ঢাকা, সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

রিফাতের নীল পরী!

প্রকাশনার সময়: ০৫ মার্চ ২০২৪, ১৪:৩৩

হঠাৎ দেখলাম গাঢ় নীল শাড়ি পরিহিত এক নারী দাঁড়িয়ে আছেন একটি বৈদ্যুতিক খাম্বা ঘেঁষে। আমি ঠিকঠাক না দেখেও মনে হলো কোনো পরী দেখছি! কিংবা কালো আকাশের চমকিত এক খণ্ড নীলাভ মেঘ। যা সচরাচর দেখা যায় না।

এটা যখন দেখলাম তখন ভোর সকাল। আমি হাঁটতে বেরিয়েছি। তখনও মুসল্লিরা ফজর শেষে মসজিদ থেকে ফিরছেন। আমি নামাজটা বাসাতেই সেরেছি। আজকাল মসজিদের ইমামদের কথা কাজে মিল নেই! তাই তাদের পেছনে দাঁড়াতে মন সায় দেয় না।

আমি ওপরে নিচে হাফ স্লিভ পরা। এটা আমার বেশ পছন্দের বটে। মাথায় ক্যাপও আছে। বেশ দ্রুতই হাঁটছি। সামনে একটি তিন রাস্তার মোড়। এখান থেকে আমি ডানে যাই সব সময়। বামে যে যাই না, তা নয়। তবে সর্বদা ডানপন্থী থাকতে পছন্দ করি। যদিও ছাত্রজীবনে রাজনীতি করেছি বাম। এখন তো তাতে পচা, নর্দামার গন্ধ- তাই দূরেই থাকি।

আমার আবার উচ্চ গন্ধে বেশ এলার্জি। হোক না সেটা সুগন্ধ বা দুর্গন্ধ। তাই এসব গন্ধ আমার এড়িয়ে চলতেই হয়। অবশ্য এক সময় এই সুগন্ধি ছাড়া চলতই না। এই সুগন্ধির কত যে কালেকশন তখনকার। সেই চিরচেনা একটি গন্ধ হঠাৎই নাসিকায় খোঁচা মারলো।

খাম্বার কাছাকাছি গেলাম। তৎক্ষণাৎ ক্রনিক হাঁচি দিলাম কয়েকটা। মেয়েটি রীতিমত ভড়কে গেলেন। আমি বললাম ভয় নেই, আর হবে না। এটা আমার এক ধরনের বিভ্রম ম্যানিয়া! অবশ্য রোগও বলতে পারেন। মেয়েটি খাম্বায় হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে ছিলেন। হাঁচির শব্দে চোখ খুলে তাকালেন। আমি মুচকি হাসলাম। মেয়েটি সাঁয় দিলেন।

আমি হাত নেড়ে এগুতে চাইলাম। মেয়েটি ইশারা করল দাঁড়ানোর। আমি দাঁড়ালাম। লম্বা কালো চুল দুদিকে বেণী করা। ফুল স্লিভ সাদা ব্লাউজ। বাহ! নাীল সাদা আর কালোর সেকী এক কম্বিনেশন! যা আমারও খুব প্রিয়। জানতে চাইলাম, এতো সকালে এখানে কেন?

মেয়েটি জবাব দিলেন- অপেক্ষা! নীল পাঞ্জাবী ও সাদা পায়জামা পরে কারো আসার কথা ছিল। আসেনি। তাই এখানেই রাত কেটেছে। বুকে ভয় নিয়েও সরিনি এখান থেকে। আমার বিশ্বাস, সে আসবে। সন্ধ্যা থেকে সকাল গড়িয়েছে, সে আসেনি!

মেয়েটির প্রশ্ন- আচ্ছা, কোথায় যেন আগুন লেগেছে, আপনি জানেন কি? আমি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লাম। বললাম, কাল শান্তিনগরে একটা রেস্টুরেন্টে আগুন ধরেছিল জানি। শুনেছি অনেকেই মারাও গেছে। অনেকেই এখনও হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে।

আচ্ছা আপনি আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাবেন? মেয়েটির প্রশ্ন। রিফাতদের বাসা শান্তিনগরেই। ও কাজও করতো সেখানকার একটি রেস্টুরেন্টে। বলেছিল, গতকাল সে সন্ধ্যা থেকে ছুটি নিয়েছে। কিন্তু এখনও এলো না। আমাকে এখানেই থাকতে বলেছিল। আসেনি তো কি হয়েছে! যদি এসে পড়ে! তাই সরিনি এক মুহূর্তও। সে যদি এসে না পায়! তাহলে কষ্ট পাবে। জানেন, আমার ফোনটাও নষ্ট। ও বলেছিল, আজ আমাকে একটা নতুন ফোন কিনে দেবে। বাটন ফোন! কারণ রিফাত তো সাধারণ কাজ করে। বেতন কম পায়। তাই বাটন ফোন কিনবো। আমি বলেছি, একটা হলেই চলবে।

মেয়েটি বলেই যাচ্ছে... আর আমি একটা রিকশা খুঁজে চলেছি... এতো সকালে রিকশাও নেই! দূর থেকে ডাক দিয়ে একটি পাওয়া গেল। তাও প্রায় ১৫ মিনিট পর! আমি আর নীল পরী রিকশায় বসেছি পাশাপাশি। গন্তব্য ঢাকা মেডিকেল।

১৫ মিনিট পর আমরা পৌঁছালাম। বাইরে ভিড়। ভেতরে চিৎকার, চেচামেচি। মনেই হচ্ছে না যে, এটা সকাল বেলা। সকালগুলো যতটা স্নিগ্ধ হয়, আজকের সকালটা ততটাই কর্কশ।

একজন ডোমকে দেখলাম গলায় স্বর্ণের চেইন, হাতে রূপোলি ব্রেসলেট। সাদা শার্টের সাথে সাদা লুঙ্গি। লাশ কাটা ঘরের দিকেই যাচ্ছে। হঠাৎ দেখি, সেই ঘরের সামনে রিফাতের বাবা। তাকে আমি চিনি আগে থেকেই। আমার হাঁটার সঙ্গী। আমাকে দেখে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন, ভাই আমার রিফাত আর নাই! আগুনে পুড়ে মারা গেছে। রেস্টুরেন্ট থেকে ছুটি নিয়েছিল। কিন্তু বৃহস্পতিবার রাতে বেশি গেস্ট থাকে, তাই বেরুতে দেয়নি ম্যানেজার। এরই মধ্যে আগুন লেগেছে। ছেলেটা আমার পুড়ে মারা গেল। আমার আর কেউ রইল না!

পাশ থেকে মেয়েটা সব শুনছে, সে হতভম্ব। কোনো কথাই বলছে না। অথচ একটু আগে কত কথাই বলছিল। আমি রিফাতের বাবাকে বুকে জড়িয়ে সান্ত্বনা দিচ্ছি। এটা আসলে মিথ্যে আশ্বাস! কারণ, আমরা সবই ভুলে যাবো দুদিন পরেই।

মেয়েটা হঠাৎ কেঁদে উঠল। আচমকা কি যেন একটা বের করে গলায় খোঁচা দিল। দেখলাম, ফিনকি দিয়ে রক্ত ঝরছে। ইট পাথরের মেঝেতে মেয়েটা লুটিয়ে পড়ল। ডাক্তারকে ডাকতে ডাকতে মেয়েটির শরীর নিস্তেজ হয়ে এলো। দেখলাম, মেয়েটির হাতে চুল বাঁধার একটা লম্বাটে কাঁটা। জিনিসটা মেটালের। রক্তমাখা কাঁটাটা হাতেই রয়েছে।

ডাক্তার এলেন। নার্স এলেন। ট্রলিতে উঠিয়ে নিথর দেহটি জরুরি বিভাগে নেওয়া হলো। চিকিৎসক মেয়েটির হাতের কবজি ধরলেন, মাথা নিচু করে মৃদু স্বরে বললেন, স্যরি! তিনি বেঁচে নেই। আমিও কাঁদলাম। রিফাতের বাবা এখনও কাঁদছেন। সইতে না পেরে একটি রিকশা ডাকলাম। ওঠার সময় হঠাৎ মনে হলো, মেয়েটার লাশের কি হবে?

নেমে এসে রিফাতের বাবাকে বললাম, মেয়েটিকেও সাথে নিন রিফাতকে নেবার সময়। ভদ্রলোক দুটি লাশই রিসিভ করলেন। ব্যাগ হাতিয়ে যা পাওয়া গেল, তাতে একটি এনআইডি ও কয়েকটি চিঠি ছাড়া কিছুই নেই। চিঠিগুলো মেয়েটির বাবার লেখা। সেখানে একটি ফেন নম্বর পাওয়া গেল।

মেয়েটির বাবাকে খবর দেওয়া হলো। ফোনের ওপারে গোঙানির আওয়াজ!

চার বছর পর আজ আবার সেই ২৯ ফেব্রুয়ারি! হাঁটতে বেরিয়েছি। আমারও বয়স বেড়েছে। তবে মনটাকে বলি সাতাশেই থাকো। নীল শার্ট পরো। কিন্তু পারি না। অথচ, নীল-ই ছিল আমার অত্যন্ত প্রিয় রঙ!

নয়াশতাব্দী/এনএস

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ