত যখন দিয়েছি তখন আরও রক্ত দেব, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ।’ তার ডাক শুধু নয় সংগ্রামও সফল হয়েছিল। বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রটি মূলত ৭ মার্চের ডাকের এক ফসল। নয় মাস রক্তমাখা যুদ্ধ আর লাখো প্রাণের বিনিময়ে এসেছিল আমাদের এ স্বাধীনতা। আমরা যারা একাত্তর দেখেছি আমাদের অজানা নয় কেমন ছিল উত্তাল মার্চের দিনগুলো। ঘরে ঘরে মুক্তিকামী বাঙালি তখন মনে মনে প্রস্তুত, কী বলবেন নেতা? কী ডাক দেবেন এবার? মার্চের শুরুতেই অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন এবং ৭ মার্চ তৎকালীন রমনা রেসকোর্স মাঠে সর্বস্তরীয় জনসভার ডাক দেন। রিপোর্টারদের কেউ কেউ জিগ্যেস করেন, ‘আপনি কি সেদিন একতরফা স্বাধীনতার ঘোষণা দেবেন?’

উত্তরে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘অপেক্ষা করুন, আমার জনগণ আমার সঙ্গে আছে। আমরা শান্তিপূর্ণ সমাধান চাই। আমরা ভালোর আশা করছি তবে মন্দের জন্যও প্রস্তুত আছি। বাংলাদেশের জনগণের অধিকার আদায়ের লড়াই চলবে। বাংলাদেশের মানুষের মুক্তির জন্য কোনো ত্যাগই বড় নয়।’ নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ৭ মার্চের ভাষণের ভিডিওটি রেকর্ড করেছিলেন প্রখ্যাত অভিনেতা আবুল খায়ের। তিনি আওয়ামী লীগের টিকিটে ফরিদপুর-৫ সংসদীয় আসন থেকে এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন আবার একইসঙ্গে ছিলেন পাকিস্তান সরকারের চলচ্চিত্র বিভাগের পরিচালক। ভাষণের অডিওটি রেকর্ড করেছিলেন এইচ. এন. খোন্দকার। পরে সেটি আবুল খায়েরের মালিকানাধীন রেকর্ড লেভেল ঢাকা আর্কাইভ করেছিল। আর্কাইভের পরে অডিও ও ভিডিও রেকর্ডিংয়ের এক কপি বঙ্গবন্ধুকে প্রদান করা হয় এবং এক কপি ভারতে পাঠিয়ে দেয়া হয়। ভারতের এইচএমভি রেকর্ড সেটি আর্কাইভ করে তিন হাজার অনুলিপি তৈরি করে। পরে সেগুলো বিশ্বজুড়ে বিতরণ করা হয়।

বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি পাকিস্তান সরকার ৭ তারিখে প্রচারের অনুমতি দেয়নি। চাপের মুখে পড়ে অনুমতি দেয়া হয়েছিল একদিন পরে। দেশবাসী সেটি শুনেছিলেন পরের দিন। মুক্তিযুদ্ধে যোদ্ধাদের অনুপ্রেরণা জোগাত এ ভাষণ। প্রতিটি বাঙালির রন্ধ্রে সংগ্রামের বহ্নি জ্বেলে দেয় এ ভাষণ। ক্যাপ্টেন মনসুর আলী এ ভাষণের রেকর্ড বাজিয়ে বাজিয়ে গ্রামে গ্রামে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধা সংগ্রহ করতেন। পৃথিবীর প্রতিটি সংগ্রামী, শাসিত-শোষিতের অনুপ্রেরণা বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ।

এরপরও আমাদের দেশের ব্যর্থ রাজনীতি এ নিয়ে তর্ক করে। আজ তাদের টিকি মেলা ভার। যারা মনে করেন তারা শুধু সরকারি চাপের কারণে অসফল তারা ইতিহাস বোঝেন না। বিএনপি যদি স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে তর্ক না করত এবং স্বাধীনতার ঘোষক বিতর্ক না তুলত ইতিহাস তাদের কোন পথে নিয়ে যেত বলা মুশকিল। কিন্তু যে রাজনীতি ৭ মার্চের মতো দিনটিকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করে তাকে সময় ছেড়ে কথা বলবে কোন দুঃখে? সে কারণেই তাদের ভ্রান্ত রাজনীতি মিথ্যার পথে থেকে সর্বস্বান্ত হওয়ার পথে। অথচ এই ৭ মার্চ আমাদের কি দেয়নি?

এই ভাষণে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের শাসকদের বিরুদ্ধে বললেও গণতন্ত্রের কথা ভোলেননি। যে কারণে তিনি বলেছিলেন: কেউ যদি ন্যায্য কথা বলে, সে যদি সংখ্যায় একজনও হয় আমরা তার ন্যায্য কথা মেনে নেব। এর চাইতে বড় গণতান্ত্রিক কথা আর কি হতে পারে? তার ভাষণটি কত চমৎকার আর সময় উপযোগী তা আমরা নিচের অংশ থেকেই বুঝতে পারব: আমি, আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না। আমরা এদেশের মানুষের অধিকার চাই। আমি পরিষ্কার অক্ষরে বলে দিবার চাই যে, আজ থেকে এই বাংলাদেশে কোর্ট-কাচারি, আদালত-ফৌজদারি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে। গরিবের যাতে কষ্ট না হয়, যাতে আমার মানুষ কষ্ট না করে, সেজন্য সমস্ত অন্যান্য জিনিসগুলো আছে সেগুলির হরতাল কাল থেকে চলবে না। রিকশা, গরুর গাড়ি চলবে, রেল চলবে, লঞ্চ চলবে; শুধু সেক্রেটারিয়েট, সুপ্রিমকোর্ট, হাইকোর্ট, জজকোর্ট, সেমিগভর্নমেণ্ট দপ্তরগুলো, ওয়াপদা কোনো কিছু চলবে না।

২৮ তারিখে কর্মচারীরা বেতন নিয়ে আসবেন। এর পরে যদি বেতন দেয়া না হয়, আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোকদের হত্যা করা হয়, তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সব কিছু, আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে। আমরা ভাতে মারব, আমরা পানিতে মারব। তোমরা আমার ভাই, তোমরা ব্যারাকে থাকো, কেউ তোমাদের কিছু বলবে না। কিন্তু আর আমার বুকের ওপর গুলি চালাবার চেষ্টা করো না। সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না। আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দমাতে পারবে না।

এ দৃঢ়চেতা মানুষটি মৃত্যুকে ভয় পেতেন না। তখন পাকিস্তানের সামরিক শক্তি ছিল প্রচণ্ড শক্তিশালী। তাদের আধিপত্যে আমরা ছিলাম অসহায়। বিশেষত প্রতিরোধ বা রুখে দাঁড়ানোর সরঞ্জামও ছিল না। কিন্তু দূরদর্শী বঙ্গবন্ধু একদিকে যেমন গণতান্ত্রিকতার কথা বলেছিলেন আরেক দিকে তিনি বলে দিয়েছিলেন কি হবে রূপরেখা। ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার কথাটি কি সাধারণ কোনো আহ্বান? এই ডাক সেদিন আমাদের কিভাবে প্রভাবিত করেছিল তার প্রমাণ গ্রামবাংলার নারী ও আমাদের যুবসমাজ। প্রতিটি ঘরে সে ভাষণ ছড়িয়ে পড়তে দেরি হয়নি। মা-বোনেরা বুঝে নিয়েছিলেন তাদের কি করতে হবে। সে কারণেই গড়ে উঠেছিল সশস্ত্র প্রতিরোধ।

বঙ্গবন্ধুকে যারা ভিন্নভাবে জানেন বা বোঝেন তাদের সংখ্যা কম। কিন্তু এরাই তারা যারা গড্ডালিকা প্রবাহের বাইরে গিয়ে তার মূল কাজ ও কর্মপ্রবাহের মূল্যায়ন করেন। সে কারণে আজ প্রয়োজন এ ভাষণের আন্তর্জাতিকতা। স্বীকৃতি মিললেও কাজ বাকি আছে। বহুদেশের লাইব্রেরি ও বইয়ের দোকানে দুনিয়া কাঁপানো ভাষণের সংকলনগুলোতে এই ভাষণ নাই। কেন নাই? তার উত্তরও জানা নাই। সহজভাবে, বলতে গেলে এর জন্য যে উদ্যোগ বা কর্মপ্রচেষ্টা সেটা নাই বলেই এ হাল। অথচ এ ভাষণটি যে কোনো অবরুদ্ধ সংগ্রামরত আর মুক্তিপিয়াসী মানুষের জন্য আদর্শের অনুপ্রেরণার। আশা করব বঙ্গবন্ধু কন্যা সফল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার এই দায়িত্ব পালন করে ৭ মার্চের ভাষণটিকে আরও আন্তর্জাতিক সৌরভমণ্ডিত করে তুলবে।

আমাদের বালক বেলায় শোনা এখনো রোমকূপ শিহরিত এ ভাষণটির অযথা যথেচ্ছ ব্যবহার বন্ধ করা হোক। কারণ এটি আমাদের ঐতিহ্য আর ইতিহাসের অনিবার্য অংশ। সে ডাকটি এখনো ক্লাসিক, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো।

বাঙালি বাংলাদেশে অনিয়ম অগণতান্ত্রিকতা আর ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে আজো দুর্গ গড়ে তোলার বিকল্প নাই।

লেখক: সিডনি প্রবাসী সিনিয়র সাংবাদিক

নয়া শতাব্দী/আরজে

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ