অভিস্রুতি শাস্ত্রী নাকি বৃষ্টি খাতুন- এই বিতর্ক এখন গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়াজুড়ে। ফয়সালা দেবে ডিএনএ ল্যাব, এমনটাই জানায় প্রশাসন। এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, অভিস্রুতি শাস্ত্রীই মূলত বৃষ্টি খাতুন।
অভিস্রুতি শাস্ত্রীর জাতীয় পরিচয়পত্র, জন্মনিবন্ধন, একাডেমিক সার্টিফিকেট, চাকরিস্থলের বায়োডাটা, ইডেন কলেজ কর্তৃপক্ষের বক্তব্য, বাবা-মা ও এলাকারবাসীর বক্তব্য, মিডিয়ার সরজমিন প্রতিবেদন, এমনকি ফিঙ্গারপ্রিন্ট পরীক্ষা করেও এ তথ্য নিশ্চিত হওয়া গেছে।
এতগুলো ডকুমেন্ট দ্বারা নিশ্চিত হওয়ার পরেও, একজন উৎপল সাহার অভিযোগের ভিত্তিতে ডিএনএ পরীক্ষার জন্য তার মরদেহ রাখা হয়েছে মর্গে। বৃষ্টি খাতুনের বাবা-মা ডিএনএ পরীক্ষা দিতেও প্রস্তুত এবং ইতোমধ্যেই তাদের নমুনাও সংগ্রহ করা হয়েছে।
আয়নাবাজির দেশে ডিএনএ টেস্টের রেজাল্ট কি আসবে, তা পূর্বানুমান করা কঠিন। তবে আমি বৃষ্টি খাতুনের বাবা-মায়ের নৈতিক সাহসকে গুরুত্ব দিতে চাই। বৃষ্টি খাতুন দত্তক নেওয়া সন্তান হলে, তারা ডিএনএ পরীক্ষায় রাজি হতেন না। যেমন, আদালতের নির্দেশ থাকার পরেও কল্পনা চাকমার পিতা-মাতা ডিএনএ টেস্টে রাজি হয়নি কখনো।
তাছাড়া যে সমস্ত সাংবাদিক বৃষ্টি খাতুনের বাড়িতে গিয়ে, এলাকাবাসী ও আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে কথা বলেছেন, তাদের মাধ্যমেও দত্তক নেওয়ার বিষয়টি বেরিয়ে আসার কথা। কিন্তু এমন কোনো তথ্য কোনো মিডিয়া দিতে পারেনি। তবুও রাষ্ট্র এতসব ডকুমেন্টের সমতুল্য করে তুলেছে একজন উৎপল সাহার অভিযোগকে।
সাম্প্রতিক বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি বোঝার জন্য এরকম আরও দু-একটি ঘটনার দিকে দৃষ্টিপাত করা যেতে পারে-
২০২১ সালের ১৪ জুন, খাগড়াছড়িতে নুসরাত জাহান নামে নিহত এক নও মুসলিমের মরদেহ চিতায় দাহ করার মাধ্যমে শেষকৃত্য সম্পন্ন করে তার পরিবার। ইসলাম ধর্ম গ্রহণের আগে নুসরাত জাহানের নাম ছিলো নিবেদিতা রোয়াজা। ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের এই নারী ধর্মে হিন্দু ছিলেন।
খবরে প্রকাশ, নিহত নিবেদিতা রোয়াজা ছিলেন খাগড়াছড়ি জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সভাপতি। মুসলিম ধর্মের ছেলে মামুন মিল্লাতকে ধর্মান্তরিত হয়ে বিয়ে করে নাম নেন নুসরাত জাহান। ধর্মান্তরিত হওয়া ও বাঙালি ছেলেকে বিয়ে করার কারণে তার ওপর একের পর এক হুমকি আসায়, তিনি খাগড়াছড়ি ছেড়ে ঢাকায় বসবাস শুরু করেন। তবে বিয়ের পর থেকে তাদের মধ্যে প্রায় ঝগড়া-বিবাদ লেগেই থাকতো বলে জানান রাজধানীতে তাদের প্রতিবেশিরা।
১২ জুন বিকেলে রাজধানীর আগারগাঁওয়ের সংসদ সচিবালয় কোয়ার্টার থেকে ২৮ বছর বয়সী নিবেদিতা রোয়াজার (নুসরাত জাহান) গলায় ওড়না পেঁচানো ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। নুসরাত তার স্বামী মামুন মিল্লাতের সঙ্গে থাকতো ওই বাসায়।
১৫ জুন র্যাব-২ এর একটি অভিযানিক দল গোপন সংবাদের ভিত্তিতে রাজধানী দারুস সালাম থানাধীন কল্যাণপুর খাজা সুপার মার্কেট সংলগ্ন শাহ ফতেহ আলী পরিবহনের টিকেট কাউন্টার থেকে আসামি মো. মিল্লাত মামুনকে (২৭) আটক করে।
এদিকে নুসরাত জাহানের মরদেহ ঢাকায় ময়নাতদন্ত শেষে ১৩ জুন রাতে খাগড়াছড়ির ঠাকুরছড়ায় বাবার বাড়িতে নেওয়া হয়। পরদিন ১৪ জুন সকালে হিন্দুধর্ম মতে আনুষ্ঠানিকতা শেষে মরদেহের দাহ সম্পন্ন করা হয়। অথচ নুসরাত জাহান ধর্মান্তরিত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন।
এর আগে টেকনাফে হালিমা তুস সাদিয়া নামে এক নও মুসলিমের মরদেহ তার বাবার পরিবার সীমা বৌদ্ধবিহারে শেষকৃত্যসহ দাহ করে ফেলে। তার পূর্ব নাম ছিলো লাকিংমে চাকমা। বাঙালি ছেলে আতাউল্লাহকে ভালোবেসে বিয়ে করে হালিমা তুস সাদিয়া নাম গ্রহণ করেন।
লাকিংমের পিতা লালা অং অভিযোগ করেন, ২০২০ সালের ৫ জানুয়ারি কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার বাহারছড়া ইউনিয়নের শিলখালী চাকমাপাড়ার নিজ বাড়ি থেকে লাকিংমেকে অপহরণ করা হয়।
অন্যদিকে নিজেকে লাকিংমের স্বামী দাবি করে আতাউল্লাহ বলেন, ‘২০২০ সালের ২১ জানুয়ারি কুমিল্লায় লাকিংমে ধর্মান্তরিত হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে হালিমাতুস সাদিয়া নাম ধারণ করেন এবং একই দিন এফিডেভিট মূলে তারা বিবাহ সম্পন্ন করেন। তাদের সংসারে একটি সন্তানও রয়েছে।
২০২১ সালের ৯ ডিসেম্বর একটি পারিবারিক অনুষ্ঠানের আগে লাকিংমের সঙ্গে কথা কাটাকাটি হয়। এতে অভিমান করে কীটনাশক পান করে। ১০ ডিসেম্বর রাতে টেকনাফ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে মুমূর্ষু লাকিংমেকে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। ওই দিন থেকেই লাকিংমের মরদেহ কক্সবাজার সদর হাসপাতাল মর্গে ছিল।
ভুক্তভোগী পরিবার আদালতে মামলা করেন। আদালত মামলাটি তদন্তের জন্য পিবিআইকে নির্দেশ দেন। কিন্তু পিবিআই মামলাটি তদন্ত করে অপহরণ নয় মর্মে আদালতে প্রতিবেদন দেয়। তবে তদন্তে প্রমাণিত হয় যে, নিহত হালিমার বয়স ১৬ বছর। প্রাপ্তবয়স্ক না হওয়ায় আইনমতে আদালত তার মরদেহটি পিতা-মাতার কাছে হস্তান্তর করতে নির্দেশ দেন। এরপর তার পিতামাতা রামুর সীমা বৌদ্ধ বিহারে শেষকৃত্য করে দাহ করে ফেলে।
স্বামী আতাউল্লাহ ওই সময় দাবি করেন, হালিমা তার স্ত্রী। তাকে ইসলাম ধর্ম মতে দাফন করতে চান তিনি। তবে আদালতের নির্দেশে বাবা-মার কাছেই মেয়ের মরদেহ হস্তান্তর করা হয়।
উপরের দুটি ঘটনা থেকে আমরা দেখতে পাই, কোনো না কোনো কারণ দেখিয়ে দুটি নওমুসলিম নারীর মরদেহ চিতায় দাহ করা হয়। এক্ষেত্রে মৃতদের স্বামীর বক্তব্য বা ইসলাম গ্রহণের বিষয়টি প্রাধান্য পায়নি।
চট্টগ্রামের একটি আদালতে সম্প্রতি আরেকটি নওমুসলিম হিন্দু নারীর মামলার ঘটনাকে কেন্দ্র করে আদালত প্রাঙ্গনে ওই নারীর পরিবারের পক্ষের লোকজন যেভাবে ও যে ভাষায় মিছিল করেছে, তা ছিল নজিরবিহীন। সোশ্যাল মিডিয়ায় বিষয়টি আলোচিত হলেও উপরোক্ত তিনটি ঘটনা বাংলাদেশের মূল গণমাধ্যমে স্থান পায়নি। কিন্তু ঘটনাটি যদি এর উল্টো হতো, তাহলে গণমাধ্যম, মানবাধিকার কর্মী, সুশীল সমাজ, আইনজীবীসহ বিভিন্ন পেশাজীবী অঙ্গন থেকে এর প্রবল প্রতিক্রিয়া আমরা লক্ষ্য করতাম।
অভিস্রুতি শাস্ত্রী নিয়ে আমি আরও একটি লেখা এ কারণে দিলাম যে, এ পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে ধর্ম পরিবর্তন না করেও বৃষ্টি খাতুনের পরিবর্তে অভিস্রুতি শাস্ত্রী নাম পরিবর্তন এবং পূজা অর্চনা করা, মন্দিরে যাতায়াত করা এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের সাথে ওঠাবসা ও সম্পর্ক গড়ে তোলার পেছনে আমার অবজারভেশনগুলো রাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা।
সেগুলো হলো:
১. তার এই পরিবর্তনটি বিশেষ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে তিনি এই কাজটি করেছিলেন।
২. এই দেশে, এই পরিচয়ে কর্মসংস্থান, অর্থনৈতিক, সামাজিক বা অন্য কোনো সুবিধা গ্রহণ সহজতর বলে তার মনে হয়েছিল এবং তিনি সেটা পেতে চেয়েছিলেন।
৩. তিনি জেনে বুঝে অথবা না বুঝে কোনো ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির খপ্পরে পড়েছিলেন। সেটা যে কোনো এজেন্সি হতে পারে। কোনো সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য বাস্তবায়নে তাকে তৈরি করা হচ্ছিল।এটাও নানাভাবে হতে পারে। একটা মুসলিম মেয়ে হিন্দু পরিচয়ে মন্দিরে যাতায়াত করছে, পূজা অর্চনা করছে, হিন্দু সম্প্রদায়ের সাথে ওঠাবসা করছে এবং তাদের বিশ্বাস অর্জন করেছে। এর মধ্য দিয়ে ওই সম্প্রদায়ের মধ্যে কোনো সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য বাস্তবায়ন করা।
অথবা তাকে সেখানে রেখেই এমন কিছু কাজ করা, যার দায় তার মুসলিম পরিচয় উদ্ঘাটনের মাধ্যমে পরবর্তীকালে মুসলিম সম্প্রদায়ের ওপর চাপিয়ে দেওয়া। অর্থাৎ ঝুঁকি দুই দিকেই ছিল। এ ধরনের আরো অনেক বিষয় থাকতে পারে। তবে যদি সেটা হয়, তাহলে রাষ্ট্রের উচিত বিষয়টিকে খাটো না করে গুরুত্ব দিয়ে খতিয়ে দেখা।
নয়াশতাব্দী/এনএস
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ