জাতীয় প্রেস ক্লাব ভিআইপি লাউঞ্জে নারায়ণগঞ্জ জেলা সমিতি আয়োজিত জাতীয় সাহিত্য উৎসবে আমার আমন্ত্রণে ২২ ফেব্রুয়ারি ভারতে ৫১ জন কবি সাহিত্যিক যোগ দিয়েছিলেন। আমার বন্ধুবর কথা সাহিত্যিক দিলীপ রায়, ড. রামপ্রসাদ বিশ্বাস এবং ভারতের প্রখ্যাত আনন্দ প্রকাশনের কর্ণধার বন্ধু নিগামানন্দ বাবুকে অনুষ্ঠানের আগে পরে পদ্মা সেতু আর পূর্বাচলে নিয়ে গিয়েছিলাম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গড়া সংগঠনের সিনিয়র ভাই প্রেসিডেন্ট শ্রদ্ধাভাজন ড. রামপ্রসাদ বিশ্বাস এসব দেখে তো চিৎকার করে বলছিলেন- ‘এতো দেখি স্বর্গে এলাম’।
প্রিয় বন্ধু নিগামানন্দ বাবু আমার আমন্ত্রণে প্রথম বাংলাদেশে এসেছেন। বাংলাদেশ সম্পর্কে তিনি ভারত থেকে বাংলাদেশে ঘুরে যাওয়া মানুষের মুখ থেকে শুনেছেন- বাংলাদেশ নাকি ভারতের গ্রামগঞ্জের মতো। তিনি বলছিলেন এতো দেখছি সব উল্টো। বাংলাদেশের আধুনিকতা আর পাশ্চাত্যের ছোঁয়া দেখে অভিভূত হন তিনি। রাতের পূর্বাচলের সড়কে দেখে দিলীপ রায় বলছিলেন- ‘এটা বাংলাদেশ’ ভারতে তো এমন সুন্দর সড়ক নেই। ২৪ তারিখে যেদিন ভারতে ফিরে যাচ্ছিলেন সবার মূলে একই কথা বাংলাদেশের মানুষের আন্তরিকতায়ও মুগ্ধ তারা, দেশের উন্নয়নে উৎফুল্ল।
সত্যিই দেশ এগোচ্ছে। পরিচ্ছন্ন হচ্ছে আগের চেয়ে। জাতীয় দৈনিকেও এমন শিরোনাম দেখি মাঝে মাঝে- ‘আগের চেয়ে আজকের বাংলাদেশের মধ্যে বিরাট ব্যবধান’। কথাটা কিন্তু নিরেট সত্য। এ সময়ে আমাদের জীবনযাত্রার মান বেড়েছে, আমাদের সঙ্গতি বেড়েছে। বাংলাদেশ এখন আর হেনরি কিসিঞ্জারের ‘তলাবিহীন ঝুড়ি নয়। রাস্তাঘাটের ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। স্বপ্নের মেট্রোরেল, বঙ্গবন্ধু টানেল, উড়াল সেতু, এক্সপ্রেস সড়ক হয়েছে, পদ্মা সেতু হয়েছে বাংলাদেশের গাঁটের টাকায়। এটা চাট্টিখানি কথা নয়। কক্সবাজারে সর্বাধুনিক বিমানবন্দর হচ্ছে তা কিনা বিশ্বের প্রথম সমুদ্রের পানি ছুঁয়ে ওঠানামা করবে বিমান।
কক্সবাজারে পাহাড় পথ বেয়ে ট্রেন চলে গেছে। আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হচ্ছে অনেকটা সিঙ্গাপুরের আদলে, ৩০০ ফিট রাস্তা হয়েছে দুবাইয়ের আদলে আরও কত কি। বিশ্ব অর্থনীতি মন্দায় বাংলাদেশ কিছুটা হোঁচট খেয়েছে। রিজার্ভে টান পড়েছে তবে বিদেশি ষড়যন্ত্র আর অপপ্রচার রোধ করতে পারলে আবার ঘুরে দাঁড়াবেই বাংলাদেশ। বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে।
পুরোটাই সত্য। এও সত্য, আমরা সভ্যতায় পিছিয়ে আছি। সভ্য এখনো হতে পারিনি আমরা। আমাদের রূপ বদলেছে, মানুষের ভিতরটা এখনো বদলায়নি। তাই কথায় কথায় ধর্ষিত হয় আমাদের নারী। জেল, জুলুম, ভেজাল, অন্যের জমি লুণ্ঠন সবই হচ্ছে সমান তালে। এগুলো বন্ধ হলে সোনার বাংলাদেশ হবে দেশটা। এখনো আমরা আইন মানি না, কথায় কথায় ঘুষ-দুর্নীতি করি, খাদ্যে ভেজাল দিই। সড়কে কথায় কথায় মানুষ মরে। বিষ মিশ্রিত খাবার খেয়ে মানুষ জটিল কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়।
বিষাক্ত খাবার খেয়ে স্ট্রোক, হূদরোগ আর ক্যান্সারে অকাল মৃত্যুর দিকে এগুচ্ছি আমরা। আগে যারা তিন বেলা খাবার পেত না এখন তারা মোটামুটি সচ্ছল। সবারই সঙ্গতি বেড়েছে। স্বপ্নের সিঁড়ি বেয়ে বাংলাদেশ উন্নত দেশের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য অনেক দেশেই ছুটে গেছি। তা প্রায় ৩৫/৩৬টি দেশ হবে। যেসব দেশকে খুব দরিদ্র ভাবতাম তারা আমাদের চেয়ে সভ্যতায় অনেক বেশি এগিয়ে।
ভুটানে যাইনি এই ভেবে পাহাড় আর গরিব দেশে কি দেখব, আর শিখবই বা কি? আমার পরিচালনাধীন আল-রাফি হাসপাতাল লিমিটেডের পরিচালক এবং ডাক্তারদের নিয়ে গত বছর এক অনুষ্ঠানে মিয়ানমার যাই। আমরা আট লাখ মানুষের দেশ থেকে অনেক কিছু শিখলাম। মানুষ সভ্য হতে পুলিশ প্রশাসনের দরকার হয় না। ৪৬ হাজার ৫০০ বর্গকিলোমিটার দেশের মানুষ আইন মেনে চলে। নিজ চোখে যা দেখলাম তাই লিখছি। ১৯৫০-এর দশক পর্যন্ত ভুটান একটি বিচ্ছিন্ন দেশ ছিল।
১৯৬০-এর দশকে ভারতের কাছ থেকে অর্থনৈতিক সাহায্য নিয়ে দেশটি একটি সভ্য রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হতে শুরু করে। তবে এখনো এটি বিশ্বের সবচেয়ে অনুন্নত দেশগুলোর একটি। অনুন্নত একটি দেশ নিয়েই কথা বলছি আমি। হাসপাতালের ডাক্তার এবং পরিচালকদের নিয়ে মাত্র পাঁচ দিন ছিলাম। এ অল্প সময়েই নিজেকে সুস্থ অনুভব করছিলাম। খাবারের ভীতি ছিল না। ভেজাল দিতে ওরা বোধ হয় শিখেনি। নিম্নমানের হোটেলগুলো আমাদের পাঁচ তারকা হোটেলের মতো পরিচ্ছন্ন।
ফল-ফলাদি খেলেই বোঝা যায় ভালো কিছু খাচ্ছি। দরিদ্র দেশটির মানুষগুলো পরিচ্ছন্ন জীবনযাপন করে। পোশাক-আশাক দামি না হলেও আধুনিকতার ছাপ। সবচেয়ে বড় কথা ওরা আইন ভাঙে না কখনো। ওই দেশে চুরি ডাকাতি নেই। যদি থাকত মাইলকে মাইল পাহাড়ি নির্জন পথে আমরাই ডাকাতের কবলে পড়তাম। রাস্তায় পাঁচ দিনে পুলিশ দেখেছি একজন মাত্র। রাস্তার আইন ওরা শতভাগ মানে। তাই দুর্গম পথেও দুর্ঘটনা নেই বললেই চলে।
আমাদের বহনকারী ট্যুরিস্ট বাসটি নির্দিষ্ট জায়গাতেই থামছিল। আমরা কোনো দর্শনীয় জায়গা পেলে নামতে চাইলেও বলছিল, এখানে থামার নিয়ম নেই। ত্রিসীমানায় কেউ নেই, তবুও নিজ থেকেই ড্রাইভার নিয়ম মেনে চলছে। কখনো মোবাইল ফোন ধরার প্রয়োজন হলে গাড়ি থামিয়ে কথা শেষ করে তবেই গাড়ি চালাচ্ছিলেন তিনি। পথচারীর চেয়েও ড্রাইভারগণ অনেক বেশি সচেতন। পথচারী পথ পার হবে বুঝতে পেরে বহু আগে থেকেই গাড়ি থামিয়ে বসে থাকে ড্রাইভার।
এমন নিয়ম কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, তাইওয়ান, জাপানে দেখেছি। বোধ করি তার চেয়েও গরিব দেশটিতে ড্রাইভাররা অনেক বেশি সচেতন মনে হয়েছে আমার। এখানে সিসি ক্যামেরা পুলিশ নজরদারি নেই, আইন না মানলেও দেখার কেউ নেই, তবুও ওরা আইন মানছে। ওরা সভ্য তাই সড়কে নিরাপত্তা বেশি। পাঁচ দিন সড়কে নির্ভয়ে চলেছি। ভীতি ছিল না।
যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরকে আমার কাছে অন্যসব মন্ত্রীদের চেয়ে একটু ভিন্ন মনে হয়। দেখি তিনি মাঝে মাঝে রাস্তায় নামেন। হুঙ্কার দেন। যদিও তার হুঙ্কার কাজে আসছে না। আসলে আমাদের সড়ক এখনো এত অনিরাপদ থাকত না। আমি প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলতে চাই- ‘আমরা সভ্য নই, আপনি আমাদের সভ্য হতে বাধ্য করুন। কঠোর হোন। আমি বিশ্বাস করি আপনি চাইলে তা পারবেন। প্রধানমন্ত্রী তো ছোট পদ নয় যে, ইচ্ছা পূরণ হবে না। ইচ্ছা করতে হবে, নিষ্ঠুর হতে হবে, তবেই আমাদের সভ্য বানাতে পারবেন আপনি।’
যতদিন ছিলাম লায়ন্স ক্লাবের প্রোগ্রাম শেষে হোটেলে ফিরে ডিনার এবং কিছুটা বিশ্রাম নিয়ে রাতে ট্যাক্সি নিয়ে বেরিয়ে পড়েছি। অল্প সময়ের জন্য গিয়েছি সেখানে, তাই রাতের সময়টাও নষ্ট করতে চাইনি আমি। ফাঁকি দিলে ভালো কিছু লেখা হবে না। তাই সময় কাজে লাগানো আর কি। এদেশে রাতে ঘুরে বেড়ানো দুষ্কর হয় বৈকি! কক্সবাজার সী বীচে রাতে ছিনতাইয়ের খবর জানতে পারি। চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় তো রাত ১০টার পর ভয়ঙ্কর রূপ নেয়। রাতে শহর কিংবা গ্রামে একা চলা দায়। মাস্তান ছিনতাইকারীদের ভয়। কি জানি কি হয়। আমাদের দেশটা কিন্তু অর্থনীতিতে অনেক এগিয়েছে। দেশে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। সভ্যতায় এগোয়নি বরং পিছিয়েছি।
অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মেগা প্রকল্পের মাধ্যমে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, বিদেশি বিনিয়োগ অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি অনেক প্রভাবশালী দেশকে ছাড়িয়ে যাবে। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্জন, যা নিয়ে দেশের নীতিনির্ধারকসহ বিভিন্ন মহল স্বাভাবিকভাবেই বেশ উচ্ছ্বসিত। কিন্তু উচ্ছ্বসিত নই সভ্যতায়।
খাবারে ভেজাল বাড়ছে, সড়ক দুর্ঘটনা বাড়ছে, দুর্নীতি বাড়ছে। আগে পুলিশকে ২/৫০০ টাকা দিলে চলত। পরে হাজার, লাখ ছাড়িয়ে কোটির অঙ্কে ঘুষ লেনদেন হয়। ভূমি অফিসে, সাবরেজিস্ট্রি অফিসে নিয়ম করে, কাজ অনুসারে প্রকারভেদে নানা অঙ্কের ঘুষের লেনদেন চলে। হাসপাতালে দুর্নীতি চলে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি। কোথায় নেই দুর্নীতি? এক প্রধানমন্ত্রী একা কি দুর্নীতি রোধ করতে পারবেন? দেশটা আমাদের সবার, আসুন আমরা সবাই মিলে দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়ি।
সিন্ডিকেটের কবলে আটকে আছে দেশ। আর এ কারণে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি বলতেই হয় গরিব, মধ্যবিত্ত কেউ আর ভালো নেই, সুখে নেই। সম্প্রতি ঢাকা থেকে প্রকাশিত জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় ‘চাল তেলসহ সকল পণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী: জীবনের চাকা ঘোরাতে পারছে না নিম্ন আয়ের মানুষ’ এমন শিরোনামে একটি সচিত্র প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। প্রতিদিন আমরা যে খাবার খাচ্ছি তাতে কোনো এক মাত্রায় বিষ মেশানো আছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
খাদ্যে ভেজালের শাস্তি সাত থেকে ১৪ বছর কারাদণ্ড। কজনকে কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। বোধ করি একজনকেও না। তাই ভেজালকারবারিরা ভেজাল মেশাতে সাহস পাচ্ছে। উন্নত দেশগুলোতে খাদ্যে ভেজাল নেই বললেই চলে। আমাদের পাশের দেশ ভারত, ভুটানেও ভোক্তা অধিকার আইন খুবই কর্যকর। সেসব দেশে খাদ্যে ভেজাল প্রমাণিত হলে কঠোর শাস্তিও হয়। আর ভেজাল পণ্য বাজার থেকে উঠিয়ে নেয়া হয়। বাংলাদেশে ভেজার খাদ্যের কঠোর আইন আছে। সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো ঠিকভাবে ফলোআপ করে না। লোক দেখানো অভিযানও চলে মাঝেমধ্যে। কেউ ধরা পড়লে আইনে ফাঁকফোকরে আবার বেরিয়ে যায়। শাস্তি হয় না। তাই তারা ভেজাল মেশাতে সাহস পায়। কঠিন শাস্তি দরকার।
স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরে আমাদের চাওয়ার জায়গাটায় একটি পরিবর্তন এসেছে। এখন কেবল সভ্য হতে হবে আমাদের। যার যার কাজ তাকেই করতে হবে। দুর্নীতিকে না বলতে হবে। পরিবেশ সচেতন হতে হবে। খাদ্যে সচেতন হতে হবে। যোগাযোগ, বিশেষ করে ট্রাফিক আইন মানার বিষয়টিতেও আমাদের অনেক শিক্ষা নেয়া প্রয়োজন। আইনশৃঙ্খলা, নিরাপত্তা, পরিচ্ছন্নতার বিষয়টিতেও আমাদের সজাগ হতে হবে। - লেখক: সাংবাদিক, সমাজ গবেষক
নয়া শতাব্দী/আরজে
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ